অর্থ, কালো টাকা, বিমুদ্রাকরণ

আমার এই প্রবন্ধটি অত্যধিক দীর্ঘ হয়ে পড়ার কারনে আমি এই প্রবন্ধটিকে মূলতঃ কয়েকটি পর্যায়ে বা পরিচ্ছেদে ভাগ করতে বাধ্য হয়েছি। অন্যথায় পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। কারণ অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও আমি এই অত্যন্ত নীরস ও বিশ্লেষণধর্মী বিষয়টিকে সাধারন non-technical পাঠকদের জন্য যথেষ্ট সুখপাঠ্য করে তুলতে পারি নি। পর্যায়গুলি এইরকম :

ক) মুখবন্ধ
খ) নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে "অর্থ" বা "টাকা"-র সংজ্ঞা নির্ণয়
গ) "কালো টাকা"-র প্রকারভেদ ও কারন
ঘ) সাধারণভাবে "ডিমনিটাইজেশন"-এর উদ্দেশ্য ও তার সাফল্য-ব্যর্থতার মানদণ্ড
ঙ) ডিমনিটাইজেশনের পূর্বশর্ত এবং কোন্ কোন্ পরিস্থিতিতে ডিমনিটাইজেশন ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা
চ) ভারতবর্ষে ২০১৬ সালের ডিমনিটাইজেশনের কারন, পরিস্থিতি ও উদ্দেশ্য
ছ) ভবিষ্যতে ভারতবর্ষে পুনরায় ডিমনিটাইজেশন হওয়ার সম্ভাবনা ও তার সম্ভাব্য পূর্বশর্ত
জ) উপসংহার ।


যদিও আমি চেষ্টা করছি যে চিন্তাশীল পাঠকের যেন এটি ভাল লাগে ও তাঁরা কিছু নতুন চিন্তার খোরাক পান, তবু যদি কারো এই লেখার কোনো অংশ একঘেয়ে বা বিরক্তিকর মনে হয় তবে তাঁরা যেন প্রবন্ধের সেই অংশটিকে বাদ দিয়ে পরের অংশে চলে যেতে পারেন, সেই জন্যই প্রবন্ধটিকে নানা পর্যায়ে ভাগ করেছি। একটি জটিল অর্থনীতির বিষয়কে একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছি এবং তা উপস্থাপনা করার চেষ্টা করেছি মাত্র! 


ক) মুখবন্ধ

গত বছরের নভেম্বর মাসে আমাদের ভারত সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত যে আমাদের ভারতীয় অর্থনীতিটিকে আমূল কাঁপিয়ে দিয়েছে তাতে সম্ভবতঃ এই মূহুর্তে আমাদের কারোরই কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যে বিষয়ে জনমানসে যথেষ্ট সন্দেহ আছে তা হল এ-ই যে এই কাঁপন থেকে কি সত্যিই ভারতীয় অর্থনীতির কোন অভূতপূর্ব উন্নতির দিশা পাওয়া সম্ভব, নাকি এই কাঁপন আসলে ভারতীয় অর্থনীতিতে এক প্রলয়ঙ্কর ধ্বসের পূর্বাভাস। 


ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক প্রকাশিত রিপোর্ট এই আশা-আশঙ্কার পেন্ডুলামটির দোলন আবার নতুন করে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং স্বাভাবিক ভাবেই এই মূহুর্তে সেই দোলনের মধ্যে আশঙ্কার প্রকাশই অধিক। "স্বাভাবিক" বললাম কারন একথা তো অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই যে ডি-মনিটাইজেশন নামক ভারত সরকারের এই সহসা ঘোষিত সিদ্ধান্তের যথেষ্ট মূল্য সাধারণ ভারতবাসীকে দিতে হয়েছে তাঁদের হয়রানি, সময়নষ্ট, কর্মচ্যুতি এবং পরোক্ষভাবে প্রায় শতখানেক মানুষের প্রাণের মূল্যে। Moreover, অর্থনীতির জটিল চলন সম্বন্ধে একদম সাধারন মানুষের কোন স্পষ্ট ধারনা নেই, উপরন্তু ভারতবর্ষের মতো অভাগা দেশে, যেখানে বর্তমানে জীবিত কোনো মানুষ কখনো নিজের দেশের কোন অর্থনৈতিক সাফল্যের শরিক হওয়ার সুযোগ জীবনে পাননি, তাঁদের মনে অনাস্বাদিতপূর্ব সাফল্যের আশার চেয়ে চিরপরিচিত ব্যর্থতার আশঙ্কা-ই তো স্বাভাবিক। তার উপর সাধারণ মানুষের আশঙ্কা আরও বেড়ে গিয়েছে কারণ অর্থনীতিতে দুনিয়া-কাঁপানো কিছু পরম শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদও ডিমনিটাইজেশনের ব্যর্থতা নিয়ে তাঁদের আশঙ্কা ব্যক্ত করে রেখেছেন।


এই প্রবন্ধে আমি চেষ্টা করবো একেবারে সাধারনের বোধযোগ্যভাবে এই জটিল বিষয়টিকে একটু দেখার। তার জন্য হয়তো লেখার size বেশ বড় হয়ে পড়বে, তার জন্য আগেই ক্ষমা চাইছি। তবে আশা করি কেউ যদি এই প্রবন্ধটির শেষ পর্য্যন্ত পড়েন, তবে হয়তো টাকা, কালো টাকা ও ডি-মনিটাইজেশন (না, শুধু নোটবন্দী নয়, demonetization in general) সম্বন্ধে এমন কিছু কথা সাধারন বুদ্ধিতেই ভাবতে পারবেন যা তাঁদের এই জটিল বিষয়টা অপেক্ষাকৃত সহজে বুঝতে সাহায্য করবে। আমি শুধু আশা করি আমার এই প্রবন্ধ যেন  আপনাদের সবরকম bias-মুক্ত করে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে।


মূল বিষয়ে ঢোকার আগে একটা শেষ অনুরোধ। আমি জানি যে আপনাদের অনেকের কাছেই হয়তো আমার মতো মার্কামারা মোদী-ভক্ত চাড্ডির যেকোনো কথাই বাতুলতা ও গোবরসদৃশ, কিন্তু দয়া করে যদি আমার এই লেখা পড়েন, তবে মুক্তমনে বিষয়টি নিয়ে please একটু ভাববেন। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যদি ঘৃণাও করেন আমার আপত্তি নেই, কিন্তু এই লেখার বিষয়বস্তুটির সঙ্গে আমার, আপনার, আমাদের সবার দেশের স্বার্থ জড়িত এ কথা যদি দয়া করে মনে রাখেন, তবে বাধিত হব।


খ) নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে "অর্থ" বা "টাকা"-র সংজ্ঞা নির্ণয়

এই পর্যায়ে চলুন আমরা একটু নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝার চেষ্টা করি যে "টাকা বা অর্থ কাকে বলে?" বা "What is money?"


অর্থনীতির বই-এ "টাকা" বা "অর্থ"-এর বিভিন্ন সংজ্ঞা দেওয়া আছে। কিন্তু আমার এই প্রবন্ধে আমি সেইসব বিদগ্ধ ও জ্ঞানগর্ভ definition তুলে ধরব না। বরং এখানে আমরা দেখি আমাদের সাধারন বুদ্ধিতে "অর্থ" মানে কি। আমার মতে, "অর্থ" হল 'মানুষের কায়িক ও বৌদ্ধিক শ্রমের আদানপ্রদানযোগ্য ও উত্তরাধিকারযোগ্য বস্তুভূত এবং/অথবা গণনাযোগ্য রূপ'। ইংরেজীতে বললে  "Money is the materialized and/or countable form of physical or intellectual labour of human beings which is negotiable and inheritable". একটু খটোমটো লাগল কি? তাহলে আরেকটু বিশদে ব্যাখ্যা করি।  


আজ যদি আমি আমার পরিশ্রমের মাধ্যমে কোন বস্তু লাভ করি তবে আমার মত অনুযায়ী সেই বস্তুটি হল আমার সেই শ্রমের ফল যা কিনা অন্য ভাবে বললে বলা যায় আমার শ্রমের materialised form বা বস্তুভূত রূপ। এক্ষেত্রে সেই বস্তুটি বা material টি আমার কাছে "অর্থ"। সেই বস্তু বা অর্থের বিনিময়ে আমি আবার অন্য কারো শ্রমজাত সমমূল্যের কোন বস্তু বা material লাভ করতে পারি, তাই সেই অর্থ হল বিনিময়যোগ্য বা exchangeable বা negotiable.


আবার যদি এমন হয় যে আমি আমার পরিশ্রমের মাধ্যমে কোন জ্ঞান (knowledge) বা কুশলতা (skill) অর্জন করি, তবে আমি ততক্ষণ তাকে আমার "অর্থ" বলতে পারব না যতক্ষণ না পর্য্যন্ত আমি তার বিনিময়ে অন্য কারো শ্রমজাত সমমূল্যের কোন বস্তু লাভ করতে পারছি। তখন আমি আমার সেই কুশলতার (skill) বিনিময়ে পাওয়া বস্তুটিকে আমার অর্জিত "অর্থ" বলতে পারব। যদিও এইক্ষেত্রে বস্তুটি আমার নিজের পরিশ্রমের দ্বারা উৎপাদিত বা আহরিত নয় তবুও যেহেতু তা আমি পেয়েছি আমারই পরিশ্রম দ্বারা অর্জিত সমমূল্যের জ্ঞান বা কুশলতার বিনিময়ে তাই তা-ও আমারই শ্রমের বস্তুভূত রূপ। 


কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রেই আমার এই "অর্থ" সঠিকভাবে গণনাযোগ্য বা countable নয়। তাই এর মূল্যমানের সঠিক evaluation সম্ভব নয়। যেকোনো বস্তুর মূল্যমানের সঠিক নির্ণায়নের বা evaluation এর প্রয়োজনে এবং বিনিময়যোগ্যতার (negotiability র) বাড়তি দক্ষতা (efficiency) অর্জনের লক্ষ্যেই মানুষ আবিষ্কার করেছে একপ্রকার প্রতীকী মূল্যমানযুক্ত মাধ্যমের যাকে আমরা currency বা মুদ্রা বলি। যেকোন বস্তু বা কর্মের মূল্যকে এই মুদ্রা বা কারেন্সীর এককের গুনিতক হিসাবে প্রকাশ করে আমরা তার সঠিক মূল্যমান নির্ধারণ করতে পারি। তাই আমাদের একথা মনে রাখতে হবে যে যদিও মুদ্রা হল অর্থের সেই অংশ যা নির্দিষ্টভাবে গণনাযোগ্য (currency is the countable form of money), অর্থাৎ যদিও "মুদ্রা" মানেই "অর্থ", কিন্তু তাই বলে "অর্থ" মানেই "মুদ্রা" নয়।


অর্থাৎ সহজভাবে বললে বলা যায় যে আজ যে কোনো মানুষের অধিকারে ঠিক ততো পরিমান অর্থ সঞ্চিত আছে যা তার নিজের বা তার পূর্বপুরুষের মোট শ্রমজাত বস্তু (material), জ্ঞান (knowledge) ও কুশলতার (skill) থেকে তার এবং তার পূর্বপুরুষের ইতিপূর্বেই ভোগ করা অন্য লোকের শ্রমজাত মোট জ্ঞান ও কুশলতার বিয়োগফলের সমান।


অর্থাৎ "অর্থ" শুধু মুদ্রা নয়। অধিকারে থাকা বস্তুও "অর্থ"ই। "অর্থ"-এর এই সংজ্ঞা দিয়ে বিচার করলে আমাদের এই প্রবন্ধের পরবর্তী অংশগুলো বুঝতে হয়তো একটু বাড়তি সুবিধা হবে বলে আমার মনে হয়েছে আর তাই আমি এই বিষয়ে এতটা elaboration করলাম। বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদ যদি কেউ আমার এই প্রবন্ধ পাঠ করেন তবে আমার এই ধৃষ্টতা নিজগুণে মার্জনা করবেন এবং কোথাও তা ভুল মনে হলে আমাকে তা ধরিয়ে দিয়ে সাহায্য করবেন যদিও আশা করি আমার এই সংজ্ঞাকে বোধহয় কেউই ভুল বলতে পারবেন না।


গ) "কালো টাকা"-র প্রকারভেদ ও কারন

এই পর্যায়ে চলুন দেখা যাক্ কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে কোন্ কোন্ ধরনের উপার্জিত অর্থকে আমরা "কালো টাকা" বলতে পারি আর কখন তা বলা উচিত নয়।


১. কালো পথে উপার্জিত টাকা

এই লেখার উপরের অংশে আমি অর্থকে যেভাবে define করেছি সেই নিরিখে দেখতে গেলে যে কোন রকম টাকাই আসলে শ্রমের বস্তুভূত রূপ। কিন্তু এইখানেই যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে তাহলে যদি কেউ চুরি বা ডাকাতির মত অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করেন ও সঞ্চয় করেন, সেক্ষেত্রেও কি বলা যাবে যে সেই অর্থ তাঁর শ্রমের ফসল? আমার উত্তর হল, "হ্যাঁ, এমনকি সেই অসদুপায়ে অর্জিত অর্থও তাঁর শ্রমেরই ফসল", যদিও এক্ষেত্রে তিনি তাঁর সেই শ্রম দিয়েছেন সমাজবর্জিত ও অসৎ পথে, কিন্তু সেটা আলাদা issue। প্রমানিত হলে সেজন্য সমাজ তাঁর শাস্তিবিধান করতে পারে, কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে তাঁর অর্জিত অর্থ তাঁরই শ্রমের বস্তুভূত রূপ, যে শ্রম তিনি কায়িক ও বৌদ্ধিক ভাবে ব্যয় করেছেন তাঁর সেই চুরি বা ডাকাতির মতো সমাজগর্হিত কাজটি করবার সময়ে। 


তাই এই সব ক্ষেত্রকে আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য সমাজ এই সমস্ত চুরি, ডাকাতি, ঘুষখোরী, কালোবাজারী ও অন্যান্য এই প্রকার সমাজগর্হিত কাজগুলিকে দাগিয়ে দেয় "কালো কাজ" হিসাবে, এবং এই ধরনের কালো কাজের মাধ্যমে উপার্জিত টাকাকে "কালো টাকা" হিসাবে। এখানে "কালো" শব্দটিকে অসাধুতার প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হয়।


