সংখ্যালঘু ভারতীয়: Oxymoron

আমি এ রাজ্যের এক সাধারন নাগরিক। এ ছাড়া কোন বিশেষ পরিচয় আমার নেই। বর্তমানে একটি বিশেষ সামাজিক বিষয়বস্তু নিয়ে আমার মনে কিছু ধন্দের উদয় হয়েছে। সেই নিয়েই এই লেখা। লেখাটি মূলত তর্কধর্মীফলে তার্কিক উদারতার সঙ্গেই এর বিচার করা হবে, এই আশা রাখি।
ইদানীং, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ বিপন্নএমন একটা আওয়াজ উঠেছে প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যমে। দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি; (না, বরং বলা ভালো, পরিবর্তিত রাজনৈতিক composition, যখন ভারতবর্ষের বেশীরভাগ রাজ্যগুলিতে একটি তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী পার্টি অথবা তাদের সহযোগী কোন পার্টি সরকার গঠন করেছে) এর জন্য দায়ী বলে বোধ হয়। এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে জাগছে। 'সংখ্যালঘু' কথাটার তাৎপর্য ঠিক কি? সংবিধান অনুযায়ী, ভারতবর্ষ একটির্মনিরপেক্ষ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে সমস্ত নাগরিকের সমান অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। এমন কটি দেশে, কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায় 'সংখ্যালঘুহিসেবে স্বীকৃত হয় কিসের ভিত্তিতে? যদি তা কেবলমাত্র সেই সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার ভিত্তিতে হয়, তাহলেও তাঁর বা তাঁদের অধিকা সংবিধান অনুযায়ী ভারতবর্ষের অন্য যে কোন নাগরিকের সমান। অর্থাৎ জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংখ্যালঘু হলেও তাঁদের স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার কোন সুস্থ যুক্তি বা সংবিধান গ্রাহ্য কারণ নেই। যদি তাঁরা 'সংখ্যালঘুহন ধর্মের ভিত্তিতে, অর্থাৎ তাঁদের র্ম অবলম্বনকারী লোকের সংখ্যা ভারতবর্ষে কমএই যুক্তিতেতাহলেও কোনভাবেই তাঁদের স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, কেননা ভাতের প্রতিটি নাগরিকের পরিচয় একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে, তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়। ভুললে চলবে না ভারতবর্ষ একটি ধর্মনিপেক্ষ রাষ্ট্র, 'সর্বধর্মসমন্বিরাষ্ট্র নয়। এই দুইয়ের  মধ্যে প্রভেদ আছে এবং তা সহজবোধ্য। অতএব দি আমরা ভারতের সংবিধানের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করি এবং তা মান্য করে চলি, (যা না করা আইনতঃ অপরাধ), তাহলে ভারতের কোন নাগরিকই 'লঘু' নকোন অর্থেই ন, সংখ্যা, জাতি, ধর্ম তাঁর যা- হোক না কেন। আমাদের জাতীয়সঙ্গীতও সেই বাণী ও বোধই বিতরন করে। 
আর যদি ধরে নিই (কোন এক বহুচর্চিত তর্কের খাতিরে) যে কেউ বা কারা ভারতের 'লঘুজন'(সংখ্যাগতভাবে অথবা অন্য যে কোন অর্থে); সেক্ষেত্রে, যুক্তিসঙ্গতভাবে ভাবতে গেলে, তাদের ভালোমন্দের দায়িত্ব বর্তায় ভারতে যারা সংখ্যাগুরু অর্থাৎ কোন না কোন অর্থে যারা 'গুরু'জন, তাঁদের উপর। ঠিক যেমনভাবে পরিবারের minorদের দায়িত্ব থাকে বাড়ির বড়দের উপর। বড়রা অভিভাবকত্ব করেন। অনেক ক্ষেত্রেই সেই অভিভাবকত্ব বাড়ির minor সদস্যদে পছন্দসই হয় না, কিন্তু মানতে তারা বাধ্য থাকে। ঠিক সেইভাবেই ভারতের সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার কর্তব্য যুক্তিসঙ্গতভাবেই সংখ্যাগুরুদের এবং সেই কর্তব্য পালন করার জন্য দেশের কোনো তথাকথিত সংখ্যালঘু সদস্য / সদস্যবর্গের সঙ্গে আলোচনা করতে তাঁরা বাধ্য হতে পারেন না। অর্থাৎ, উদাহরনস্বরূপ, মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকার