মমতার সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতির শিকড় দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের স্পৃহার মধ্যে
কামালগাজিতে, রাজাবাজারে কালিপুজো ভাঙচুর হয়েছে শুনে এবং ভিডিও দেখে অনেকেই ঘাবড়ে যাচ্ছেন। অথচ আজ থেকে মাত্র 20 বছর বা তার আগেও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এমন জায়গা ছিল যেখানে মাতৃ মূর্তির সামনে নিম্নাঙ্গের পোশাক তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত কোনো কোনো লোককে। (এ হেন বাক্যটি অশ্লীল শোনালে আমি ক্ষমাপ্রার্থী কিন্তু সত্যের তো শ্লীল অশ্লীল হয় না।) তখন যখন কিছু কিছু লোক এ নিয়ে প্রমাদ গুনেছিল ও আপত্তি জানিয়েছিল, তখন সেই লোকেদেরকে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাম্প্রদায়িক বলে, বলা হয়েছিল তাঁরা নাকি অযথা বেশি চিন্তা করছেন যতটা করার নাকি প্রয়োজন ছিল না। অন্যদিকে, পুজো আক্রমণ করার মানসিকতা যাদের, মাতৃ মূর্তি আক্রমণ করার আগে তারা জোগাড় করে এলাকার রাজনৈতিক সমর্থন। আর এদেরকে সমর্থন দেয় যে সব রাজনৈতিক দল, সেই সব দলকে যে বিষবৎ পরিত্যাগ করাই উচিত, পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা তা বুঝতে পারে নি টাকার লোভে। আজ তাই সময় প্রায়শ্চিত্তের। কালের রথচক্র রেয়াত করবে না কাউকেই।
২০১১'য় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতেছিলেন হিন্দুদের ভোটে। মুসলমান ভোট সে বছরেও grossly রয়ে গিয়েছিল সিপিএমের কাছেই। অতঃপর ২০১৬'র নির্বাচনের আগে মমতা ঝাঁপালেন মুসলমান ভোট নিজের ঝুলিতে পুরতে কারণ 2014'য় ভারতের রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ভোটারদের এক অংশ ঝুঁকে পড়েছিল বিজেপির দিকে। ফলে জয় সুনিশ্চিত করতে মমতাকে ঝাঁপাতেই হয়েছিল মুসলিম ভোটের দিকে।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। এ কথা কেন বলছি? জয় সুনিশ্চিত করতে মুসলিম ভোটের দিকে ঝুঁকতেই হল কেন? মমতা কি পারতেন না রাজ্যের প্রকৃত বিকাশে মনোনিবেশ করতে? অর্থাৎ 2016'য় সুপ্রিম কোর্ট যখন রায় দিল যে সিঙ্গুরের চাষের জমি (যে জমিতে সিমেন্ট ফেলা হয়ে গিয়েছিল সেই 2006 সালেই, ফলে উর্বরতা বলতে কোনোকিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না যে জমিতে) ফিরিয়ে দিতে হবে চাষীদেরকেই, তখন মমতা কি পারতেন না চাষীদেরকে বুঝিয়ে টাটাদেরকে ফিরিয়ে আনতে? একথা এই কারণেই বলছি যে জমি ফেরানোর সুপ্রিম রায় শুনে বহু 'অনিচ্ছুক' চাষীও কিন্তু তখন ভেঙ্গে পড়েছিলেন (রিপোর্টেডলি)। কারণ তদ্দিনে তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁদের আম-ছালা দুই-ই গিয়েছে। সেই সময় চাইলে মমতাই একমাত্র পারতেন তাঁদেরকে ফ্যাক্টরির জন্য রাজী করাতে। পারতেন ঐ অর্ধনির্মিত, অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া পরিকাঠামোয় অ্যাগ্রেসিভলি অন্য কোনো শিল্পের নির্মাণে উদ্যোগী হতে। পারতেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গঙ্গা মোহনা অঞ্চলে বন্দর নির্মাণে উদ্যোগী হতে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা সীমান্ত দিয়ে জি হাদী অনুপ্রবেশ ও উক্ত জেলার দারিদ্র্য — দুই সমস্যাই সেক্ষেত্রে মিটে যেত ঐ এক চালেই। চাইলে মমতা পারতেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সরকারি কর্মচারীদের স্যাঙ্কশনড্ স্ট্রেঙ্গ্থ যা ছিল তা দ্রুতগতিতে পূরণ করতে এবং তার মাধ্যমে রাজ্যের ইকোনমিকে সচলতর করতে। চাইলে তিনি পারতেন হিন্দু বাঙালীর যে সম্প্রদায়গুলি ন্যায়সঙ্গতভাবেই OBC সংরক্ষণ দাবী করতে পারে তাদেরকে OBC শ্রেণীভুক্ত করতে। পারতেন কলকাতার নিউ টাউনে