যদিও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ অর্থনীতির জটিলতার মধ্যে না ঢুকে মূলতঃএই ধরনের কালো কাজের মাধ্যমে উপার্জিত টাকাকেই "কালো টাকা" হিসাবে মনে করেন কিন্তু বাস্তবে "কালো টাকা" বলতে শুধুমাত্র এই এক ধরনের টাকাকেই বোঝায় না। বাস্তবে আরো একপ্রকারের অর্থ আছে যাকে "কালো টাকা" বলা হয়। 


সেই দ্বিতীয়রকম "কালো টাকা"র কথা বলার আগে বলে নিই এক তৃতীয় ধরনের টাকার কথা যাকে যদিও বেশীরভাগ সাধারণ মানুষ "কালো টাকা" মনে করেন কিন্তু আসলে যা আদৌ "কালো টাকা" নয়। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বলি? মনে করুন, একজন পুঁজিপতি যিনি কেবলমাত্র তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পুঁজির জোরে একটি কারখানা গড়েছেন এবং নিজে ব্যক্তিগতভাবে একটুও শ্রম তার পিছনে না দিয়ে শুধু মাইনে দিয়ে রাখা ম্যানেজারদের মাধ্যমে সেই কারখানায় যৎসামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দরিদ্র শ্রমিকদের appoint করেছেন এবং তাদের শ্রমজাত উৎপাদনকে আত্মসাৎ করে অর্থ সঞ্চয় করছেন। সাধারণ আবেগ দিয়ে চিন্তা করলে সেই উৎপাদন একান্তভাবেই কারখানার শ্রমিকদের শ্রমের ফসল আর তাই, আমারই আগের পরিচ্ছেদে দেওয়া definition অনুসারে সেই উৎপাদিত বস্তু বা অর্থ আপাতদৃষ্টিতে সুনিশ্চিতভাবেই শ্রমদানকারী শ্রমিকদের প্রাপ্য হওয়া উচিত বলে মনে হতে পারে কারণ তার মধ্যে কারখানা-মালিক সেই পুঁজিপতির কোন ব্যক্তিগত শ্রম নিহিত নেই। যদি বা আর একটু detail এ চিন্তা করে কারখানার ম্যানেজারদের পরোক্ষ শ্রমকে স্বীকারও করে নেওয়া যায় এবং কারখানার সেই উৎপাদন বা অর্জিত অর্থের উপর ম্যানেজারদেরও সীমিত দাবী স্বীকার করা যায়, কিন্তু কারখানা মালিকের কোনো দাবীই তার উপর থাকতে পারে না বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে। 



অথচ বাস্তবে দেখা যায় সেই লভ্য অর্থের সিংহভাগই পুঁজিপতি কারখানা মালিকের কুক্ষিগত হয়। এক্ষেত্রে কারো যদি এই কথা মনে হয় যে, অনৈতিকভাবে প্রকৃত শ্রমদানকারীকে বঞ্চিত করে উৎপাদিত বস্তু বা অর্থ হস্তগত করাটা সেই পুঁজিপতি কারখানা মালিকের দিক থেকে এক ধরনের চুরিই, আর এই ভাবে সঞ্চিত বিপুল পরিমান অর্থও তাই সেই পুঁজিপতির "কালো টাকা", তবে আমি স্বীকার করছি যে সেই মনে হওয়া আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত স্বাভাবিক। 


কিন্তু আমরা সবাই জানি যে অর্থনীতির গতি একটু জটিল। তাই যতই অস্বস্তিকর মনে হোক, এই কথাটা সকলের আগে আমাদের বোঝা দরকার যে এই উদাহরণে উল্লিখিত পুঁজিপতি কারখানা মালিকের অর্জিত মুনাফাকে আমরা ততক্ষণ "কালো টাকা" মনে করতে পারি না যতক্ষণ পর্যন্ত না এমন কোন প্রমান পাওয়া যায় যে সে সেই উপার্জনের জন্য কোন বে-আইনি পথ অবলম্বন করেছে। শুধুমাত্র মালিকের কোন ব্যক্তিগত শ্রম সেই উৎপাদনের পিছনে নেই বলে কারখানার উৎপাদিত বস্তু বা অর্থের উপর মালিকের কোন দাবী নেই, একথা মোটেই ঠিক নয়। বরং শ্রমিকই যেই মূহুর্তে তার শ্রমের বিনিময়ে স্বেচ্ছায় পারিশ্রমিক নেয়, সেই মূহুর্তে কারখানায় দেওয়া তার শ্রম সেই মজুরির অর্থে মূল্যলাভ করে বস্তুভূত হয় আর তখনই সে তার নিজের শ্রমজাত উৎপাদিত বস্তুটির উপর তার অধিকার হারায়। On the other hand, উল্লিখিত পুঁজিপতি কারখানার মালিক যদিও তাঁর কারখানায় নিজে কোনপ্রকার শ্রম দেন নি, কিন্তু তাঁর বিনিয়োগ করা মূলধন, যা দিয়ে তিনি কারখানাটিকে গড়ে তুলেছেন এবং শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন দিয়েছেন, তা যেহেতু তাঁর নিজের ও বংশপরম্পরায় সঞ্চিত শ্রমের বস্তুভূত রূপ, তাই উৎপাদনের পিছনে থাকা প্রত্যেক শ্রমিক ও কর্মচারীদের তাদের শ্রমের মূল্যস্বরূপ বেতন মিটিয়ে দেওয়ার পর উৎপাদিত বস্তু বা অর্থের পড়ে থাকা অবশিষ্টাংশ লভ্যাংশ বা profit হিসাবে কারখানা মালিকেরই ন্যায্য অধিকার। বস্তুতঃ এই profitই হল কারখানা মালিকের ন্যায্য উপার্জন। তাই সেই অর্থ বা মুনাফাকে কখনোই "কালো" বা অবৈধ বলা চলে না।


যদিও আমার প্রবন্ধের মূল বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই তবু এই প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার করে নেওয়া ভাল। প্রথম প্রশ্নটি হল, "শ্রমের মূল্য কি ব্যক্তি বিশেষে বিভিন্ন হতে পারে?" অর্থাৎ "একজন শ্রমিকের এক ঘন্টা শ্রমের মূল্যের চেয়ে একজন ম্যানেজারের বা একজন কারখানা মালিকের সমান সময়ের শ্রমের মূল্য কি বেশী হতে পারে?" উত্তর যদি হয় "পারে", তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন হল "কীভাবে বা কোন যুক্তিতে পারে, যেখানে দুইজনেই মানুষ হিসেবে সমান আর আমরা ভালভাবেই জানি যে সমান সময়ে দেওয়া হলেও বাস্তবে শ্রমিকের দেওয়া কায়িক শ্রম অধিক ক্লান্তিকর?" 



এই প্রশ্নের উত্তরে হল, যদিও এখনো পর্য্যন্ত মানবসভ্যতায় শ্রমের সঠিক মূল্যায়নের completely flawless & unbiased কোন একটি বিশেষ পন্থা আবিষ্কৃত হয় নি, তবু overall দেখতে গেলে যেহেতু একজন ম্যানেজারের ম্যানেজার হয়ে ওঠার পেছনে তার ছাত্রজীবনের ব্যক্তিগত শ্রম ও তাছাড়া অনেকক্ষেত্রে তার নিজের ও নিজের পরিবারের বিনিয়োগকৃত অর্থ (অর্থাৎ বস্তুভূত শ্রম) জড়িয়ে আছে ( যা আবার কারখানা মালিকের ক্ষেত্রে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ), যা কিনা একজন কায়িক শ্রমিকের 'শ্রমিক' হয়ে ওঠার পিছনে নেই বা কম আছে (অবশ্যই এর ব্যতিক্রমও আছে), তাই কর্মক্ষেত্রে যখন সেই ম্যানেজারের বা মালিকের শ্রমের মূল্যায়ন হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সাধারণত তা একজন শ্রমিকের সম সময়ের শ্রমের চেয়ে অধিক মূল্যবান নির্ধারিত হয়।


বুঝতে বা মানতে যদি কারো খুব অসুবিধা হয় তবে আরো সহজ উদাহরণ দিয়ে বলি। আমার মতো একজন সামান্য মানুষের অর্থনীতি বিষয়ক একটি প্রবন্ধের একটি পরিচ্ছেদের চেয়ে যে কারনে প্রণম্য অর্থনীতিবিদ শ্রী অমর্ত্য সেন মহাশয়ের যে কোন প্রবন্ধের সমান মাপের পরিচ্ছেদের মূল্য বহুগুণ বেশী, ঠিক একই কারনে একজন অকুশল অর্থাৎ unskilled (আমাদের দেশে অনেকসময় অশিক্ষিতও) শ্রমিকের শ্রমের চেয়ে একজন সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত ম্যানেজার বা সুকৌশলী (ও অনেকসময় সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষিতও বটে) কারখানা মালিকের সমপরিমান শ্রমের মূল্যও বেশী। যাই হোক, এই কথা ছেড়ে প্রবন্ধের মূল বিষয়ে ফিরি।



২. সাদা পথে উপার্জন করেও করফাঁকির উদ্দেশ্যে গোপন করা টাকা

যে তৃতীয় ধরনের টাকাকে বেশীরভাগ সাধারণ মানুষ কালো টাকা মনে করলেও আসলে যা কালো টাকা নয় তার কথা তো আলোচনা করলাম। কিন্তু এখনো তো সেই দ্বিতীয় প্রকারের কালো টাকার কথাই বলা হয় নি। হ্যাঁ, কালো কাজের মাধ্যমে উপার্জিত টাকা ছাড়াও আরো এক ধরনের টাকা আছে যা কিনা কালো টাকা হিসাবে চিহ্নিত হয়। 



যদি কোন ব্যক্তি এমনকি সৎ ও আইনানুগ পথেও কোন অর্থ উপার্জন করেন কিন্তু সেই উপার্জনকে বা তার কোন অংশকে সমাজের (এবং সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের) কাছ থেকে গোপন করেন কেবলমাত্র আয়কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে, তবে সেই গোপন করে যাওয়া উপার্জন বা তার গোপন করা অংশের টাকাকেও তাঁর উপার্জিত "কালো টাকা" হিসাবে গণ্য করা হয়। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক কোন ব্যবসায়ী বা কোন স্বাধীন পেশাদার ব্যক্তি, যাঁর উপার্জনের কোন বাঁধাধরা নিয়ম বা fixed amount নেই, অথবা কোন চাকুরিজীবি ব্যক্তি, যাঁর বেতনের পূর্বনির্দিষ্ট পরিমান সরকারের জানা নেই, যদি বাস্তবে কোন বছর ৫০ লক্ষ টাকা উপার্জন করা সত্ত্বেও, সরকারের আয়কর দফতরের কাছে নিজের আয়ের হিসাব ঘোষনা করতে গিয়ে মিথ্যা বলেন ও দেয় করের অঙ্ক কমানোর উদ্দেশ্যে দাবি করেন যে তাঁর সেই বছরের মোট উপার্জন ২০ লক্ষ টাকা, তবে, এমনকি তাঁর উপার্জনের উৎস সম্পূর্ণ বৈধ ও আইনসঙ্গত হলেও, তাঁর উপার্জিত অর্থের যে অংশ বা পরিমানটি তিনি গোপন করেছেন, সেই ৩০ লক্ষ টাকা তাঁর সেই বছরের উপার্জিত "কালো টাকা" বলে গণ্য করা হবে। এইভাবে বছরের পর বছর চলতে চলতে তাঁর কাছে যে মোট সম্পদ বা সঞ্চয় গড়ে উঠবে তার মধ্যে সাদা বা বৈধ টাকার পাশাপাশি অংশ হিসাবে মিশে থাকবে তাঁর উপার্জিত "কালো টাকা"ও। পরবর্তীকালে এই ধরনের সম্পদের মধ্যে থেকেই "কালো টাকা"র অংশকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সবচেয়ে দুরূহ, আর সেই কারনেই "কালো টাকা"র মালিকদের মধ্যে এই বিশেষ প্রকারের "কালো টাকা" সঞ্চয় করবার প্রবণতাই সর্বাধিক।



অর্থাৎ লেখার এই পর্যায়ে এসে আমার observation হল : "কালো টাকা" মূলতঃ দুই প্রকার। প্রথমতঃ "সেই টাকা যার উপার্জনের মাধ্যম বা উপায়টি অসাধু, অবৈধ ও সমাজগর্হিত", আর দ্বিতীয়তঃ "বৈধ উপার্জনের সেই অংশের টাকা যা কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে সরকারের আয়কর দফতরে হিসাব দাখিল করতে গিয়ে গোপন করার মাধ্যমে অস্বীকার করা হয়েছে"। অর্থাৎ কোন টাকা বা অর্থের সাদা-কালো তার বাহ্যিক রূপের বা মুদ্রার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং তা নির্ভরশীল তার মালিক বা ব্যবহারকারীর উপার্জনের source এবং তার undisclosed nature এর উপর। একই মুদ্রা তার তাৎক্ষণিক মালিকের উপর নির্ভর করে হাতবদলের সাথে সাথে কখনো সাদা থেকে কালো আবার কখনো কালো থেকে সাদা হতে থাকে।



এই পর্যায়ে বলে রাখা ভাল যে সাধারণত মনে করা হয় যে উপরোক্ত প্রথম প্রকারের "কালো টাকা" বেশীরভাগ সময় সঞ্চিত হয় নগদ মুদ্রা বা cash হিসাবে যাতে বেশী কেউ তার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত হয়ে না পড়ে বা তার উৎস সম্পর্কে কৌতুহলী না হয়ে পড়ে। সাধারণভাবে এই প্রকারের "কালো টাকা"র মালিকেরা সর্বদাই সচেতন থাকেন যে তার উৎসটি অবৈধ। আর উপরোক্ত দ্বিতীয় প্রকারের "কালো টাকা" সাধারণত কিছুটা নগদ মুদ্রা বা cash হিসাবে আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে cash এ গোপনে ক্রয় করা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি হিসাবেই সঞ্চিত হয়। সঞ্চিত "কালো টাকা"কে সজ্ঞানে নিজের বৈধ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা রাখার প্রবণতা যে স্বাভাবিক বা expected নয়, সে কথা আশা করি যে কেউই মানবেন।



