রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক
আজকের দিনে কুমুদরঞ্জন মল্লিকের "রথযাত্রা" কবিতাটি সকলের পাঠ্য। এ-ই প্রকৃত জগন্নাথ-বন্দনা এবং এ-ই জগন্নাথের প্রকৃত রূপ, যিনি জাতপাতের ঊর্ধ্বে। আজকের দিনে ভগবান নিজে আসেন ভক্ত-দর্শনে। যাঁরা জাতপাতের দোষ ধরে হিন্দুত্বকে গালাগালি দিয়ে থাকেন, তাঁরা হয় জানেন না, নয়ত জেনেও স্বীকার করতে চান না যে হিন্দুত্বের প্রকৃত স্বরূপ আদতে এ-ই। প্রকৃত হিন্দুত্ব এই কবিতায় বর্ণিত হয়েছে। একদা কবিতাটি পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের 'কবিতা সংকলন' গ্রন্থে সংকলিত ছিল এবং ক্লাস নাইনের পাঠ্য ছিল। আজকাল এসব কবিতা আর পড়ানো হয় না এবং ইন্টারনেটেও সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলা ভাষার স্বত্ব চলে গিয়েছে ইসলামিক বাংলাদেশের হাতে অথচ বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী আদতে হিন্দু বাঙালী।
এই কবিতাটি কবির 'উজানি' কাব্যগ্রন্থে 'চণ্ডালী' নামে প্রকাশিত।
রথযাত্রা
কুমুদরঞ্জন মল্লিক
বৃদ্ধ খঞ্জ চণ্ডালী এক শ্রীমুখ দেখিতে রথে
একাকিনী যায়, চলে ধীরি ধীরি মেদিনীপুরের পথে।
দিবসে যে শুধু হাঁটে এক ক্রোশ, তাহার একি গো দায়,
গৃহ হতে দূরে একশত ক্রোশ পুরীধাম যেতে চায়।
দলে দলে চলে পুরীর যাত্রী খোঁজ করে কেবা কার!
সেই সবাকার পিছু পড়ে থাকে, চলিতে পারে না আর।
রথযাত্রার যবে শুধু আর দুই দিন বাকি আছে,
বহু কষ্টে সে পঁহুছিল সাঁঝে আসি কটকের কাছে।
"কোথা যাবি বুড়ি?"—পথিক জনেক শুধালো সেখানে তারে।
বৃদ্ধা বলিল—"চলিয়াছি বাবা, চাঁদমুখ দেখিবারে।"
ঈষৎ হাসিয়া কহিল সে-জন—"কেমনে পারিবি বুড়ি,
রাত পোহালে যে কাল রথ খেপী, দেখিবি কেমন করি'?"
শুনি চণ্ডালী রুষিয়া বলিল—"বাকি যে এখনও পথ,
কি বলিছ তুমি রাতি পোহাইলে কেমনে চলিবে রথ?"
হাসিয়া পথিক বলিল—"তাই তো, চল্ তাড়াতাড়ি চল্—
তুই, খেপী, যদি না যাইবি সেথা, রথ কে টানিবে বল্!"
ঘুমাইল বুড়ি, রজনী প্রভাতে উঠে বলে—"চল যাই"—
দুটি পা তাহার বেদনা-জড়িত উঠিতে শকতি নাই।
আড়ষ্ট ব্যথা, পারে না নড়িতে, তবু দিয়া হামাগুড়ি,
রথেতে দেখিবে শ্রীমুখ বলিয়া চলিতে লাগিল বুড়ি!
ভক্ত কত না জুটেছে শ্রীধামে, রথযাত্রা যে আজি,
কাঙালের হরি উঠেছেন রথে অভিনব বেশে সাজি,
একি অঘটন, একি হল আজ, চলে না দেবের রথ!
অজুত ভক্ত টানে রশি ধরি, কর্দমহীন পথ।
জুড়িল হস্তী তবু যে গো রথ তেমনি রহিল থির;
ভাবনা-ব্যাকুল প্রধান পাণ্ডা, ঝরে নয়নের নীর।
ধুলার মাঝারে লুটায়ে পাণ্ডা জানিতে পারিল ধ্যানে—
প্রবল ভক্ত কে-এক রথের পশ্চাৎ দিকে টানে।
যাবৎ না ছোঁয় সমুখের রশি শুচি করতলে তার,
হাজার হস্তী রথের চক্র নড়াতে নারিবে আর।
বাহির হইল পাণ্ডার দল ভক্ত-অন্বেষণে—
কৌপীন-পরা সন্ন্যাসী যত ধরে আনে জনে জনে।
তিলক-ভূষিত নামাবলী-ধারী বৈষ্ণব আনে ধরে,
কাহারো পরশে সে বিরাট রথ এক তিল নাহি নড়ে!