সুবিশাল জমির উপর একটি দুর্গা মন্দির নির্মাণ করার প্রস্তাব করতে যা দেখতে গোটা ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর লোক আসতে পারত এ রাজ্যে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইলে করতে পারতেন আরও অনেক কিছুই। (কি কি পারতেন সে তালিকা দীর্ঘায়িত করে শুধু শুধু অন্যকে আইডিয়া দেব কেন?) নির্বাচনী লাভ তাঁর তাতেও হত এবং মুসলমান ভোটের জন্য এমন কাছাখোলা না হয়েও সেক্ষেত্রে তিনি জিততে পারতেন নির্বাচনে। কিন্তু এসবের কোনোটাই তিনি করেন নি।
কারণ 2011'য় জেতার বহু আগে থেকেই দুর্নীতিতে হাত পাকিয়ে ফেলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী নেত্রী এবং তাঁর দল। তার সবথেকে বড় প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ভ্যান থেকে জেলবন্দী কুণাল ঘোষের চিৎকার করে বলা কথাগুলো। এবং এ রাজ্যে 1)দুর্নীতি, 2)মানুষের দরিদ্রায়ণের রাজনীতি আর 3)সংখ্যালঘু ভোট — এই তিনটি বিষয় একে অপরের সঙ্গে লেবড়েজুবড়ে হয়ে থাকে একেবারে একাকার। ফলে দুর্নীতিতে বেশি দূর এগোনোর লক্ষ্য পূরণ করতে হলে বাকি দুইটি বিষয়েও মমতাকে পা বাড়াতেই হত। অর্থাৎ মমতার সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতির শিকড়টি রয়েছে তাঁর দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের স্পৃহার মধ্যে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ রাজ্যের বিকাশ চান নি এবং চাইলেও করতে পারতেন না কারণ মমতার কমরেড ছিল নকশালবাদী মার্ক্সিস্ট, লেনিনিস্ট, মাওইস্টরা। এ রাজ্যের বিকাশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তারা সেক্ষেত্রে প্রয়োগ করত তাদের সর্বশক্তি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যেত পড়ে। সিপিএমের প্রো-জ্যোতি বসু ও অ্যান্টি-বুদ্ধ ভটচায্ লবিকে সঙ্গে নিয়ে সিঙ্গুরকে ধ্বসিয়ে দিয়েছিল বস্তুতঃ মমতার এই নকশালবাদী কমরেডরাই। ভাঙ্গরে পাওয়ার গ্রিডের কাজও যে মমতা করিয়ে উঠতে পারেন নি, সে-ও এদের জন্যই। (আমার লেখা যাঁরা পড়েন তাঁরা আশা করি এটুকু বিশ্বাস করতে চাইবেন যে তথ্য ব্যতীত এমন সব দাবী করার বোকামি আমি করছি না।)
মমতা মানুষকে আরও দরিদ্র বানাতেই চেয়েছিলেন বলেই সরকারি দপ্তরে নিয়োগ বন্ধ করেছেন এবং যেটুকু নিয়োগ করেছেন তার বদলে সাঙ্গোপাঙ্গোদের দিয়ে মানুষের থেকে কেড়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন তাদের সঞ্চিত অর্থ ও জমিজমার সম্বলটুকু পর্যন্ত। রোজগারহীন মানুষের টুঁটি নিজের মুঠোর মধ্যে আরও জোরে চেপে ধরার জন্যই ব্যবস্থা করেছেন নানাপ্রকার ভাতার কারণ মানুষকে দেহে ও মনে উভয় প্রকারেই দরিদ্র ও সরকারনির্ভর করতেই তিনি চেয়েছেন। যত এমন করতে তিনি পেরেছেন তত তাঁর দলবলের হাতে এসে জমা হয়েছে নানাপ্রকার অপরাধব্যবসার পয়সা এবং সরকারি ট্রেজারির লুঠের পয়সা। কেবলমাত্র এই পয়সার দিকে তাকিয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিতে হয়েছিল সংখ্যালঘু ভোট নিজের ঝুলিতে নিয়ে ভোটে জেতার শর্টকাট পদ্ধতি। পশ্চিমবঙ্গের বিকাশের মাধ্যমে হিন্দু ভোটের কনসলিডেশনর পথ নিলে সে পয়সার ভাণ্ডার তাঁর হাতে এসে পৌঁছত না। এবং সেই প্রকার গঠনমূলক ইতিবাচক রাজনীতি করার লোক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনোদিনই ছিলেন না।