ঘ) সাধারণভাবে "ডিমনিটাইজেশন"-এর উদ্দেশ্য ও তার সাফল্য-ব্যর্থতার মানদণ্ড


এর আগেই অর্থের definition নির্ণয় করতে গিয়ে আমরা আলোচনা করেছি যে মুদ্রা বা currency হল একপ্রকার প্রতীকী মূল্যমানযুক্ত মাধ্যম যা কিনা মানুষ আবিষ্কার করেছে কোন বস্তুর মূল্যমানের সঠিক নির্ণায়নের প্রয়োজনে এবং বিনিময়যোগ্যতার বাড়তি দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে। তাই এ কথা বুঝতে কষ্ট হওয়া উচিত নয় যে, যদি কখনো কোন মুদ্রার বস্তুগত মূল্যমান অর্থাৎ তার material value তার সমাজ বা সরকার নির্দিষ্ট মূল্যমানের চেয়ে অধিক হয়ে পড়ে তবে সেক্ষেত্রে যে কোনো ব্যক্তি তাঁর অধিকারে থাকা সেই মুদ্রাটিকে তার সরকার নির্দিষ্ট মূল্যমানে একটি মুদ্রা হিসাবে বিনিময় না করে বরং স্বাভাবিকভাবেই চাইবে তাকে একটি বস্তু হিসাবে গণ্য করে তার অধিক মান সম্পন্ন বস্তুমূল্যে বিনিময় করতে। সুতরাং যে কোন মুদ্রার প্রতীকি মূল্যমান অবশ্যই তার বস্তুগত মূল্যমানের চেয়ে অধিক হওয়া আবশ্যক কারন অন্যথায় তা মুদ্রা হিসাবে অচল হয়ে পড়বে। ধরুন এক টাকার একটি মুদ্রা যদি সোনার বা রূপোর হয়, তবে তার বিনিময়মূল্য যতই এক টাকা হোক না কেন, মুদ্রার owner তাকে এক টাকা হিসেবে treat না করে একটি much more valuable স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রা হিসেবেই ব্যবহার করবে যার বস্তুমূল্য বা material value তার সরকারনির্দিষ্ট বিনিময়মূল্য এক টাকার থেকে বহু বেশী। এবং এই কারণেই currency note গুলি কাগজের মতো সস্তা জিনিসের তৈরি হয়। এই সাধারণ সত্যের মধ্যেই নিহিত আছে বিমুদ্রাকরণের বা ডিমনিটাইজেশনের বীজ।



যেহেতু কোন সামান্য মূল্যের বস্তুকে মুদ্রা বা currency হিসাবে পরিচিতি দেওয়ার উদ্দেশ্যে সমাজ, বা তার প্রতিভূরূপে সরকার, সেই বস্তুর উপর নিজস্ব প্রতীকচিহ্ন ছেপে তাকে একটি মুদ্রা হিসাবে বর্ধিত মূল্যমান প্রদান করে, তাই কিছু বিশেষ বিশেষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাজনক পরিস্থিতিতে সরকারের অধিকার থাকে সেই সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে কোন মুদ্রার বর্ধিত প্রতীকীমূল্যকে পূর্বঘোষনার মাধ্যমে নাকচ করে দেওয়ার, যার ফলশ্রুতি হিসাবে সেই মুদ্রাটি তার বিশেষ প্রতীকী মূল্য হারিয়ে কেবলমাত্র তার বস্তুমূল্য প্রাপ্ত হয়। তখন আর মুদ্রা হিসাবে তার মর্যাদা সমাজস্বীকৃত থাকে না। অর্থাৎ কাগজের তৈরি টাকা আর টাকা থাকে না, plain কাগজ হয়ে যায়। কোন মুদ্রার প্রতীকমূল্য নাকচ করে তাকে তার বস্তুমূল্যে ফিরিয়ে আনার এই প্রক্রিয়ার নামই হল বিমুদ্রাকরণ বা demonetization. সাধারণত কেবলমাত্র রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় ছাড়া সম্পূর্ণ ডিমনিটাইজেশন করা হয় না, বরং জনসাধারনকে একটা সময়সীমা দেওয়া হয় যার মধ্যে তাঁরা তাঁদের হাতে থাকা পুরোনো ডিমনিটাইজড্ বাতিল মুদ্রার বিনিময়ে সমমূল্যের নতুন মুদ্রা পাল্টে নিতে পারেন।



কিন্তু এখানে প্রশ্ন ওঠে যে কি সেই বিশেষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ও পরিস্থিতি যখন সরকার  ডিমনিটাইজেশনের প্রয়োজন অনুভব করে? এবার আমরা সেইপ্রকার কিছু কাল্পনিক বা সম্ভাব্য পরিস্থিতি আলোচনা করব আর দেখব যে ডিমনিটাইজেশনের মাধ্যমে সেইসব সমস্যার সমাধান আদৌ হয়েছে কিনা বা কতদূর হয়েছে তা বোঝার মানদণ্ড কি।



১. "নকল মুদ্রা" সমস্যার সমাধান 

যেহেতু এ কথা জানা যে মুদ্রার বস্তুমূল্য সাধারণত তার সরকার নির্দিষ্ট প্রতীকীমূল্যের তুলনায় খুবই সামান্য হয়, তাই অনেকসময় কিছু অসাধু ব্যক্তি সেই সামান্য মূল্যের বস্তু ব্যবহার ক'রে ও তার উপর নকল প্রতীকচিহ্ন print করে নকল মুদ্রা প্রস্তুত করে ও সেই নকল মুদ্রাকে আসল মুদ্রার প্রতীকীমূল্যে বিনিময় ক'রে অসৎ উপার্জনে প্রবৃত্ত হয়। এখন, যেহেতু সরকার থেকে আসল মুদ্রা প্রস্তুত করার সময় দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ঠিক ততো পরিমাণেরই মুদ্রা প্রচলন করা হয় যাতে সামাজিক ভারসাম্য বজায় থাকে, এবং যেহেতু সরকারের ঘরে প্রায় সঠিক হিসাব রাখা হয় যে কোনো বিশেষ সময়ে ঠিক কত পরিমান নগদ মুদ্রা তারা বাজারে ছেড়ে রেখেছে, তাই যদি উল্লেখযোগ্য পরিমানে নকল মুদ্রা বাজারে ব্যবহার হতে থাকে যার হিসাব সরকারের কাছে থাকা সম্ভব নয়, তবে সেই নকল মুদ্রার যোগান বাজারের তথা সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিতে থাকে যার ফলশ্রুতিতে মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া হয়ে উঠবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই রকম সময়ে ডিমনিটাইজেশনের মাধ্যমে সরকার নকল মুদ্রার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হতে পারে। 


যেহেতু বিমুদ্রাকরণের মাধ্যমে আসল নকল সব মুদ্রা-ই তাদের প্রতীকীমূল্য হারিয়ে বস্তুমূল্যে নেমে আসে আর যেহেতু ব্যাঙ্ক থেকে বিমুদ্রাকৃত পুরোনো মুদ্রার বদলে নতুন মুদ্রা নিতে গেলে অথবা বিমুদ্রাকৃত পুরোনো মুদ্রা ব্যাঙ্কের খাতায় জমা দিতে গেলে অভিজ্ঞ ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের সতর্ক দৃষ্টিতে আসল ও নকল মুদ্রার ফারাক ধরা পড়ে যায়, তাই এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আশা করা হয় যে শুধুমাত্র পুরোনো আসল মুদ্রাগুলিই তাদের প্রতীকীমূল্য ধরে রাখতে পারবে ব্যাঙ্কে জমা করা বা পাল্টে নেওয়ার মাধ্যমে। আর নকল মুদ্রাগুলি যেহেতু পাল্টানো বা জমা করা যাবে না তাই তারা মূল্যহীন হয়ে পড়বে। এই ভাবে ডিমনিটাইজেশনের মধ্যে দিয়ে সমাজ ও অর্থনীতি নকল মুদ্রার কুফল মুক্ত হয়। এই ভাবে নকল মুদ্রার সমস্যা সমাধান করা হল ডিমনিটাইজেশনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।



কোন বিশেষ একটি সময়ে ডিমনিটাইজেশনের মাধ্যমে নকল মুদ্রার সমস্যা কতদূর সমাধান করা গেছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করবার কোন মানদণ্ড নেই। অনেকে যদিও মনে করেন যে ডিমনিটাইজেশনের পর যখন সাধারন মানুষ তাদের হাতে থাকা ডিমনিটাইজড্ পুরোনো মুদ্রা ব্যাঙ্কে জমা করতে বা বদলাতে নিয়ে আসেন, তখন ঠিক কত পরিমান নকল মুদ্রা ব্যাঙ্কের দ্বারা চিহ্নিত ও বাজেয়াপ্ত হল, সেই অঙ্কটিকে ডিমনিটাইজেশনের সাফল্য বা ব্যর্থতার মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ, তখনই কোন ব্যক্তি নকল মুদ্রা নিয়ে ব্যাঙ্কে জমা করতে বা পাল্টাতে আসেন যখন হয় তাঁর নিজের জানা থাকে না যে তাঁর অধিকারে থাকা মুদ্রাটি নকল অথবা যদি তাঁর মনে ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের দক্ষতার প্রতি অবজ্ঞাভাব থাকে আর আশা থাকে যে তাঁরা নকল মুদ্রাটি বা নকল মুদ্রাগুলি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হবেন। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় কোন ব্যক্তি যদি সচেতনভাবে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে নকল মুদ্রাকে আসল বলে চালাতে চেষ্টা করেন তবে একথা মোটেই expected নয় যে তিনি সেই মুদ্রা ব্যাঙ্কে নিয়ে আসবেন। এই কারনে ডিমনিটাইজেশনের ফলে যদিও পুরোনো সব নকল মুদ্রা তাদের বর্ধিত প্রতীকীমূল্য হারিয়ে ফেলে এবং তার ফলে দেশের অর্থনীতি উপকৃত হয় কিন্তু সেই নকল টাকার মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই অতি অল্প অংশ ব্যাঙ্কের হাতে ধরা পড়ে।



২. নগদ "কালো টাকা"-র বিলুপ্তিকরণ


যে কোন মুদ্রার প্রতীকীমূল্য ও বস্তুমূল্যের মধ্যে পার্থক্যের কারন যেহেতু সরকারকৃত অঙ্গীকারের দ্বারা সুরক্ষিত, সুতরাং, সাদা-কালো নির্বিশেষে যে কোন নগদ মুদ্রাই আসলে সরকারের দায় চিহ্নিত করে। তাই বিমুদ্রাকরণের মাধ্যমে সরকার যখন তার সেই দায় অস্বীকার করে, তখন নিশ্চিতরূপেই সরকারের সেই দায় কমে যায়। আবার যখনই সরকার ব্যাঙ্কের মাধ্যমে পুরোনো মূল্য হারানো ডিমনিটাইজড্ মুদ্রার বিনিময়ে নতুন মুদ্রা বন্টন করেন, তখনই সেই নতুন মুদ্রার মাধ্যমে সরকারের দায় আবার ফিরে আসে। যেহেতু মুদ্রা প্রস্তুত ও বন্টন সরকারের দ্বারাই সংঘটিত হয় তাই সরকারের ঘরে প্রায় সঠিক হিসাব রাখা হয় যে কোনো বিশেষ সময়ে ঠিক কত পরিমান নগদ মুদ্রা তারা বাজারে ছেড়ে রেখেছে। ডিমনিটাইজেশনের পর যদি দেখা যায় যে সেই বাজারে ছেড়ে রাখা বাতিল মুদ্রার উল্লেখযোগ্য অংশ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সরকারের ঘরে ফিরে আসে নি ( হয় বিনিময়ে সমমূল্যের নতুন মুদ্রার বিনিময়ে বা ব্যাঙ্কের খাতায় জমা করার মাধ্যমে ), তবে সেই ফিরে না আসা মূল্যাঙ্ককে (amount of money কে) সরকারের দায়হ্রাস বলে মনে করা হয় যদিও দেশের মোট অর্থনীতির আয়তনও একই সঙ্গে সমপরিমানে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। তবুও যেহেতু দায়হ্রাস মানেই লাভ, আর গনতন্ত্রে সরকারের লাভ মানেই জনগনের লাভ, তাই মোট কত পরিমান বাতিল মুদ্রা ফেরত এল না সেটা হিসাব করে সেই অঙ্ককে ডিমনিটাইজেশনের সাফল্যের অন্যতম মাপকাঠি হিসাবে গণ্য বা consider করা হয়।



উপরের "গ" পরিচ্ছেদে, কালো টাকার প্রকার আলোচনা করতে গিয়ে আমরা জেনেছি যে কালো টাকার প্রথম প্রকারটি হল "কালো বা অবৈধ কাজের মাধ্যমে উপার্জিত টাকা"। যেহেতু সমাজব্যবস্থায় এই ধরনের কালো বা অবৈধ কাজ আইনতঃ দণ্ডনীয়, আর সাধারণত দণ্ডের ভয় অর্থের লোভের চেয়ে বেশী, তাই আশা করা হয় যে ডিমনিটাইজেশন করা হলে এই প্রথম প্রকারের কালো টাকার মালিকেরা তাদের হেফাজতে থাকা টাকা ব্যাঙ্কে বদল করতে আসতে সাহস পাবে না। অর্থলোভে, বা বলা ভাল, অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের সঞ্চিত অংশ রক্ষা করতে গিয়ে, টাকা বদল করতে এসে যদি তার উৎসের খোঁজ পড়ে আর কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বার হয়, তবে সেই অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ তো বাজেয়াপ্ত হবেই, উপরোন্তু কঠোর শাস্তির সম্ভাবনা, সেই ভয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আশা করা হয় যে এই প্রথম প্রকারের কালো টাকার নগদ সঞ্চয় ডিমনিটাইজড্ হলে বেশীরভাগই আর অর্থনীতিতে ফিরে আসে না বরং তাদের মালিকেরা শাস্তির ভয়ে অর্থের মায়া পরিত্যাগ করে সেইপ্রকার ডিমনিটাইজড্ কালো টাকার নগদ সঞ্চয়কে গোপনে নষ্ট করে দেওয়া অধিক লাভজনক মনে করেন।