খুঁজিতে খুঁজিতে বহুদূরে আসি প্রধান পাণ্ডা, হায়,
দেখিল খঞ্জ বৃদ্ধা জনেক পুরী অভিমুখে যায়।
হামাগুড়ি দিয়া চলিয়াছে বুড়ি; পাণ্ডা শুধালো তারে—
"এ খর-রৌদ্রে ভিক্ষার লাগি যাইবি কাহার দ্বারে?
তপ্ত বালুতে পুড়িতেছে পথ, আঁখি ভরে গেছে জলে—
দিনু এই সিকি, ফিরে গিয়ে বোস্ ওই অশথের তলে।"
বুড়ি বলে—"বাবা, বল কবে রথ, পয়সাতে কাজ নাই,
রথেতে দেখিব শ্রীমুখ বলিয়া রোদে চলিয়াছি তাই।"
শুনি ব্রাহ্মণ কাঁদিতে কাঁদিতে বৃদ্ধারে বুকে করি
"পেয়েছি, পেয়েছি"—বলিয়া ছুটিল পুরীর সড়ক ধরি।
ব্যাকুল বৃদ্ধা বলে—"দাও ছাড়ি, বাবা গো চাঁড়াল মুই।"
ব্রাহ্মণ বলে—"দে মা পদধূলি, গুরুর গুরু যে তুই।"
চকিতে দেখিল যাত্রীরা সবে,"জয় জয় জয়" বলে—
প্রধান পাণ্ডা আসিল যে সেই খোঁড়া বুড়ি লয়ে কোলে।
অচল সে রথ চলিতে লাগিল, বুড়ি দিল যবে হাত—
উল্লাসে সবে গাহিয়া উঠিল—"ধন্য জগন্নাথ!"
সাশ্রু-নয়নে অজুত ভক্ত গাহিল ভক্তি-গান—
"সত্যই তুমি কাঙালের হরি ভক্তের ভগবান!"
জয় জগন্নাথ 🙏
এই কবিতাটি কবির 'উজানি' কাব্যগ্রন্থে 'চণ্ডালী' নামে প্রকাশিত।
রথযাত্রা
কুমুদরঞ্জন মল্লিক
বৃদ্ধ খঞ্জ চণ্ডালী এক শ্রীমুখ দেখিতে রথে
একাকিনী যায়, চলে ধীরি ধীরি মেদিনীপুরের পথে।
দিবসে যে শুধু হাঁটে এক ক্রোশ, তাহার একি গো দায়,
গৃহ হতে দূরে একশত ক্রোশ পুরীধাম যেতে চায়।
দলে দলে চলে পুরীর যাত্রী খোঁজ করে কেবা কার!
সেই সবাকার পিছু পড়ে থাকে, চলিতে পারে না আর।
রথযাত্রার যবে শুধু আর দুই দিন বাকি আছে,
বহু কষ্টে সে পঁহুছিল সাঁঝে আসি কটকের কাছে।
"কোথা যাবি বুড়ি?"—পথিক জনেক শুধালো সেখানে তারে।
বৃদ্ধা বলিল—"চলিয়াছি বাবা, চাঁদমুখ দেখিবারে।"
ঈষৎ হাসিয়া কহিল সে-জন—"কেমনে পারিবি বুড়ি,
রাত পোহালে যে কাল রথ খেপী, দেখিবি কেমন করি'?"
শুনি চণ্ডালী রুষিয়া বলিল—"বাকি যে এখনও পথ,
কি বলিছ তুমি রাতি পোহাইলে কেমনে চলিবে রথ?"
হাসিয়া পথিক বলিল—"তাই তো, চল্ তাড়াতাড়ি চল্—
তুই, খেপী, যদি না যাইবি সেথা, রথ কে টানিবে বল্!"