যদি কোন নীতি প্রণয়ন করেন, তবে তার জন্য কোন মুসলিম ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনা করে সেই নীতি নির্ধারণ করা বাধ্যতামূলক হতে পারে না। কারণ সকল মুসলিমই সেক্ষেত্রে 'লঘু' সম্প্রদায়ভুক্ত, এমনকি বৃদ্ধ মুসলিমরাও। এই যুক্তি আপাতভাবে যতই অস্বস্তিকর লাগুক না কেনর্মের ভিত্তিতে কাউকে লঘু করে দেখালে, সেই লঘুত্বকে যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার করতে গেলে তা এমনই অস্বস্তির জন্ম দেবে। 'লঘু'র মঙ্গলার্থে 'গুরু'রা যা সিদ্ধান্ত নেবেন, 'লঘু'র তা-ই মেনে নেওয়া উচিত যদি ভারতের নাগরিক-জীবনে তাঁরা নিজেদের কোনপ্রকার 'লঘু'ত্ব স্বীকার করে নেন। অর্থাৎ যৌক্তিকতার ভিত্তিতে 'লঘুত্ব'  'সমানাধিকার' একই সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে না। অথচ সংবিধানঅনুযায়ী সকল নাগরিকের সমানাধিকার স্বতঃসিদ্ধ। অতএব, তার্কিকতার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে, 'সংখ্যালঘু', এই ধারনাটিই ভারতবর্ষের মত স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অর্থহীন। তাঁরা হয় ভারতীয়, নয় তো নন। 'সংখ্যালঘু ভারতীয়' আসলে একটি oxymoron, অর্থাৎ 'কাঁঠালের আমসত্ত্ব' জাতীয় একটি অবাস্তব ধারণা এবং একটি ভণ্ডামি বিশেষ।
কেবলমাত্র সংখ্যালঘুএই যুক্তিতে কিছু বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে বছরের পর বছর ধরে কিছু বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিয়ে, তাঁদেরকে ভারতীয় নাগরিক সমাজের মূলস্রোতে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না এবং এর দ্বারা তাঁদের মনুষ্যত্বকেও ক্রমাগত খাটো করা হচ্ছে। কেবলমাত্র সংখ্যালঘুএই যুক্তিতে যদি কাউকে বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিতে হয়, তবে তো কোটিপতিরাই এ দেশে সবচাইতে সংখ্যালঘু। এই কারণে নিশ্চয় কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই ধনী ব্যক্তিদের বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব (যদি ওঠে) সমর্থন করবেন না। বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার সংরক্ষণ যদি দিতেই হয়, তবে দেওয়া উচিত অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের। তাঁদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে এবং তা-ও বরাবরের জন্য নয়, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণ হোক তাঁদের উন্নয়নের পাথেয়, চিরকালের জন্য অক্ষম, দুর্বল থেকে যাওয়ার অজুহাত নয়।
সময় এসেছে সমস্ত ভারতীয়কে একই নাগরিক মানদণ্ডে বিচার করার। সময় এসেছে জাতি, ধর্মবর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সকল ভারতীয়ের জন্য এক ও অভিন্ন দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিধি চালু করার। তাহলেই আমরা পারব ধীরে ধীরে বাবাসাহেব আম্বেদকরের দেখা স্বপ্নের caste-free ভারতবর্ষের দিকে এগিয়ে যেতে।
অতএব, বন্ধ হোক সংখ্যালঘুদের জন্য এই কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন। বন্ধ হোক ভারতীয় নাগরিকদের একটি বড় অংশকে 'সংখ্যালঘু' বলার মাধ্যমে ভারতের সংবিধানের পরোক্ষ অবমাননা। অথবা যদি এইগুলির কোনটিই সম্ভব না হয়, তবে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে 'ধর্মনিরপেক্ষ' রাষ্ট্র না বলে, 'সর্বধর্মসমন্বিতরাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হোক

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?