৩. "কালো টাকা"-র চিহ্নিতকরণ ও কালো অর্থনীতির হাত থেকে সমাজমুক্তি


উপরের "গ" পরিচ্ছেদে আমরা যে দ্বিতীয় প্রকারের "কালো টাকা"র কথা আলোচনা করেছি তা হল সেই সাদা পথে উপার্জিত কিন্তু করফাঁকির উদ্দেশ্যে গোপন করা টাকা। যদিও এই প্রকারের "কালো টাকা" সাধারণত কিছুটা নগদ মুদ্রা বা cash হিসাবে আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে নগদ মুদ্রার দ্বারা অর্থাৎ cash এ গোপনে ক্রয় করা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি হিসাবেই সঞ্চিত হয়, তবে যেহেতু করের অঙ্ক সাধারণত মোট উপার্জিত রাশির চেয়ে কম হয় ( করের হার যেহেতু ১০০% এর কম ), তাই বিমুদ্রাকরণের পর সাধারণত এই দ্বিতীয় প্রকারের কালো টাকার মালিকেরা তাঁদের হেফাজতে থাকা নগদ টাকা (ডিমনিটাইজড্ currency তে) নষ্ট করে না দিয়ে তা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে পাল্টে নিতে বা ব্যাঙ্কের নিজেদের খাতায় বা বেনামি খাতায় জমা করতে সচেষ্ট হন। এভাবে যদিও সম্ভাবনা থাকে কর দফতরের হাতে ধরা পড়ার এবং জরিমানা সহ কর দিতে বাধ্য হওয়ার, তবু "আপৎকালে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যাজতি পণ্ডিতঃ", এই আপ্তবাক্য অনুসরন করে অধিকাংশ দ্বিতীয় প্রকারের কালো টাকার মালিকদের হাতে ডিমনিটাইজড্ currency তে থাকা নগদ টাকা ব্যাঙ্কের ঘরে জমা পড়ে।



তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেখানে প্রথম প্রকারের কালো টাকার মালিকদের মনে সরকারের কর দফতর ও এনফোর্সমেন্ট দফতরের কর্মীদের দক্ষতা বা সততার প্রতি নিচু ধারনা থাকে, সেখানে তাঁরা অর্থাৎ প্রথম প্রকারের কালো টাকার মালিকেরাও মনে করেন যে তাঁদের কুকীর্তি ও অসততার নাগাল পাওয়া উক্ত দুই দফতরের কর্মীদের দক্ষতায় কুলোবে না, অথবা উৎকোচ বা রাজনৈতিক প্রভাব বা ভয়প্রদর্শনের মাধ্যমে তাঁরা সেইসব কর্মীদের মুখ বন্ধ করতে পারবেন, সেখানে সেই সব প্রথম প্রকারের কালো টাকার মালিকেরাও তাঁদের কালো টাকা বেপরোয়া ভাবে ব্যাঙ্কের ঘরে জমা করার মধ্যে দিয়ে রক্ষা করতে সচেষ্ট হন।



ব্যাঙ্কে জমা পড়া বিপুল অঙ্কের টাকার মধ্যে থেকে এই জমা পড়া কালো টাকাকে চিহ্নিত করা ও তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব তখন এসে পড়ে কর দফতরের কর্মীদের উপর (বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পুলিশ ও এনফোর্সমেন্ট দফতরের সহায়তায়)।



যেহেতু প্রথম প্রকারের কালো টাকার উৎসই অবৈধ, তাই এই সব অসৎ উপায়ে অর্জিত কালো টাকার identification, এই প্রকারের অবৈধ, অসৎ ও কালো কাজের প্রতি মানুষের বিকর্ষন গড়ে তোলা, এবং যেহেতু দ্বিতীয় প্রকারের কালো টাকার মূল সমস্যা হল করসংক্রান্ত, তাই সেই প্রকারের কালো টাকার identification ও তার ভিত্তিতে জরিমানাসহ কর আদায় করার মাধ্যমে কালো টাকার অভিশাপের হাত থেকে সমাজ ও অর্থনীতির মুক্তি হল ডিমনিটাইজেশনের তৃতীয় ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। 


এই উদ্দেশ্যে ডিমনিটাইজেশন কতটা সফল বা আদৌ সফল কিনা তা বোঝার মানদণ্ড হল ডিমনিটাইজেশনের পর কতগুলি ক্ষেত্রে কর দফতর সন্দেহজনক ব্যক্তিদের নোটিশ জারি করেছে ও নির্দিষ্ট সময়ের পরে সেই নোটিশপ্রাপ্ত কতজনের বিরূদ্ধে শেষ পর্য্যন্ত উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে (উপযুক্ত ব্যবস্থা অর্থাৎ ক্ষেত্র বিশেষে জরিমানাসহ কর আদায় ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে পুলিশ ও এনফোর্সমেন্ট দফতরের সাহায্যে আদালতে নালিশ ও as a result ভারতীয় দণ্ডবিধির উপযুক্ত ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা), সেই সংখ্যা। কিন্তু এই মানদণ্ডে ডিমনিটাইজেশন সফল না ব্যর্থ তা নির্ণয় করা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ও তার পূর্বে সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করা নিতান্তই অর্বাচীনতার পরিচায়ক, সে ডিমনিটাইজেশনের সমর্থনেই হোক বা বিরুদ্ধে।



৪. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও সতর্কতার বার্তা প্রচার


ডিমনিটাইজেশনের অন্তিম উদ্দেশ্যটিকে যদিও ঠিক সরাসরি অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বলা চলে না তবে সমাজের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষায় এই উদ্দেশ্যটির সাফল্য ও ব্যর্থতাই সম্ভবতঃ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস সাক্ষী যে যেকোন সমাজে কখনও কখনও এমন সময় আসে যখন আর্থিক বিশৃঙ্খলা-ই সমাজের স্বাভাবিক অবস্থা হিসাবে অনুভূত বা perceived হতে থাকে। এই সময় নিজেদেরই সরকারের উপর সাধারন মানুষের আস্থা তলানিতে এসে ঠেকে এবং সাধারন মানুষ তাঁদের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কাজে সরকারকে তাঁদের বন্ধুরূপে না ভেবে তাঁদের প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে। এমন একটা মানসিকতা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে যে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক প্রবণতা তৈরি হয় তাঁদের সঠিক অর্থনৈতিক অবস্থা সরকারের কাছে গোপন রাখবার। শুধু যে করফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা তৈরী হয় তাই নয়, এমনকি যাঁর কোন কর দায় নেই তিনিও কখনো সচেতনভাবে আবার কখনো এমনকি instinctively নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সরকারকে বিপথচালিত করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। প্রত্যেক নাগরিকের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও জ্ঞান না থাকার কারনে এই সময় সরকারের পক্ষেও দেশের জন্য শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক নীতি অবলম্বন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার এই কারনে যখন অনেকসময় সরকারি নীতিতে ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা ধরা পড়ে তখন সেই ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতার কারনে সাধারন মানুষের সরকারের উপরে আস্থার আরো অবনতি ঘটে। তাঁরা তখন তাঁদের অর্থনৈতিক তথ্য আরো বেশী করে গোপন করতে আরম্ভ করেন আর এইভাবে চক্রবৎ by creating a vicious cycle, দেশে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায় ও ক্রমশঃ বেশী বেশী করে সাদা টাকা রূপান্তরিত হতে থাকে কালো টাকায়।



কোন দেশে যখন এই ধরনের অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা একটি রোগ হিসাবে দেখা দেয় তখন ডিমনিটাইজেশন সেই রোগের এক প্রায় অব্যর্থ ঔষধের কাজ করতে পারে।



প্রথমতঃ ডিমনিটাইজেশনের পর যখন সাধারন মানুষ তাঁদের হাতে থাকা ডিমনিটাইজড্ পুরোনো মুদ্রা ব্যাঙ্কে জমা করেন বা ব্যাঙ্ক থেকে নতুন মুদ্রায় পাল্টে নিতে আসেন, তখন প্রায় surely সরকারের পক্ষে কার কাছে কত টাকা আছে তা নির্ণয় করা সম্ভব হয় যা আবার ভবিষ্যতের সঠিক অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে সহায়ক হয়। 


আর দ্বিতীয়তঃ বিমুদ্রাকরণ সাধারন মানুষকে একটা ঝটকা দিয়ে তাঁদের হাতে থাকা মুদ্রার অনিশ্চয়তা ও সরকার নির্ভরতার ব্যাপারে সচেতন করে তোলে যা ভবিষ্যতে তাঁদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে নগদনির্ভরতা কমিয়ে দেয় এবং তাঁরা তাঁদের সঞ্চয়কে নগদে না রেখে বরং ব্যাঙ্কের খাতায় জমা রাখতে বা কোন সম্পদ ক্রয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগে উদ্যোগী হন। 


উপরোক্ত প্রথম outcome-টি যদিও সরকারি system, বেনামীতে সঞ্চয় রোধে সরকারি উদ্যোগ ও তার সাফল্য, ইত্যাদি অনেকগুলি factors and parameters-এর উপর নির্ভরশীল কিন্তু ডিমনিটাইজেশনের দ্বিতীয় outcome-টি প্রায় obvious বা অবশ্যম্ভাবী। 


তাই এই দিক দিয়ে দেখলে, সমাজে ও অর্থনীতিতে কালো টাকা ও বিশৃঙ্খলার অস্তিত্ব যদি আদৌ থাকে, তবে কোন তথ্য, পরিসংখ্যান বা অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির মূল্যায়ন ইত্যাদির অপেক্ষা না করেই নিশ্চিন্তে বলে দেওয়া যায় যে আর্থসামাজিক reform হিসাবে যে কোন সময় বিমুদ্রাকরণের সাফল্য সুনিশ্চিত। একমাত্র যদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার অস্তিত্ব সম্পর্কে সরকারের ধারনাটিই ভিত্তিহীন হয়, বা সহজ কথায় বললে, যদি সমাজে কালো টাকার অস্তিত্বই না থাকে, একমাত্র সেক্ষেত্রেই ডিমনিটাইজেশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হতে পারে। তা আমরা কেউই কি এটা বিশ্বাস করি যে ভারতীয় অর্থনীতিতে কোনো কালো টাকাই নেই বা ২০১৬ র নভেম্বরের আগে ছিল না? 



ঙ) বিমুদ্রাকরণের পূর্বশর্ত এবং কোন্ কোন্ পরিস্থিতিতে বিমুদ্রাকরণ ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা


ডিমনিটাইজেশনের সর্বপ্রথম ও নিঃসন্দেহে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্তটি হল সমাজে অবৈধ কাজ ও কালো টাকার অস্তিত্ব। যদি কোন সমাজে কোন কালো টাকাই না থাকে বা যদি কোন সমাজ এতটাই নিখুঁত হয় যে সেখানে কেউ কোন অসৎ বা অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িতই না থাকেন, তবে সেই সমাজে বিমুদ্রাকরণ সম্পূর্ণ অর্থহীন।


ডিমনিটাইজেশনের দ্বিতীয় এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হল সরকারী কর্মচারী, বিশেষতঃ ব্যাঙ্কিং সেক্টরে, কর দফতরে ও পুলিশ-এনফোর্সমেন্ট দফতরে কর্মরত কর্মী ও অফিসারদের ব্যক্তিগত সততা ও দক্ষতা। এই সততা ও দক্ষতা যত compromised হবে, ততোই ডিমনিটাইজেশনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।


সমস্ত নাগরিকের জন্য ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট থাকা হল ডিমনিটাইজেশনের সাফল্যের জন্য প্রায় আবশ্যক একটি পূর্বশর্ত।


সরকারী ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকের জন্য unique identification থাকা এবং প্রতিটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সাথে সেই identification-এর যোগসূত্র থাকাও ডিমনিটাইজেশনের আরেকটি পূর্বশর্ত যাতে করে সুনির্দিষ্ট ভাবে identify করা যায় যে কোন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মালিক কে।


Last, but not the least, ডিমনিটাইজেশন সম্পূর্ণ সফল হতে গেলে পূর্বশর্ত হিসাবে দেশের অর্থনীতিতে এমন কোন ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন যার মাধ্যমে সমস্ত প্রকারের সমস্ত transaction-কে definitely traceable এবং তার মাধ্যমে সেই transaction-কারীদের definite proof সহ legally accountable করা যায়।


যদি কোন দেশ বা সমাজ এই সমস্ত পূর্বশর্তগুলি fulfill করার পর বিমুদ্রাকরণে প্রবৃত্ত হয়, তবে প্রায় নিশ্চিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব যে সেইক্ষেত্রে ডিমনিটাইজেশনের সাফল্যের সম্ভাবনা প্রায় ১০০%। অবশ্য তার মানে এই নয় যে পূর্বোক্ত পূর্বশর্তগুলি পূরণ না হলেই ডিমনিটাইজেশন ব্যর্থ হবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যর্থতার সম্ভাবনা থেকেই যায়।


এই প্রসঙ্গে আর একটা শেষ কথা। পূর্বোক্ত সমস্ত পূর্বশর্তগুলিই কিন্তু কেবলমাত্র তখনই প্রযোজ্য যখন shear economic reason-এ ডিমনিটাইজেশন করা হয়। যদি কখনো কোন বিশেষ ক্ষেত্রে অন্য কোন সামাজিক বা আর্থসামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে ডিমনিটাইজেশন করা হয় তবে এই পূর্বশর্তগুলি কোনটিই আর আবশ্যিক থাকে না। তখন সেই বিশেষ ক্ষেত্রে ডিমনিটাইজেশনের সাফল্য বা ব্যর্থতার পরিমান হিসাব করতে হয় সেই পূর্বনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসিদ্ধিতে সাফল্য বা ব্যর্থতার পরিমানের নিরিখে।



চ) ভারতবর্ষে ২০১৬ সালের ডিমনিটাইজেশনের কারন, পরিস্থিতি, উদ্দেশ্য ও সম্ভাব্য পরিণতি


এখন যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে ভারতবর্ষের জন্য ২০১৬ সালের ৮ ই নভেম্বর তারিখটা ডিমনিটাইজেশনের সঠিক সময় ছিল কিনা অথবা সেই সময় ভারতের সরকারী ব্যবস্থা ডিমনিটাইজেশনের মত বিপুল সংস্কারের জন্য পূর্ণ প্রস্তুত ছিল কিনা, তবে আমার ব্যক্তিগত উত্তর হবে "না, তা ছিল না"। 


একথায় উৎসাহিত হয়ে আমার ডিমনিটাইজেশন-বিরোধী বন্ধুরা যদি মনে করেন যে আমিও তাঁদের সঙ্গে একমত যে ডিমনিটাইজেশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী রাজনৈতিক ভুল করে বসেছেন, তাহলে তাঁদের হতাশ হতে হবে। তাঁদের এই উৎসাহে জল ঢেলে শুধু এটুকু বলতে পারি যে আসলে এই unprepared অবস্থায় ডিমনিটাইজেশন করার মধ্যে দিয়ে আমি কিন্তু মোদীজির জনদরদী রূপটাই দেখতে পাচ্ছি যা নিশ্চিতভাবেই মোদী-বিরোধীরা পাচ্ছেন না! না, না, bhakt হিসেবে বলছি না। একটু ধৈর্য্য ধরুন, আমার যুক্তিটা জানলে হয়ত আপনারাও দ্বিমত হতে পারবেন না।