ঘুমাইল বুড়ি, রজনী প্রভাতে উঠে বলে—"চল যাই"—
দুটি পা তাহার বেদনা-জড়িত উঠিতে শকতি নাই।
আড়ষ্ট ব্যথা, পারে না নড়িতে, তবু দিয়া হামাগুড়ি,
রথেতে দেখিবে শ্রীমুখ বলিয়া চলিতে লাগিল বুড়ি!
ভক্ত কত না জুটেছে শ্রীধামে, রথযাত্রা যে আজি,
কাঙালের হরি উঠেছেন রথে অভিনব বেশে সাজি,
একি অঘটন, একি হল আজ, চলে না দেবের রথ!
অজুত ভক্ত টানে রশি ধরি, কর্দমহীন পথ।
জুড়িল হস্তী তবু যে গো রথ তেমনি রহিল থির;
ভাবনা-ব্যাকুল প্রধান পাণ্ডা, ঝরে নয়নের নীর।
ধুলার মাঝারে লুটায়ে পাণ্ডা জানিতে পারিল ধ্যানে—
প্রবল ভক্ত কে-এক রথের পশ্চাৎ দিকে টানে।
যাবৎ না ছোঁয় সমুখের রশি শুচি করতলে তার,
হাজার হস্তী রথের চক্র নড়াতে নারিবে আর।
বাহির হইল পাণ্ডার দল ভক্ত-অন্বেষণে—
কৌপীন-পরা সন্ন্যাসী যত ধরে আনে জনে জনে।
তিলক-ভূষিত নামাবলী-ধারী বৈষ্ণব আনে ধরে,
কাহারো পরশে সে বিরাট রথ এক তিল নাহি নড়ে!
খুঁজিতে খুঁজিতে বহুদূরে আসি প্রধান পাণ্ডা, হায়,
দেখিল খঞ্জ বৃদ্ধা জনেক পুরী অভিমুখে যায়।
হামাগুড়ি দিয়া চলিয়াছে বুড়ি; পাণ্ডা শুধালো তারে—
"এ খর-রৌদ্রে ভিক্ষার লাগি যাইবি কাহার দ্বারে?
তপ্ত বালুতে পুড়িতেছে পথ, আঁখি ভরে গেছে জলে—
দিনু এই সিকি, ফিরে গিয়ে বোস্ ওই অশথের তলে।"
বুড়ি বলে—"বাবা, বল কবে রথ, পয়সাতে কাজ নাই,
রথেতে দেখিব শ্রীমুখ বলিয়া রোদে চলিয়াছি তাই।"
শুনি ব্রাহ্মণ কাঁদিতে কাঁদিতে বৃদ্ধারে বুকে করি
"পেয়েছি, পেয়েছি"—বলিয়া ছুটিল পুরীর সড়ক ধরি।
ব্যাকুল বৃদ্ধা বলে—"দাও ছাড়ি, বাবা গো চাঁড়াল মুই।"
ব্রাহ্মণ বলে—"দে মা পদধূলি, গুরুর গুরু যে তুই।"
চকিতে দেখিল যাত্রীরা সবে,"জয় জয় জয়" বলে—
প্রধান পাণ্ডা আসিল যে সেই খোঁড়া বুড়ি লয়ে কোলে।
অচল সে রথ চলিতে লাগিল, বুড়ি দিল যবে হাত—
উল্লাসে সবে গাহিয়া উঠিল—"ধন্য জগন্নাথ!"
সাশ্রু-নয়নে অজুত ভক্ত গাহিল ভক্তি-গান—
"সত্যই তুমি কাঙালের হরি ভক্তের ভগবান!"
জয় জগন্নাথ 🙏
অসংখ্য ধন্যবাদ
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে.......
ReplyDeleteভালো
ReplyDeleteএই কবিতাটি নিঃসন্দেহে সুন্দর।
ReplyDeleteকিন্তু কবে এই কবিতাটি পঃ বঃ মঃ লিঃ পঃ অন্তর্ভুক্ত ছিল তা জানালেন খুশি হব
আমি 1978 এর মাধ্যমিক। আমাদের সময় ছিল।
Deleteপ্রশ্ন উত্তর
ReplyDeleteDurdanto
ReplyDeleteকবিতাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। এই কবিতা প্রথম কবে প্রকাশিত হয়েছিল একটু বলবেন?
ReplyDelete