চাই না 'বাংলা'

পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে 'বাংলা' রাখার প্রস্তাব হয়েছে। রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিশিষ্ট জনেদের মধ্যে বিস্তর তর্কবিতর্কও চলেছে ও চলছে এই নিয়ে। অনেকেই এই প্রস্তাবের সমর্থক, অনেকে আবার অ-সমর্থক (বিরোধী শব্দটি ব্যবহার করলাম না।)। পশ্চিমবঙ্গ নামটা থেকে পশ্চিম শব্দটা মুছে ফেলতে পারলে আমাদের রাজ্যের ঠিক কি সুবিধা হবে সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত। আমাদের রাজ্যের ইতিহাস আমরা বিস্মৃত হব অচিরেই। আজ থেকে ২০০ বা ৩০০ বছর বাদেও কোনো শিশু আর তার মা - বাবার কাছে জানতে চাইবে না কেন তার রাজ্যের নাম 'পশ্চিম'বঙ্গ? তাহলে 'পূর্ব'বঙ্গটি কোথায়? তাহলে কি কোনদিন এই দুইটি স্থান একসাথে ছিল? কেন আলাদা হল? দেশবিভাগের রক্তাক্ত, কলুষিত ইতিহাস ধামাচাপা পড়ে যাবে চিরকালের জন্য। ধামাচাপা পড়ে যাবে ১৯৪৬ এর সুপরিকল্পিত হিন্দুনিধন, ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে, নোয়াখালি দাঙ্গার হাহাকার। কেউ কোনদিন জানবে না যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া সত্ত্বেও গোটা বাংলাকেই ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস ও তার স্বনিয়োজিত পুরোধা জওহরলাল নেহরু অনায়াসে এবং সানন্দে জিন্নাহ্'র ইসলামিক পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে, সমস্ত বাঙালীকে ভারতছাড়া করতে চেয়েছিলেন। আর শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যাঁকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা কিছু কম হয় নি, প্রচুর আলোচনা ও কূটনৈতিক তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে কলকাতাসহ বাংলার এই অংশকে, যা কিনা আজ 'পশ্চিমবঙ্গ' নামে পরিচিত, ভারতের অন্তর্ভুক্ত  করে রাখতে সমর্থ হন। বাঙালী হিন্দুরা একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিল। তাঁদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি অবলুপ্তির হাত থেকে বেঁচেছিল। দেশবিভাগের পর হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পাকিস্তানে বাঙালীদের কিভাবে নির্বিচার গণহত্যা হয়েছিল, সে তো আজ ইতিহাস। সেই পরিণতির দিকে পুরো অবিভক্ত বাংলাকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল কংগ্রেস এবং জওহরলাল নেহরু। আমরা বেঁচেছিলাম ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায়, যদিও তা নিয়েও বিতর্ক আছে এবং বিতর্ক তৈরী করার চেষ্টাও আছে। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ নিজে বাঁচেন নি। কিছুদিন পরেই ড: মুখোপাধ্যায় মারা গিয়েছিলেন কাশ্মীরে। এমন ডাকাবুকো একজন নেতার এমন করুণ মৃত্যু বোধ হয় কল্পনারও অতীত। কাকতালীয় ব্যাপার হল, জওহরলাল নেহরু নিজে 'কাশ্মীরি'। এবং শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নেহরুর নাম।

পরবর্তীকালে পাকিস্তানের বাঙালীরা ভাষা আন্দোলন করে, ভারতের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের কে পাকিস্তানের থাবামুক্ত করে গড়ে তোলে স্বাধীন আলাদা একটি বাঙালী অধ্যুষিত দেশ, বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশও বর্তমানে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র, যেখানে সংখ্যালঘু হিন্দু বাঙালীদের পরিস্থিতি করুণ, যদিও 'বাংলাদেশ' আমাদের 'বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র', পাকিস্তানের মতো তিক্ত সম্পর্ক তাদের সঙ্গে ভারতের নয়।

নাম পরিবর্তনে এই সব ইতিহাস কালের আঁচড়ে মুছে যাবে। প্রশ্ন হল, সেই কি বাঞ্ছনীয়? 'বাংলা' নাম দিয়ে পূর্বপুরুষের যন্ত্রণাময় অতীতকে ভুলব কেন? যেন কিছুই হয় নি, এমন ভাব দেখাব কেন? স্বাধীন আর একটি পড়শী দেশের নামের সঙ্গে ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্যের নামের এত মিলই বা থাকবে কেন? সেটি বাংলাদেশ আর এটি বাংলা। কেন এত নামের মিল যেখানে দেশ দুইটি আলাদা এবং কখনই এক হবে না? এক হবে না কারণ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য কখনই একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের সঙ্গে এক হতে পারে না, দুই রাষ্ট্রের মূল মনোভাবই ভিন্ন। অতএব এই ভিন্নতাকে স্বীকার করে নিয়ে নামের ভিন্নতাও বজায় থাকুক। পশ্চিমবঙ্গ নামের মধ্য দিয়ে, বাঙালীর খণ্ডিত ইতিহাস চিরকাল জ্যান্ত থাকুক। হিন্দুবাঙালীর অস্তিত্বরক্ষা কোনো ইসলামিক দেশে  অসম্ভব। বাংলাদেশের বর্তমান ব্যবহারিক ভাষা ও সংস্কৃতি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। অতীত যত যন্ত্রণাময়ই হোক না কেন, তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে, বাঙালী যে আত্মবিস্মৃত জাতি সেই প্রকল্পটিকে সত্যে প্রমাণিত করার কি প্রয়োজন? 

Comments

  1. Socio-political consciousness... English version would be posted soon

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?