ঠিক আগের পরিচ্ছেদে আমি ডিমনিটাইজেশনের যে পূর্বশর্তগুলি আলোচনা করেছি, তার নিরিখে এবার ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করুন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে যখন ডিমনিটাইজেশন করা হয়েছে তখনও কিন্তু ভারতীয় সরকারী ব্যবস্থায় সমস্ত ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক লেনদেনকে বা transactionকে traceable করে তোলা হয় নি। ঠিক তেমনি সমস্ত ভারতবাসীর জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ব্যবস্থাও হয় নি বা সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টকে traceable করে তোলাও হয় নি  যাতে নির্দিষ্ট করা যায় যে কোন্ অ্যাকাউন্ট কার। তখনো (এমনকি এখনো) বহু মানুষের যেমন একটিও অ্যাকাউন্ট নেই তেমনি আরো বহু মানুষের একাধিক অ্যাকাউন্ট আছে যার মধ্যে কোন linking system গড়ে তোলা হয় নি। তাই অনেকেই তাঁদের আয়কর নম্বরের সঙ্গে তাঁদের যে কোন একটি বা দুটি অ্যাকাউন্টকে link করে নিজেদের বাদবাকি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট গুলিকে আয়কর দফতরের নজরের বাইরে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বেনামি অ্যাকাউন্টের কথা তো বাদই দিলাম। তাই ডিমনিটাইজেশনের পর যখন সময় এসেছে ব্যাঙ্কের ঘরে জমা পড়া পুরোনো মুদ্রাগুলির মালিকদের চিহ্নিত করবার ও তাঁদের কাছ থেকে কর ও জরিমানা আদায় করার, আদালতের কাছে ভারতীয় দণ্ডবিধির উপযুক্ত ধারায় তাঁদের অভিযুক্ত করার মত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার, তখন অনেকসময়ই সেই ব্যবস্থা পুরোপুরি নেওয়াটা প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছে। 



এখন দেখা যাচ্ছে যে আমার, আপনার, আমাদের অনেক আগে থেকেই যা জানা ছিল বা অন্ততঃ সন্দেহ ছিল, তা এখন সত্যি হয়ে দেখা দিচ্ছে। সেটা হল, অনেকে, বা বলা ভাল অধিকাংশ মানুষই যাঁদের কাছে নগদ কালো টাকা ছিল, তাঁরা তাঁদের সেই কালো টাকাকে হয় রিয়েল এস্টেট কিনে বা সোনা, হিরের মত মূল্যবান অথচ ভবিষ্যতে বিক্রী করে liquifiable asset এ রূপান্তরিত করে বা লোক মারফত সামান্য দালালির বিনিময়ে ব্যাঙ্ক থেকে একটু একটু করে অনেকবারে বদলে নিয়ে বা আয়কর দফতরের কাছে গোপন করে যাওয়া নিজেদের স্বনামি ও বেনামি অ্যাকাউন্টে জমা করে বা এমনকি অনেকক্ষেত্রে সামান্য কমিশনের বিনিময়ে অন্য দরিদ্র মানুষদের জনধন অ্যাকাউন্টের অপব্যবহার করে সেই নগদ কালো টাকাকে সাদা করে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন। 


হয়তো আপনাদের অনেকেরই এ কথাও মনে হচ্ছে যে তাঁরা সেই কাজে সফলও হয়ে গেছেন। আপনাদের সেই মনে হওয়াকে পূর্ণ সম্মান জানিয়েও অনুরোধ করছি, ব্যাপারটা কষ্ট করে আরেকটু তলিয়ে ভাবুন তো। সত্যিই কি যে সব পুরোনো মুদ্রায় থাকা টাকা ব্যাঙ্কের ঘরে ফিরে এসেছে, তার সবই কি সাদা হয়ে গেছে? আচ্ছা চলুন, কয়েকটা উদাহরণের মাধ্যমে আলোচনা করা যাক।



উদাহরণ - ১যাঁরা ডিমনিটাইজড্ নগদ কালো টাকায় রিয়েল এস্টেট কিনেছেন। 


এঁদের কিন্তু ভোলা উচিত নয় যে সেই রিয়েল এস্টেটের একজন বিক্রেতাও আছেন যিনি ওই রিয়েল এস্টেটটির পুরোনো মালিক। আর in any case তাঁকে অর্থাৎ সেই বিক্রেতাকে তো সেই বিক্রীর বিনিময়ে পুরোনো মুদ্রায় পাওয়া টাকাকে সেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেই জমা করতেই হবে। এবার আয়কর দফতর যখন সেই বিক্রেতাকে তাঁর জমা করা টাকার source জিজ্ঞাসা করবে তখন তিনি কি উত্তর দেবেন? যেইমাত্র তিনি বলবেন যে টাকাটা তিনি তাঁর মালিকানায় থাকা রিয়েল এস্টেট বিক্রয় করে পেয়েছেন, তক্ষুনি কিন্তু তাঁর উপর দায় বর্তাবে ক্রেতার নাম জানাবার। যদি তিনি সঠিক ক্রেতার নাম তথ্য প্রমাণ সহযোগে জানাতে না পারেন, তখন কিন্তু আয়কর দফতরের সম্পূর্ণ অধিকার আছে সেই অজ্ঞ বিক্রেতার claim disallow করবার আর সেই বিক্রেতাকেই অবৈধ কালো টাকার মালিক ধরে নিয়ে তাঁকেই জরিমানা করবার ও তাঁর বিরুদ্ধেই ভারতীয় দণ্ডবিধির উপযুক্ত ধারায় অভিযোগ করবার। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে সেই অজ্ঞ বিক্রেতাকেই তাঁর না জেনেশুনে সম্পূর্ণ অপরিচিত ক্রেতার কোনরূপ পরিচয় যাচাই না করেই মূল্যবান সম্পত্তি বিক্রয় করবার বোকামির বা হয়তো বা লোভের খেসারত দিতে হবে। আর যদি তিনি সঠিক ক্রেতার নাম তথ্য প্রমাণ সহযোগে জানাতে পারেন তখন তো আয়কর দফতরের হাতে অস্ত্রই এসে যাবে ক্রেতাকে প্রশ্ন করবার। ক্রেতা যদি নিজেই সেই ডিমনিটাইজড্ কালো টাকার মালিক হন তবে তো হয়েই গেল; এবার তাঁর টাকার sourceএর ব্যাপারে জবাবদিহির পালা আর না পারলেই prosecution. আর যদি ক্রেতা নিজে আসল কালো টাকার মালিক না হয়ে বেনামদারও হন তবুও নিস্তার নেই। আবার সেই source disclosureএর প্রশ্ন যার satisfactory উত্তর না দিতে পারলে শাস্তি আর দিতে পারলে তা আসল কালো টাকার মালিককে চিহ্নিত করবার পথে আরেক পা এগোনো। এই ভাবে, সময়সাপেক্ষ হলেও, শেষ পর্যন্ত আয়কর দফতর কিন্তু ঠিকই হদিস পেয়ে যাবে আসল কালো টাকার মালিকের।



উদাহরণ - ২যাঁরা সোনা-রুপা-হিরের মতো মূল্যবান liquifiable asset কেনার মাধ্যমে তাঁদের হাতে থাকা কালো টাকা invest  করেছেন। 


এঁদের সবিনয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই যে ডিমনিটাইজেশনের অনেক আগে থেকেই আইন আছে যে নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশী মূল্যবান এইরূপ দামী ধাতু বা গহনা কিনতে গেলে ক্রেতার আয়কর নম্বর উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। আবার মনে করে দেখুন, ডিমনিটাইজেশনের অব্যবহিত পরেই কেন্দ্রীয় সরকারের আয়কর দফতর বহু সংখ্যক বড় গহনা ব্যবসায়ী ও দোকানকে নোটিশ দিয়ে জেনে নিয়েছিল সেই গহনার দোকান থেকে ডিমনিটাইজেশনের তারিখের অর্থাৎ ৮ই নভেম্বরের আগে-পরে কিছুদিনের মধ্যে হওয়া সমস্ত sale details. তাছাড়া দোকানগুলির সেই সব দিনের CCTV footage-ও ইতিমধ্যেই আয়কর দফতর ডিমনিটাইজেশনের অব্যবহিত পরেই জারি করা বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক সংগ্রহ করে নিয়েছে। আশা করি বুঝতে খুব অসুবিধা হবে না যে এরপর সেইসব কালো টাকার ব্যবহারকারী ক্রেতাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়াটা কেবলমাত্র সময় আর আয়কর দফতরের কর্মী আধিকারিকদের দক্ষতার উপর নির্ভরশীল।



উদাহরণ - ৩যাঁরা তাঁদের হেফাজতে থাকা কালো টাকা আয়কর দফতরের কাছে গোপন করে যাওয়া নিজেদের স্বনামি ও বেনামি অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন। 


তাঁদের হয়তো মনে হয়েছে যে যেহেতু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটি আয়কর দফতরের কাছে নথিবদ্ধ নেই তাই আয়কর দফতরের পক্ষে সম্ভবই হবে না কোটি কোটি এমন অ্যাকাউন্টকে case to case deal করা বা তাদের মালিকদের corresponding Income Tax PAN number-এর সঙ্গে link করে চিহ্নিত করা। হ্যাঁ, একথা সত্যি যে গত বছরের নভেম্বরে সরকারের বা আয়কর দফতরের কাছে available data অনুসারে এই চিহ্নিতকরণ প্রায় অসম্ভব কাজ, কিন্তু তাঁরা বোধহয় জানেন না বা ভুলে গেছেন যে transactional footprint বলে একটা জিনিস তখনো ভারতীয় banking ব্যবস্থায় পুরোপুরি চালু ছিল এবং এখনও আছে। Transactional footprint মানে এমন ব্যবস্থা যার মাধ্যমে যে কোন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে করা যে কোন transaction (অবশ্যই এই ব্যবস্থা চালু হওয়ার দিন থেকে শুরু করে), ব্যাঙ্কের নিজস্ব computerised systemএ বরাবরের মত record ও save করা থাকে এবং যে কোন মুহূর্তে just on the click of a button তাকে retrieve করা যায়। তাই যে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটি আজও সরকারের আয়কর দফতরে নথিভুক্ত নেই, যদি এমনকি ভবিষ্যতেও কখনো তাকে নথিভুক্ত করতে হয় তখনো কিন্তু অনায়াসে গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সেই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে করা যে কোন transaction আয়কর দফতরের database-এ ঢুকে যাবে। এবার দেখুন, ভারত সরকার ইতিমধ্যেই বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিয়েছে আয়কর PAN No.-এর সঙ্গে আধার link করার ব্যাপারে। প্রত্যেকটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টকেও আধারের সঙ্গে link করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে বিচারধীন, তবু মনে করুন যদি এই linking এর কাজ সম্পূর্ণ করা যায়, তখন কিন্তু সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট automatically আয়কর দফতরের সঙ্গে linked হয়ে পড়বে। সেদিন, তা সে যতদিন পরেই হোক, transactional footprint ব্যবহার করে একেবারে সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে করা সমস্ত transaction নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত হয়ে পড়বে। বেনামি অ্যাকাউন্টগুলিও কিন্তু এই ব্যবস্থায় রেহাই পাবে না। এবং এর জন্য কোন human interface-এরও কোন প্রয়োজন পড়বে না বলে আয়কর দফতরের কর্মীসংখ্যার deficiency বা কর্মীদের ব্যক্তিগত সততার কোন প্রশ্নও এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। তাই যাঁরা গত বছর ডিমনিটাইজেশনের পরে এমন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে নিজেদের কালো টাকাকে সাদা করে নিয়েছেন ভেবে আনন্দিত হচ্ছেন, তাঁদের বেশীরভাগেরই (না, যদিও সকলের নয়। কেন? সে কথায় একটু পরে আসছি) কিন্তু ধরা পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।



এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে সব ক্ষেত্রেই যদি কালো টাকা বা তার মালিকদের চিহ্নিত করার উপায় থেকেই থাকে, তবে কেন আমি এই পরিচ্ছেদের শুরুতে বললাম যে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস ভারতবর্ষে ডিমনিটাইজেশনের সঠিক সময় ছিল না? তার উত্তরে আমি বলব যে একটু তলিয়ে ভাবুন তো, আমারই দেওয়া উপরোক্ত উদাহরণগুলি অনুসরন করে সমস্ত কালো টাকার মালিকদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত জরিমানা বা শাস্তিবিধান করতে গেলে কি বিপুল পরিমান কাজ আয়কর দফতর বা তার সহযোগী হিসাবে পুলিশ ও এনফোর্সমেন্ট দফতরগুলিকে করতে হবে? তার উপযুক্ত কর্মীসংখ্যা বা পরিকাঠামো আমাদের concerned সরকারী দফতরগুলিতে আছে কি? না, নেই। তাই যদিও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে যাঁরা অপেক্ষাকৃত বড় অঙ্কের কালো টাকাকে সাদা করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁদের সময়ের সাথে সাথে চিহ্নিত করা যাবে, কিন্তু প্রায় কোনো ছোট অঙ্কের কালো টাকার মালিককেই কেবলমাত্র পরিকাঠামোগত অপ্রতুলতার কারণে চিহ্নিত করা যাবে না। আবার এই ফাঁক গলে কিছু কিছু বড় অঙ্কের কালো টাকার মালিকও হয়তো ছাড় পেয়ে যেতে পারেন। এছাড়া অবশ্য আরো কতকগুলি case আছে যেক্ষেত্রে কালো টাকার মালিকদের সম্ভবতঃ ধরা যাবে না। 