অর্থাৎ দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িক তুষ্টিকরণের রাজনীতি এ রাজ্যে হয়ে রয়েছে পরস্পরের পরিপূরক। আর তা বুঝেও অথবা না বুঝেই হয়ত, পশ্চিমবঙ্গের একদল লোক (হিন্দু গোষ্ঠী) মানুষকে বলেছিলেন রাজনৈতিকভাবে মমতাকে সমর্থন করতে। তাঁরা হয়ত ভেবেছিলেন যে তাঁদের ভোট আর সংখ্যালঘুদের ভোটের দাম বুঝি বা মমতার কাছে সমান। তাঁরা বোঝেনই নি যে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের ভোট হল শুধুই ভোট আর সংখ্যালঘু ভোট = (ভোট + অপরাধব্যবসার পয়সা)। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকার দুর্নীতির আশ্রয় নেবে যে দল, সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি তাদেরকে করতেই হবে কারণ এ রাজ্যের সমস্ত দুর্নীতিচক্র মূলতঃ সংখ্যালঘু প্রধান এবং মসজিদের মাধ্যমে তাদের হাতে নিয়মিত আসে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি থেকে মোটা টাকার অনুদান যে ফাণ্ডের লোভে সংখ্যালঘুদের ব্লক ভোটের জন্য লালায়িত থাকে সিপিএম ও টিএমসির মত এ রাজ্যের হিন্দুবিরোধী দলগুলি।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে কংগ্রেস শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির ডায়নামিক্স এই প্রকার ছিল না। বিধান রায়ের কংগ্রেস, প্রফুল্ল সেনের কংগ্রেস, সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের কংগ্রেস আর রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস এক জিনিস নয়। সে কংগ্রেস ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কংগ্রেস, উপরন্তু সে আমলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থব্যবস্থাও ছিল সমৃদ্ধ। সেই সঙ্গে কংগ্রেস আমলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি অথবা দুর্নীতি, কোনোটিই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ছিল না। এমন নয় যে সে সময় দুর্নীতি বা অপরাধব্যবসার অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু সেসবের চরিত্র আজকের পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতি ও অপরাধব্যবসার চরিত্র অপেক্ষা ভিন্নতর ছিল এবং সে ব্যবসাগুলিও ছিল হিন্দুঅধ্যুষিত, ফলে হিন্দুদের অস্তিত্ব সঙ্কটের প্রশ্ন ছিল না।
কিন্তু রাজ্যের দুর্নীতি ও অপরাধব্যবসার বর্তমান সংখ্যালঘু অধ্যুষিত চেহারাটির জন্ম সিপিএম আমলে কারণ এ রাজ্যে অনুপ্রবেশকারী ঢোকানোর নীতিটি ছিল সিপিএমি নীতি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নারী পাচারের ব্যবসা কংগ্রেস জমানায় ছিল না, কিন্তু শুরু হয় সিপিএম আমলে। অর্থাৎ রাজ্যের মাটি ও কন্যারত্নদেরকে সংখ্যালঘুদের হাতে তুলে দেওয়ার রাজনীতি এবং সে রাজনীতি করতে গিয়ে হিন্দু বিরোধী ও হিন্দু বিদ্বেষী রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহন করার সংস্কৃতিটি এ রাজ্যে সিপিএম ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্কৃতি। এমতাবস্থায় এ রাজ্যের কোনো হিন্দু গোষ্ঠী যদি রাজ্যের হিন্দু মানুষকে রাজনৈতিকভাবে মমতাকে সমর্থন করতে বলে, তবে তার চাইতে অধিক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিন্দুদের পক্ষে আর কি ই বা হতে পারত?
কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তুষ্ট করতে সিপিএম এবং মমতাকে হিন্দুবিরোধী হতে হল কেন? হিন্দু বিরোধী না হয়েও কি সংখ্যালঘুদের তুষ্ট রাখা যেত না? উত্তর হল — না, যেত না। তোষণের একটি স্তরের পর রাডিকাল সংখ্যালঘুদের তুষ্ট করতে গেলে কাফিরদের উপর অত্যাচার করার জন্য তাদেরকে ফ্রিহ্যান্ড দেওয়ার প্রয়োজন হয় এবং হিন্দুবিরোধী না হলে সেটি সম্ভব হতে পারে না। অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের সর্বোত্তম উপায়ে তোষণ করতেই রাজাবাজার, গার্ডেনরিচ, কামালগাজি করতে দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনেক আশায় বুক বেঁধে 2011'য় যাঁকে ক্ষমতায় এনেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা।
Comments
Post a Comment