সাম্প্রদায়িকতা: প্রকৃতপক্ষে কি? Part II


সাম্প্রদায়িকতা মন্দ কিসে? এটাই তো বুঝলাম না! এটা জানি যে 'সাম্প্রদায়িকতা', কথাটি শোনামাত্র আমাদের বেশির ভাগ মানুষের মনে একটা নেতিবাচক দ্যোতনার উন্মেষ ঘটে; যেন এটি একটি সর্বতো ও সতত বর্জনীয় বিষয়। গেল গেল রব! আপনার চিন্তাভাবনায় সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ, তার মানেই আপনি সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক, সম্প্রীতির বিরোধী! এই হল প্রচলিত ধারনা! কিন্তু তাই কি সত্যি? চলুন একবার সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞাটাকে ঝালিয়ে নিই।




সাম্প্রদায়িকতা, অর্থাৎ আলাদা আলাদা মানুষকে তার সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য ও দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তিতে পৃথক দৃষ্টিতে দেখা, ভাবা এবং সেই অনুযায়ী তাদের শ্রেণীবিভাগ এবং তাদের social & preferential standpoint mapping করা। কিন্তু এটা মন্দ কিসে? বরং এর দ্বারা তো প্রতিটি মানুষের নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাদের মধ্যেকার বৈচিত্র্য ও চাহিদাগুলির যথার্থ সম্মান করা যায়। একমাত্র সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলেই প্রতিটি মানুষের নিজস্বতাকে যথার্থ মান্যতা দেওয়া যায়। আর সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সব মানুষকে ঢালাও এক নিয়মে বিচার করা বা এক ছাঁচে তাঁদের ফেলতে চাওয়াই তো বরং তাদের নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে অগ্রাহ্য করা! সেই কি বাঞ্ছনীয়? নাকি মানুষে মানুষে ঐক্য ও সম্প্রীতির পাশাপাশি তাদের আভ্যন্তরীন বৈচিত্র্র্যকেও সম্মান করা উচিত? সাম্প্রদায়িকতা, অর্থাৎ সম্প্রদায়-নির্ভরভাবে মানুষের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, নিয়মকানুন, অগ্রাধিকার ইত্যাদি বিবেচনা করা! যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে এই 'সাম্প্রদায়িকতা' অত্যন্ত সমীচীন, কারণ তাতে কোন মানুষই অবহেলিত বা কোণঠাসা অনুভব করবেন না। প্রত্যেকেই নিজের প্রাপ্য গুরুত্ব অনুভব করতে পারবেন। ভারতবর্ষের মতো দেশ, যেখানে এত ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সম্পদের এত বৈচিত্র্য, এত বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায় ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য, সেখানে পৃথক, পৃথক সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের স্বীকার্যতা, আমার মতে, অত্যন্ত বাঞ্ছনীয় এবং দেশের সর্বাঙ্গীন ঐক্যের পক্ষে অতি অনুকূল।




এই যুক্তিই অনুসরন করে মুসলমান সমাজ, তাদের ঐক্যবদ্ধতার জন্য, তাদের সার্বিক সামাজিক স্বার্থরক্ষার জন্য। এবং ভারতবর্ষ তাদের সেই, 'সাম্প্রদায়িকতা'কে অর্থাৎ ইতিবাচকভাবে বলতে গেলে, সম্প্রদায়-সচেতনতাকে স্বীকার করে। ভারতবর্ষে তাদের জন্য পৃথক ব্যক্তিগত আইন আছে এবং তাদের আরও নানাবিধ আচরনকে ভারতবর্ষ স্বীকৃতি দেয়। এর ফলে, মুসলমান সমাজ তাদের সার্বিক সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য বজায় রাখতে পারে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করলে আমার মুসলমানদের এই সাম্প্রদায়িক চেতনাকে অর্থাৎ সম্প্রদায় সচেতনতাকে অযৌক্তিক বলে মনে হয় না।



ঠিক এই একই কারণে, অন্যান্য নানা সম্প্রদায় ও ধর্মাবলম্বী মানুষও যদি সম্প্রদায়-সচেতন হয়ে ওঠেন, মন্দ কি? বরং ভালো, কারণ ভারতবর্ষ তার নানা বৈচিত্র্যের পূর্ণ প্রকাশ সে ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করতে পারবে। ভারতবর্ষের হিন্দুসমাজও যদি তাদের সম্প্রদায়-বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে এবং সেগুলিকে প্রকাশ করতে থাকে, তবে সেই 'সাম্প্রদায়িকতা'কে সুস্বাগতম। বরং হিন্দুসমাজের মধ্যে তাদের সম্প্রদায়-বৈশিষ্ট্য নিয়ে সচেতন আবেগের বহিঃপ্রকাশ কম। কিন্তু তা বলে কি তাদের সংস্কৃতির সমৃদ্ধি বা গভীরতা কম? বরং গভীরতা এতই বেশী যে হিন্দুদের মধ্যে তাদের সম্প্রদায় বৈশিষ্ট্য তাদের অন্তরের গভীরে প্রোথিত। এতই গভীরে যে সেটি তাদের জীবনের অঙ্গে পরিণত হয়েছে। হিন্দুদের এই ঋদ্ধ, অতি প্রাচীন সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত হোক। 'সাম্প্রদায়িকতা'ই প্রদর্শিত হোক। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি, সমস্ত সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশিত ও প্রদর্শিত হোক। মুসলমানদের কথা আর আলাদা করে বললাম না, কারণ তাঁদের সাম্প্রদায়িকতা তাঁরা প্রকাশ করেই থাকেন এবং অত্যন্ত সাবলীলভাবে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, 'সাম্প্রদায়িকতা' শব্দটি তবে এত বর্জনীয় কেন? কথাটি একটি অনৈতিক কথা বলে প্রতিভাত হয় কেন? সম্ভবতঃ 'সাম্প্রদায়িকতা' কথাটিকে কিছু ভুল অর্থে আমরা প্রয়োগ ও উপলব্ধি করি। সাম্প্রদায়িকতা বলতে আমরা বুঝি নানা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেকার আবেগের বিভিন্নতাকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদ সৃষ্টি করাকে, পাওয়া না পাওয়ার প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব উস্কে দেওয়াকে এবং তার ফলে তাদের মধ্যে বঞ্চনার অনুভূতি সৃষ্টি করাকে।




কিন্তু এগুলি তো 'সাম্প্রদায়িকতা' নয়, বরং 'সাম্প্রদায়িকতা'র অপব্যবহার।




প্রশ্ন হল, আধুনিক ভারতবর্ষে কি সাম্প্রদায়িকতাকেই বর্জন করা উচিত, না কি সাম্প্রদায়িকতার অপব্যবহারকে? আমার বন্ধুদের কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

মমতার সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতির শিকড় দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের স্পৃহার মধ্যে

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?

Radical Forces Spreading Tentacles: Bangladesh to West Bengal to Jharkhand