যেমন গত বছর ডিমনিটাইজেশনের পর প্রথম প্রায় কুড়ি দিন জনসাধারনকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তাঁদের হেফাজতে থাকা, প্রতিদিন ব্যক্তিপিছু একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের নিচের ডিমনিটাইজড্ পুরোনো মুদ্রা কোন অ্যাকাউন্টে জমা না করে শুধু ব্যাঙ্ক থেকে বদলে নেওয়ার। মনে করে দেখুন, তার মধ্যে একদম প্রথমদিকে এই বদলের জন্য কোন পরিচয়পত্রেরও প্রয়োজন পড়ছিল না। যদিও এই সুযোগ দেওয়ার পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল সেইসব মানুষদের অসুবিধার নিরসন করা যাঁদের কোন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই, এবং যদিও প্রায় প্রতিটি ব্যাঙ্কে সম্পূর্ণ আলাদা কাউন্টার রাখা হয়েছিল টাকা বদল আর নিজস্ব অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করার জন্য, কিন্তু তবু এমনকি আমাদের মতো অনেকে যাঁদের একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে তাঁরাও panicked হয়ে নিজস্ব অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করার অপেক্ষাকৃত ছোট লাইনে না দাঁড়িয়ে ভিড় জমিয়েছিলাম টাকা বদলের দীর্ঘ লাইনে। 


যদিও সামান্য দুই তিন দিনের মধ্যে এই প্রবণতার পরিবর্তন ঘটে এবং দুইপ্রকারের লাইনেই তুল্যমূল্য সমান ভিড় হতে থাকে কিন্তু সেই প্রথম দু'তিন দিনের মধ্যেই অনেক অসাধু ব্যক্তি তাঁদের কালো টাকার সঞ্চয়কে অনেক middleman-এর মাধ্যমে (যাঁরা সামান্য দালালির বিনিময়ে আসল কালো টাকার মালিকদের হয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন) ব্যক্তিপিছু সরকার নির্দিষ্ট অঙ্কে অল্প অল্প করে বদলে নিয়েছিলেন নতুন মুদ্রায়। সেই সময় একই ব্যক্তি এমনকি বার বার নতুন করে লাইনে দাঁড়িয়ে একই দিনে একাধিকবার টাকা বদল করেছিলেন। তার জন্য তাঁদের নিজেদের বা তাঁদের middlemanদের কারোরই পরিচয় disclose করার প্রয়োজন পড়ে নি। দু'তিনদিনের মধ্যেই যদিও সরকার এই অসাধু প্রবণতার আঁচ পেয়ে প্রত্যেক মুদ্রা বদল করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির জন্য পরিচয়পত্রের ফটোকপি পেশ করা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন কিন্তু তার মধ্যেই অনেক "কালো টাকা"র মালিক সাধারন সৎ নাগরিকদের মধ্যে মিশে নিজেদের অনেকটা "কালো টাকা" নতুন মুদ্রায় বদলে নিয়েছেন। যদিও তার ফলে পুরোনো মুদ্রা ব্যাঙ্কের তথা সরকারের ঘরে ফিরে এসেছে কিন্তু তাই বলে একথা মনে করা ভুল যে তা সাদা হয়ে গেছে। যাঁদের কাছে পুরোনো মুদ্রায় "কালো টাকা "ছিল তাঁদের সেই টাকা নতুন মুদ্রায় বদলে নেওয়ার পরেও "কালো"ই রয়ে গেছে কারণ তাঁদের কাছে সেই টাকা উপার্জনের original source এবং/অথবা তার undisclosed nature অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। তাই যদিও এক্ষেত্রে "কালো টাকা" সাদা হয়ে যায় নি, কিন্তু তবুও একথাও অস্বীকার করার জায়গা নেই যে এইভাবে বদলে নেওয়ার ফলে সেই "কালো টাকা" "কালো" হিসাবেই তার মালিকের কাছেই শুধু পুরোনো থেকে নতুন মুদ্রায় রূপ পরিবর্তন করে ফিরে গেছে আর ডিমনিটাইজেশন তা উদ্ধারের বা সাদা ও বৈধ অর্থনীতিতে তা ফিরিয়ে আনার কোন পথ বার করতে পারে নি। এছাড়াও অনেকে ডিমনিটাইজেশনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু গহনার দোকানদারের সঙ্গে যোগসাজসে তাঁদের "কালো টাকা" বিভিন্ন লোকমারফত কখনো ৮ই নভেম্বরের date-এ কখনো backdate-এ অল্প অল্প করে গহনায় রূপান্তরিত করে ফেলেছেন যাঁদের চিহ্নিত করে ধরতে পারা সরকারের পক্ষে practically impossible.



নাঃ! এবার আমার নিজেরই মনে হচ্ছে যে ব্যাপারটা বোধহয় এতক্ষণে সবার জন্যই ভয়ংকর রকমের confusing হয়ে উঠেছে। এই পর্যায়ে এসে যে কোনো কারোর পক্ষে বোধহয় বুঝে ওঠাই কঠিন হয়ে উঠেছে যে ভারতবর্ষে ডিমনিটাইজেশনের সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রশ্নে আমার নিজের অবস্থানটা ঠিক কি। আমি নিজে কি ২০১৬ সালের ডিমনিটাইজেশনকে সফল মনে করি? না ব্যর্থ? এই গোটাদুয়েক অনুচ্ছেদ আগে যা বলেছি তাতে মনে হবে ডিমনিটাইজেশনের সাফল্য যেন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আবার এক্ষুনি ঠিক এর আগের অনুচ্ছেদে যা বললাম তাতে মনে হবে বোধহয় ডিমনিটাইজেশন ব্যর্থ। আবার এই পরিচ্ছেদের শুরুতে বলেছি ডিমনিটাইজেশনের মধ্যে দিয়ে আমি শ্রী নরেন্দ্র মোদীর জনদরদী রূপ দেখতে পেয়েছি। তাহলে আসলে আমি ঠিক কি বলতে চাই? হ য ব র ল? চন্দ্রবিন্দুর 'চ', বেড়ালের তালব্য 'শ' আর রুমালের 'মা'?



আর suspense না বাড়িয়ে তাহলে এই বেলা আমার আসল বক্তব্যটা বলেই ফেলি। কিন্তু এই প্রসঙ্গে এটাও বলে রাখি যে আমি এখানে যা বলব তা আমার একান্ত নিজস্ব বক্তব্য আর যদিও আমি নিজে বিজেপির সদস্য কিন্তু আমার এই বক্তব্যের পিছনে বিজেপি দলের বা ভারত সরকারের কোন দায় নেই বা তাঁদের সরকারী বা বেসরকারী বক্তব্যের কোন সম্পর্ক নেই। 



আমি মনে করি আমাদের, মানে সাধারন ভারতবাসীদের প্রায় কেউই ২০১৬ সালে করা ডিমনিটাইজেশনের পিছনে ভারত সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর আসল উদ্দেশ্যটাই ধরতে পারি নি। আমরা শুধু সরকারের এবং প্রধানমন্ত্রীজির সময়ে সময়ে দেওয়া বিবৃতি শুনেছি আর কেউ তা বিশ্বাস করেছি আর কেউ তা করি নি। সেই বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের পিছনে যতটা আমাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক inclination কাজ করেছে ততোটা কিন্তু সুচিন্তিত বিবেচনা কাজ করে নি। তাই যতবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীজি পরিবর্তিত পরিস্থিতির ব্যাপারে আমাদের অবগত করতে চেয়েছেন আর কালো টাকার মালিক ও কারবারিদের দিক থেকে নেওয়া বিভিন্ন নিরন্তর পরিবর্তনশীল strategy-র উত্তরে পাল্টা strategy নিয়েছেন, ততবার আমরা, সাধারন মানুষরা, প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর রাজনৈতিক দল বিজেপির সমর্থক বা বিরোধী নির্বিশেষে, অন্তত নিজেদের মনের গভীরে, উৎকন্ঠিত হয়ে উঠেছি আর বিজেপি-বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলের একযোগে করা প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে প্রধানমন্ত্রী বোধহয় সত্যিই ডিমনিটাইজেশনের সিদ্ধান্তের ভুল (অন্তত আংশিক ভুল) বুঝতে পেরে গোলপোস্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে মুখরক্ষার চেষ্টা করছেন। 



সবিনয়ে জানাই, আমার মনে হয় যে আমাদের মধ্যে যাঁরা এইরকম ভেবেছেন বা ভাবছেন তাঁরা নিজেরাই বরঞ্চ সম্পূর্ণ ভুল। প্রধানমন্ত্রী গোড়াতেও জানতেন তিনি কি করতে চেয়েছেন, তিনি তাঁর প্রত্যেকটা decision, প্রত্যেকটা step নিয়েছেন পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে এবং এমনকি প্রত্যেকটা প্রকাশ্য বক্তব্যও রেখেছেন strategically সুচিন্তিতভাবে কখনো candidly সাধারন সৎ জনগনের উদ্দেশ্যে আবার কখনো ইচ্ছাকৃত ভাবে সাধারন মানুষের মধ্যে মিশে থাকা কালো টাকার কারবারিদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে। সেই কোনোটা candid আবার কোনোটা intentionally misguiding বক্তব্যকে তিনি এত সুচতুরভাবে মিশিয়ে দিয়ে বলেছেন, যাতে তাদেরকে প্রায়শঃই আলাদা করা যায়নি।



এবার আসি কিছু তথাকথিত গোলপোস্ট পরিবর্তনের ব্যাপারে। বিমুদ্রাকরণের অব্যবহিত পরে সম্ভবতঃ প্রধানমন্ত্রী নিজে (অথবা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, ঠিক মনে নেই) বলেছিলেন যে তাঁরা আশা করছেন যে অন্ততঃ দুই থেকে তিন লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্কের ঘরে আর ফিরে আসবে না। অথচ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্টে যখন দেখা গেল যে মাত্র ষোল হাজার কোটি টাকা বাদে বাকি সব টাকা ব্যাঙ্কের ঘরে ফিরে এসেছে তখন সরকারপক্ষ সেই ফিরে আসাকেই তাদের সাফল্য বলে চালাতে চাইছে। যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গির আপাত দ্বিচারিতাকেই অনেকে সরকারের দ্বিচারিতা ও গোলপোস্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে মুখরক্ষার প্রয়াস বলতে চাইছেন এবং অনেকে তা বিশ্বাসও করছেন কিন্তু আমার মতে এই dual version-এর কারন হল আসলে এমন এক অভাবনীয় সাফল্যের সম্ভাবনা যা সরকার নিজেও ডিমনিটাইজেশনের সময় আশা করতে পারেন নি। আর একটু বিশদে বুঝিয়ে বলছি। 



মনে করে দেখুন, বা প্রয়োজন বোধ করলে দয়া করে আরেকবার পড়ুন উপরের "ঘ" পরিচ্ছেদে, ডিমনিটাইজেশনের "২" নম্বর উদ্দেশ্য অর্থাৎ "নগদ "কালো টাকা"-র বিলুপ্তিকরণ"-এর পরিস্থিতি আলোচনা করতে গিয়ে second paragraph এ আমি বলেছি "যে কালো টাকার প্রথম প্রকারটি হল "কালো বা অবৈধ কাজের মাধ্যমে উপার্জিত টাকা"। যেহেতু সমাজব্যবস্থায় এই ধরনের কালো বা অবৈধ কাজ আইনতঃ দণ্ডনীয়, আর সাধারণত দণ্ডের ভয় অর্থের লোভের চেয়ে বেশী, তাই আশা করা হয় যে ডিমনিটাইজেশন করা হলে এই প্রথম প্রকারের কালো টাকার মালিকেরা তাদের হেফাজতে থাকা টাকা ব্যাঙ্কে বদল করতে আসতে সাহস পাবে না। অর্থলোভে, বা বলা ভাল, অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের সঞ্চিত অংশ রক্ষা করতে গিয়ে, টাকা বদল করতে এসে যদি তার উৎসের খোঁজ পড়ে আর কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বার হয়, তবে সেই অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ তো বাজেয়াপ্ত হবেই, উপরন্তু কঠোর শাস্তির সম্ভাবনা, সেই ভয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আশা করা হয় যে এই প্রথম প্রকারের কালো টাকার নগদ সঞ্চয় বিমুদ্রাকৃত হলে বেশীরভাগই আর অর্থনীতিতে ফিরে আসে না বরং তাদের মালিকেরা দণ্ডের ভয়ে টাকার মায়া ত্যাগ করে সেইপ্রকার ডিমনিটাইজড্ "কালো টাকা"র নগদ সঞ্চয়কে গোপনে নষ্ট করে দেওয়া অধিক লাভজনক মনে করেন।" আবার দেখুন, উপরোক্ত একই "ঘ" পরিচ্ছেদে, বিমুদ্রাকরণের "৩" নম্বর উদ্দেশ্য অর্থাৎ ""কালো টাকা"-র চিহ্নিতকরণ ও কালো অর্থনীতির হাত থেকে সমাজমুক্তি"-এর পরিস্থিতি আলোচনা করতে গিয়ে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আমিই বলেছি যে "যখন প্রথম প্রকারের কালো টাকার মালিকদের মনে সরকারের কর দফতর ও এনফোর্সমেন্ট দফতরের কর্মীদের দক্ষতা বা সততার প্রতি নিচু ধারনা থাকে, সেখানে তাঁরা অর্থাৎ প্রথম প্রকারের কালো টাকার মালিকেরাও মনে করেন যে তাঁদের কুকীর্তির নাগাল পাওয়া উক্ত দুই দফতরের কর্মীদের দক্ষতায় কুলোবে না, অথবা উৎকোচ বা রাজনৈতিক প্রভাব বা ভয়প্রদর্শনের মাধ্যমে তাঁরা সেইসব কর্মীদের মুখ বন্ধ করতে পারবেন, সেখানে সেই সব প্রথম প্রকারের কালো টাকার মালিকেরাও তাঁদের কালো টাকা বেপরোয়া ভাবে ব্যাঙ্কের ঘরে জমা করার মধ্যে দিয়ে রক্ষা করতে সচেষ্ট হন।" 



তাই যখন সরকার আশা প্রকাশ করেছিল যে বিমুদ্রাকরণের ফলে ভারতীয় অর্থনীতিতে অন্ততঃ দুই থেকে তিন লক্ষ কোটি টাকা ফিরে আসবে না, তখন তার মানে ছিল এই যে সরকারের estimation-এ ভারতীয় অর্থনীতিতে উপস্থিত থাকা মোট কালো টাকার মধ্যে মোটামুটি এই দুই থেকে তিন লক্ষ কোটি টাকা (বা তার কিছু বেশী) হল এই প্রথম প্রকারের কালো টাকা যা কিনা তার মালিকের দ্বারা উপার্জিত হয়েছে কালো বা অবৈধ কাজের মাধ্যমে। 



আসলে তখন একই সঙ্গে সরকারের এই আশাও ছিল যে একদিকে যেমন সাধারন সৎ ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে তাঁদের নিজেদের সরকারী দফতরের দক্ষতার উপর ভরসা আছে তেমনি হয়তো অসৎ নাগরিকদের সেই সরকারী দফতরগুলির দক্ষতার কারণে ভয়ও আছে। In any case, এর থেকে অন্ততঃ এটুকু বোঝা যায় যে সরকারের নিজেদের কিন্তু সরকারী কর্মচারীদের সততা ও দক্ষতার উপর ভরসার কোন ঘাটতি নেই। আশা করি যে কোন স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচিত সরকারের যে নিজেদের কর্মচারী ও জনসাধারণের উপর এই আস্থা ও ভরসা থাকাই উচিত সে বিষয়ে কারো দ্বিমত হবে না। 



কিন্তু বাস্তবে যখন দেখা গেল যে আশাতিরিক্ত পরিমানে টাকা ব্যাঙ্কের ঘরে ফিরে এসেছে তখন তার দুটিমাত্র সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। এক, যদি ডিমনিটাইজেশনের সময় দেশের অর্থনীতিতে উপস্থিত মোট প্রথম প্রকারের কালো টাকার পরিমাণ সরকারের estimation-এর থেকে অনেক অনেক কম হয়, আর দুই, যদি এই প্রথম প্রকারের কালো টাকার মালিক অসৎ নাগরিকদের সরকারী কর্মচারীদের সততা ও দক্ষতার প্রতি অবজ্ঞার ভাব থেকে থাকে। 



যদি এর মধ্যে প্রথম সম্ভাবনাটা সত্যি হয় তবে অবশ্যই বলতে হবে যে বিমুদ্রাকরণ সম্পূর্ণ ব্যর্থ কারণ সেক্ষেত্রে তো ধরে নিতে হয় যে ডিমনিটাইজেশনের আগে থেকেই ভারতীয় অর্থনীতি যথেষ্ট সুস্থ-সবল ও স্বচ্ছ অবস্থায় বর্তমান ছিল। কিন্তু আমার তো মনে হয় এই inferenceটা মেনে নেওয়া আমাদের ভারতীয়দের কারো পক্ষেই সহজপাচ্য নয়। আমাদের প্রায় প্রত্যেকের দৈনন্দিন জীবনের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাই এর উল্টো সাক্ষ্য দেয়। 



তাই এক্ষেত্রে একমাত্র দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই পড়ে থাকে। তার মানে শুধু এই যে সংশ্লিষ্ট সরকারী দফতরগুলির কর্মীদের দক্ষতা ও সততার উপর যে ভরসা প্রধানমন্ত্রী নিজে রেখেছেন ও সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদের (সৎ ও অসৎ দুই ধরনেরই) কাছ থেকে আশা করেছিলেন, বাস্তবে সেই ভরসা বা ভয় অন্ততঃ সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা অসৎ, তাঁদের মনে নেই। সেদিক দিয়ে মানতেই হবে যে ডিমনিটাইজেশনের সময় অন্ততঃ অসাধু কালো টাকার কারবারিদের সম্ভাব্য মানসিকতার সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী যে projection করেছিলেন, তা ভ্রান্ত। ভারতের অসাধু কালো টাকার কারবারিরা প্রধানমন্ত্রী তাঁদের যেমন মনে করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি অসৎ ও desperate. তবে একই সাথে করা কর দফতর ও পুলিশ এনফোর্সমেন্ট দফতরের কর্মীদের সততা ও দক্ষতার প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর ভরসাটা সত্য না ভ্রান্ত তা সময় প্রমান করবে ।



এবার দেখি যে ডিমনিটাইজেশনের সময় করা প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর অসাধু কালো টাকার কারবারিদের সম্ভাব্য মানসিকতার সম্বন্ধে আশা যে ভ্রান্ত প্রমাণিত হল, বর্তমান পরিস্থিতিতে তার সম্ভাব্য outcome কি হতে পারে। যদি একইসাথে করা কর দফতর ও পুলিশ এনফোর্সমেন্ট দফতরের কর্মীদের সততা ও দক্ষতার প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর ভরসাও সময়কালে ভ্রান্ত প্রমানিত হয় তবে অবশ্যই মানতে হবে যে ২০১৬ সালের বিমুদ্রাকরণ মূলতঃ ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য আংশিক সাফল্য, যেমন করদাতার সংখ্যা ও বাৎসরিক আয়কর আদায়ে ২৫%-এর বেশী বৃদ্ধির মত কিছু সাফল্য যা already achieved হয়েছে তা থেকেই যাবে, কিন্তু এগুলি আসলে নিতান্তই গৌণ এবং transient যার কোনো প্রভাব immediate next year এর performance-এর উপরই আর থাকবে না। কিন্তু এখনো পর্য্যন্ত যেটুকু জানা যাচ্ছে তাতে কিন্তু মনে হচ্ছে না যে অন্ততঃ সরকারি কর্মীদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর ভরসাতে কোন ভুল আছে। ইতিমধ্যেই প্রায় তিন লক্ষ ভুয়ো কোম্পানিকে সরকারি কর্মচারীরা চিহ্নিত করে ফেলেছেন এবং সেগুলিকে ইতিমধ্যেই delisting করা হয়ে গেছে। সেইসব shell company গুলির bank account-ও freeze করা হয়েছে এবং আশা করা যায় যে অচিরেই সেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে থাকা টাকাকেও confiscate করা যাবে। যতদূর জানা যাচ্ছে, the process is on. এবার, যদি সেই অ্যাকাউন্টগুলির ব্যালান্সকে সরকার confiscate করতে পারে, তবে তার অর্থ দাঁড়াবে এই যে সেই অ্যাকাউন্টগুলিতে জমা পড়া টাকা সরাসরি চলে আসবে সরকারের হাতে। উপরন্তু, সেইসব ভুয়ো কোম্পানির মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে সরকার । অর্থাৎ, সেইসব ভুয়ো কোম্পানির মালিকেরা ডিমনিটাইজেশনের পরে যে উদ্দেশ্যে হাতে থাকা পুরোনো মুদ্রা ব্যাঙ্কের খাতায় জমা করেছিলেন, তা তো ব্যর্থ হবেই, তার উপর তাঁদের এবার শাস্তির মুখামুখি হতে হবে। আর এই সবই হবে কর দফতরের প্রতি তাঁদের অবজ্ঞার কারনে। এর চেয়ে তাঁরা যদি টাকার মায়া ছেড়ে ডিমনিটাইজড্ পুরোনো টাকা ব্যাঙ্কে আদৌ জমা করতে না-ই যেতেন, তাহলে অন্ততঃ তাঁরা আজ শাস্তির মুখে পড়তেন না। এছাড়াও সংবাদমাধ্যমের খবরে দেখা গেছে যে ইতিমধ্যেই কর দফতরের কর্মীরা আরো বেশ কয়েক লক্ষ সন্দেহজনক transactions-কে identify করে ফেলেছেন এবং নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। 



এসব কিছু থেকে কিন্তু ভরসা করার যথেষ্ট কারণ আছে যে অন্ততঃ সরকারি কর্মীরা তাঁদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর ভরসার মূল্য দিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে কিন্তু ডিমনিটাইজেশনের সাফল্য শুধু সময়ের অপেক্ষা। মনে রাখতে হবে, ডিমনিটাইজেশনের পর টাকা ব্যাঙ্কে ফিরে না এলে যেমন দেশের অর্থনীতির লাভ, তেমনি যদি টাকা ফিরে আসে আর তার মধ্যে থেকে কালো বা অবৈধ টাকাকে চিহ্নিত করে তার উপর কর, জরিমানা ইত্যাদি আদায় করা যায় আর সেই কালো টাকার মালিকদের উপযুক্ত  শাস্তিবিধান করা যায়, তবে তাতে শুধু যে দেশের অর্থনীতির আরো বেশী লাভ তাই নয়, তাতে in the long run, দেশের সামাজিকভাবেও লাভ।



এবার finally বলব কেন আমার মনে হয়েছে যে ২০১৬ সালের বিমুদ্রাকরণের মধ্যে দিয়ে আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটি জনদরদী রূপও দেখতে পেয়েছি। তার জন্য আগে আমাদের একটু আত্মপর্যালোচনা বা introspection করতে হবে। 


ভেবে দেখুন তো, আমাদের মধ্যে কতজন আমরা আমাদের সম্পূর্ণ উপার্জন কর দফতরের কাছে প্রকাশ করে গোটাটার উপর কর দিই (মনে রাখতে হবে যে আমাদের সমস্ত সঞ্চয়ের উপর পাওয়া বা এমনকি accrue করা সমস্ত সুদও কিন্তু করযোগ্য) ? আমরা কতজন আমাদের সমস্ত ক্রয়ের জন্য বিক্রেতার কাছ থেকে পাকা রশিদ দাবী করি আর বিক্রেতা তা না দিতে পারলে তাঁর কাছ থেকে ক্রয় করা থেকেই বিরত হই ? To be more specific, আমরা কতজন কর দেওয়াকে আমাদের দায় মনে না করে কর্তব্য মনে করি। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা কতজন আমাদের কর ব্যবস্থার আইনকানুনগুলির ব্যাপারে কতটুকু জানি যে নিশ্চিতভাবে বলতে পারব যে আমরা কোন করফাঁকি দিই না ? সঠিক জানি না, কিন্তু আমার তো মনে হয় সংখ্যাটা নগণ্য, if not zero. The best that we can claim is that, আমরা আমাদের জ্ঞানতঃ কোন করফাঁকি দিতে চাই না, বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোন করফাঁকি দিই না। তাই বাস্তব হল এই যে আমরা অনেকেই কখনো জ্ঞানতঃ, আর বেশীরভাগ সময় অজ্ঞানতঃ, নিজেদের কাছে কালো টাকা রাখি বা কালো টাকার generation-এর কারণ হই, তা সে যত অল্প পরিমানেই হোক না কেন। 



তাই হঠাৎ যদি সরকার এমন কোন ব্যবস্থা নিয়ে ফেলেন যে সমস্ত কালো টাকা ধরা পড়ে যাবে আর কালো টাকা ব্যবহারকারী সবাই শাস্তির মুখে পড়বেন, তবে আমার তো মনে হয় ভারতবর্ষের মত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাসম্পন্ন দেশে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। বাস্তবতঃ আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাটাই আজও, তথাকথিত স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও এমনই রয়ে গেছে যে ব্যক্তিগতভাবে আমাদেরও উপায় নেই। আমাদের ভারতীয়দের অনেকের কাছেই আজও স্বাধীনতা আসলে স্বেচ্ছাচারীতারই নামান্তর। তাই আমাদের মধ্যে আমাদের নিজেদের elected government এর সম্বন্ধে এমনকি minimum ownership feeling-টাই গড়ে ওঠেনি। এমনকি আমাদের ক্ষমতাসীন জনপ্রতিনিধিরাও এর ব্যতিক্রম নন। আর এই দিনের আলোর মতো সত্যিটা, যা এমনকি আমার মতো অর্বাচীনের কাছেও স্পষ্ট, তা শ্রী নরেন্দ্র মোদীজির মতো ধুরন্ধর রাজনীতিবিদের অজানা ছিল একথা আমার কাছে তো অন্ততঃ বিশ্বাসযাগ্য নয়। তাহলে কি মনে করতে হবে যে প্রধানমন্ত্রী সত্যি সত্যিই অধিকাংশ ভারতীয়কেই জেলে ভরতে চেয়েছিলেন? না। সমস্ত aspect judge করে আমার মনে হয়েছে যে ২০১৬ সালে সম্পূর্ণ পরিকাঠামোগত প্রস্তুতি না নিয়েই যে ডিমনিটাইজেশন করা হয়েছিল তা আসলে ছিল কিছুটা ইচ্ছাকৃত। একবারে সমস্ত কালো টাকা এক ঝটকায় উদ্ধার করা বা সমস্ত কালো টাকার মালিকদের জেলে পোরার মতো drastic উদ্দেশ্যই এক্ষুনি সরকারের ছিল না। তা না হলে সরকারের পক্ষে আর মাত্র কয়েক মাস অপেক্ষা করে পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বিমুদ্রাকরণের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া তো আরো সহজ ছিল। কিন্তু সেইরকম হলে আমার আপনার মতো অগুন্তি সাধারন মধ্যবিত্তর কাছে তা হত disastrous. আমরা অনেকেই হঠাৎ আবিষ্কার করতাম যে আমাদের hard earned money-র অনেকটাই আমাদের অনিচ্ছাকৃতভাবে করা করফাঁকির অপরাধে আমরা হারাতে বসেছি জরিমানার জালে। আমার মনে হয় সরকার প্রথমেই চায় নি সাধারন মধ্যবিত্তকে সেই genuine বিপদের মধ্যে ফেলতে কারণ তাহলে এখনকার শতখানেক indirect casualty-র বদলে ভারতবর্ষের মত দেশে direct casualty-র সংখ্যা হয়তো হাজারের কোঠা ছাড়িয়ে লাখের ঘরে পৌঁছতে পারতো। তার বদলে বরং সরকার চেয়েছিল সামান্য হয়রানির বিনিময়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে। তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই পুরো বিমুদ্রাকরণ পদ্ধতির মধ্যে কিছু কিছু loopholes রাখা ছিল যেখান দিয়ে সাধারন মানুষ নিজেদের জন্য আপাততঃ কিছু relief and way outs খুঁজে নিতে পারে। এইভাবে বাস্তবকে address করার মাধ্যমে, উপায় থাকা সত্তেও, শুধুমাত্র জনগণকে necessary relief দেওয়ার জন্য drastic action নেওয়া থেকে বিরত থাকার কারণেই আমার শ্রী মোদীকে জনদরদী মনে হয়েছে। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী যেভাবে সজ্ঞানে তাঁর বিরোধীদের সুযোগ করে দিয়েছেন তাঁর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করবার, তাঁর বিচক্ষণতা নিয়ে কটাক্ষ করবার, কিন্তু তবু তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছেন তার জন্য কোন প্রশংসাই তাঁর উপযুক্ত নয়। আর এইখানেই, আমার মতে, প্রধানমন্ত্রীজির বাস্তবজ্ঞানের সাথে বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদদের পুঁথিগত জ্ঞানের ফারাকের বা সংঘাতের ক্ষেত্র যা হয়তো ভবিষ্যতে ডিমনিটাইজেশনের এক নতুন দিকনির্দেশ করে সামাজিক অর্থনীতির বই-এ এক নতুন unprecedented chapter add করবে। যাঁরা "ডিমনিটাইজেশন ব্যর্থ" বলে প্রচার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলতে চাইছেন তাঁদের কাছে আমার বিনম্র প্রশ্ন, শ্রী নরেন্দ্র মোদী যদি একবারে সমস্ত পূর্ব্বপ্রস্তুতি সেরে হঠাৎ কোনদিন বিমুদ্রাকরণ করতেন তবে সেদিন তাঁকে আপনারা সমর্থন করতেন তো, বা বলা ভাল, কোনরকম সমর্থন কিংবা বিরোধিতা করবার অবস্থায় থাকতেন তো?



ছ) ভবিষ্যতে ভারতবর্ষে পুনরায় বিমুদ্রাকরণ হওয়ার সম্ভাবনা ও তার সম্ভাব্য পূর্বশর্ত


সমস্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা ও পরিস্থিতির সাবধানে বিচার ও বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে যে ২০১৬ সালে ভারত সরকার যে ডিমনিটাইজেশন করেছে তার পিছনে যতটা না উদ্দেশ্য ছিল তাৎক্ষণিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে কালো টাকার সম্পূর্ণ অবলুপ্তি, তার চেয়ে বেশী উদ্দেশ্য ছিল দেশের জনগণকে ডিমনিটাইজেশনের মতো drastic measure-এর সঙ্গে পরিচিত করা ও সাবধান করা। সেই জন্যই সম্পূর্ণ পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়ার আগেই ডিমনিটাইজেশনের সিদ্ধান্ত এবং বাধ্যতামূলক ভাবে কেবলমাত্র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ডিমনিটাইজড্ মুদ্রা জমা করতে না বলে বরং সরাসরি টাকা বদলের সুযোগ দিয়ে কিছু পরিমাণ পর্য্যন্ত পুরোনো মুদ্রায় থাকা কালো টাকাকে নতুন মুদ্রায়ও কালো টাকা হিসাবেই রাখবার সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু এইখানেই বারবার আমার মনে হয়েছে যে কেন? কেন সরকার হঠাৎ তার নাগরিকদের বিমুদ্রাকরণের সঙ্গে পরিচিত করাতে চাইল? তবে কি তার পেছনে আরও গভীর কোন পরিকল্পনা আছে? 



এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি recently নেওয়া ভারত সরকারের আরো কিছু কিছু আপাত unrelated socio-economic measures and decisions-এর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট যোগসূত্র বা pattern লক্ষ্য করেছি।



প্রথমেই দেখুন ব্যাঙ্কের "জনধন অ্যাকাউন্ট"। এগুলি basically small savings account যা মূলতঃ zero-balance হিসাবে চালু করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে সরকার হয়তো সকলের কাছে এই signal-টাই দিতে চেয়েছিল যে অনতিদূর ভবিষ্যতে সরকারের এমন কোন পরিকল্পনা আছে যাতে প্রত্যেক ভারতবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা আবশ্যক হয়ে পড়বে! কিন্তু একইসঙ্গে যেহেতু সরকার চেয়েছিল যে মানুষ এই অ্যাকাউন্টগুলিকে স্রেফ খোলার জন্য না খুলে বরং নিত্যব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সম্বন্ধে অভ্যস্ত হয়ে উঠুন, তাই যখন সরকার লক্ষ্য করল যে বহু মানুষ তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা সত্ত্বেও সেখানে টাকা না রেখে চিরাভ্যস্ত নগদ লেনদেন করতেই উৎসাহী হচ্ছেন, তখন আবার minimum balance-এর নীচে টাকা কাটার কথা ঘোষণা করে মানুষকে তাঁদের সমস্ত সঞ্চয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করতে lead করলো। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে সরকার চায় যেন এমনকি দরিদ্রতম মানুষেরও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকে এবং তাঁরা সময় এবং option থাকতে থাকতেই সেগুলি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন।



তারপর দেখুন, প্রত্যেকটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সাথে "Aadhar number"-কে link করা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা। আধার যেহেতু unique and biometrically identifiable, তাই এই ব্যবস্থা implemented হলেই কিন্তু সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও তাদের মালিকেরাও automatically uniquely traceable হয়ে পড়বেন।



আচ্ছা, তাহলে কি দেখা যাচ্ছে না যে সরকার আস্তে আস্তে ideal ডিমনিটাইজেশনের সমস্ত পূর্বশর্তগুলি পূরণ করবার লক্ষ্যে ধীরে অথচ নিশ্চিত পদক্ষেপে silently কাজ শেষ করে চলেছে? মনে হচ্ছে না কি যেন একমাত্র সব transaction-কে traceable করে তোলার কাজটাই শুধু বাকি? কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য করুন, সেই কাজটাও কিন্তু খুব বাকি নেই।



এখানে দেখুন, GST চালু করার মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি transaction-কে traceable করার প্রয়াস। অনেকে হয়তো তাঁদের highly technical but closed mind দিয়ে মনে করবেন যে GST যেহেতু indirect tax, তাই তার সাথে direct tax related বিমুদ্রাকরণের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা অর্থহীন, কিন্তু আমি যদি বলি যে এক্ষেত্রে শুধু GST-র "indirect tax" nature টা মুখ্য নয়? আমার তো মনে হয় just as an indirect tax system, there is no major difference between VAT or Central Excise and GST, rather the main difference is between their unique pan India applicability added to its system oriented ness. তাই সরকারী দাবী অনুযায়ী GST স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় tax reform শুধু একটিই কারনে, আর তা হল এইবার এর মাধ্যমে দেশের প্রায় সমস্ত transactions-ই uniquely traceable হয়ে পড়বে আর যেহেতু প্রতিটি transaction-এর যোগ থাকবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের যোগ থাকবে আধার নম্বরের সঙ্গে, আবার আধার নম্বরের যোগ থাকবে আয়কর প্যান নম্বরের সঙ্গে, তাই শেষ পর্য্যন্ত প্রতিটি লেনদেন automatically linked হয়ে পড়বে income tax PAN-এর সঙ্গে, that too through a computerised system, almost without any manual intervention.



অর্থাৎ অচিরেই ভারতবর্ষের সরকারী ব্যবস্থাপনা এমন একটি অবস্থায় উপনীত হতে চলেছে যেখানে আয়করের নজর এড়িয়ে কোনরকম আইনসিদ্ধ লেনদেনই বস্তুত অসাধ্য হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে তখন কালো লেনদেনের একমাত্র উপায় পড়ে থাকবে যদি তা নগদে করা যায় আর যদি কোনও ভাবে সরকার তাতেও বাধা সৃষ্টি করতে পারে, তবে হয়তো সত্যিই একদিন এমন আসবে যেদিন ভারতবর্ষ থেকে কালো বা অবৈধ কাজই আর কারোর পক্ষে করা সম্ভব হবে না। সেই আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করতে গেলে সেইদিনই সত্যিকারের প্রয়োজন হয়ে পড়বে প্রায় সম্পূর্ণ বিমুদ্রাকরণের আর কেবলমাত্র তাহলেই ভারতবর্ষের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে কালো টাকার অভিশাপমুক্ত হতে পারবে।



তাই নিজের বিদ্যাবুদ্ধি অনুযায়ী সবদিক বিচার করে আমার তো মনে হয় যে আমাদের দেশ অনতিদূর ভবিষ্যতে আবার বিমুদ্রাকরণ দেখতে চলেছে যখন সত্যিকারের অন্তিম যুদ্ধ হবে অর্থনীতির শুভ ও অশুভের আর সেইদিনের জন্য আমাদের, সাধারণ ভারতবাসীদের প্রস্তুত রাখার উদ্দেশ্যেই হয়েছে ২০১৬ সালের বিমুদ্রাকরণ।



জ) উপসংহার


উপসংহারের শুরুতেই আমার একটা কথা মনে হচ্ছে যা আমি পাঠকদের সঙ্গে share করতে চাই। ভেবে দেখুন তো, যখন একই ব্যক্তি বার বার নতুন করে লাইনে দাঁড়িয়ে একই দিনে একাধিকবার টাকা বদল করেছিলেন তখন তাতে কাদের অসুবিধা হয়েছিল? আমাদের মতো সাধারন মানুষের। কারন তখন এই প্রবণতার কারনে প্রথমতঃ লাইন অনাবশ্যক লম্বা হয়ে পড়ছিল (একই ব্যক্তি একবার টাকা বদল করিয়েও যখন আবার ঘুরে এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছিলেন তখন কোন নতুন লোক লাইনে যোগ না দেওয়া সত্ত্বেও লাইন ছোট হবার সুযোগ পাচ্ছিল না) আর দ্বিতীয়তঃ ব্যাঙ্কের হাতে থাকা নগদ মুদ্রা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছিল বলে অনেককে লাইনে অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পরও টাকা বদল করতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছিল (মোট যে পরিমান টাকা দিয়ে ব্যাঙ্ক ১০০ জনকে টাকা বদল করে দিতে পারে, তার মধ্যে একজনই যদি একবারের জায়গায় ১০ বার নেন তবে বাকি টাকা থেকে ৯৯ জনের বদলে আর মাত্র ৯০ জনকে টাকা বদলে দেওয়া যায় আর ৯ জন, যাঁদের এমনিতে টাকা বদল করতে পারার কথা, তাঁদের খালি হাতে ফিরতে হয়)। এই প্রবণতার জন্য অসুবিধায় পড়ছিলেন সাধারন মানুষ আর অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার উদ্দেশ্যে সেই অসুবিধার কারণ ঘটাচ্ছিলেন কতিপয় কালো টাকার মালিক ও দালাল শ্রেণীর মানুষ। কিন্তু সরকার ও শীর্ষ ব্যাঙ্ক যখন সেইসব অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া সাধারন মানুষের সাহায্যার্থে নিত্য নতুন নিয়ম চালু করে (কখনো টাকা বদলকারীর জন্য পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে কালো টাকা বদলে রাশ টানতে চেয়ে, কখনো আঙুলে কালি লাগানোর মাধ্যমে বার বার টাকা বদল করা আটকাতে চেয়ে, আবার কখনো প্রতিদিন ব্যক্তিপিছু সর্ব্বোচ্চ বদলযোগ্য টাকার অঙ্কে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটিয়ে ব্যাঙ্কের শাখাগুলিতে টাকার supply ও demand-এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে maximum possible লোককে service দিতে চেয়ে) এই অসাধু প্রবণতাতে লাগাম পরানোর চেষ্টা করছিল, তখন অত্যন্ত দুঃখের সাথে দেখেছি আমাদেরই মধ্যে কিছু মানুষ তার মধ্যে সরকারের প্রস্তুতির অভাব ও অস্থিরচিত্ততার উদাহরণ খুঁজছিলেন। একই সঙ্গে কষ্ট ও রাগ হয়েছিল যখন দেখেছিলাম আমাদেরই মধ্যের অনেক ভারতীয় নাগরিককে নিজেদেরই নির্বাচিত সরকারকে প্রতিপক্ষ মনে করে আক্রমণ করতে আর দেখেছিলাম আরো অনেককে সরকারের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহবশতঃ কিছু জনহিতার্থে নেওয়া পদক্ষেপকে সমালোচনায় বিদ্ধ করতে। 



আবার যখন সম্প্রতি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্টে দেখা যায় যে বিমুদ্রাকরণের সময় ভারতীয় অর্থনীতিতে চালু অবস্থায় থাকা বৈধ ডিমনিটাইজড্ মুদ্রার estimated total অঙ্কের প্রায় সমান মূল্যের ডিমনিটাইজড্ মুদ্রা ব্যাঙ্কের ঘরে ফিরে এসেছে, তখন সেই রিপোর্টকেই ডিমনিটাইজেশনের সম্ভাব্য ব্যর্থতার প্রমাণ ধরে নিয়ে অনেক ভারতবাসীকেই উল্লাস প্রকাশ করতে দেখেছি। তখনো একইসঙ্গে দুঃখ পেয়েছি আর এই সমস্ত ভারতীয়দের অন্ধত্বের প্রতি করুণা অনুভব করেছি। 


ডিমনিটাইজেশন সফল না ব্যর্থ তা সময়ই বলবে, কিন্তু তা যে আমাদের একটা ধাক্কা দিয়ে গেছে তা বোধহয় অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই। এবার সেই ধাক্কায় আমরা জাগবো কিনা সেটাই দেখার। বোধের দুনিয়ায় নিদ্রা হয়তো temporary শান্তি দিতে পারে, হয়তো মনে হতে পারে যে ignorance is bliss, কিন্তু ভবিষ্যতে তা বিপজ্জনক প্রমাণিত হতে পারে। ভারতের বর্তমান সরকার আশা করি সাধারন ভারতবাসীর সেই সরল বিশ্বাসে অন্ততঃ আঘাত করতে সফল হয়েছেন যে এই সরকার কেবলমাত্র ভোটের দিকে তাকিয়ে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে থমকে যাবেন না। আশাকরি মানুষ এটুকু বুঝবেন যে বর্তমান ভারত সরকার অন্ততঃ যে কোন মূল্যে অশুভের বিরুদ্ধে তাঁদের যুদ্ধ জারি রাখবেন । আর তার জন্য যদি আবার ডিমনিটাইজেশন হয়, এবং যদি এইবার সরকার তার সমস্ত পূর্বশর্ত পূরণ করে তারপরেই সেই সিদ্ধান্তে আসেন, তবে হয়তো কালো টাকার মালিকদের আর একটুও বাঁচবার সুযোগ থাকবে না। তাই তার আগেই আমাদের মতো সাধারন মানুষকেও তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নগদ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে স্বেচ্ছাচারী বেনিয়মের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদেরকে নতুন ভারতবর্ষের সত্যিকারের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে যোগ্য করে তোলবার। চেষ্টা করতে হবে দায়িত্বহীন ও সরল প্রজা হিসাবে নিজেদের ভাবার মাধ্যমে নিশ্চিন্তে থাকার অভ্যাস ছেড়ে এমন এক নতুন দেশের দায়িত্বশীল ও সচেতন 'রাজা' হবার যেখানে "আমরা সবাই রাজা"। আর তা যদি না পারি? যদি এখনো সরকারের সততা ও অঙ্গীকারকে অবিশ্বাস ও অবজ্ঞা করে নিশ্চিন্তে থাকতে বদ্ধপরিকর হই? তবে শুধু এইটুকুই বলে শেষ করব যে "নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে"। অতএব, সময় থাকতেই সাধু সাবধান ! অসাধু-ও সাবধান !

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?