সাম্প্রদায়িকতা: প্রকৃতপক্ষে কি? Part III

সাম্প্রদায়িকতা কি, এই নিয়ে আলোচনাটা ক্রমেই আমার নিজের কাছেও তার নানা রং, রূপ বিস্তার করে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়ে উঠছে। আচ্ছা, বলুন তো, সাম্প্রদায়িকতা মানে কি শুধু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা? তাই কি? সম্প্রদায় বিভাগ তো নানাপ্রকারের হয়, যেমন ধরুন, ঘটি-বাঙাল। ঘটি-বাঙালের রেষারেষিও কি এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা নয়? তা বলে কি আমরা তা নিয়ে আদৌ লজ্জিত? না, লজ্জিত তো নয়ই, বরং এই সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা উপভোগ করি। নানা রসস্থ দ্বন্দ্বে সমৃদ্ধ এই ঘটি-বাঙাল সাম্প্রদায়িকতা।


অথবা ধরুন তামিল-তেলুগু সাম্প্রদায়িকতা কিংবা তামিল-মালয়ালাম সাম্প্রদায়িকতা। একজন তামিলকে আমি বলতে শুনেছি , "একটি সাপকে বিশ্বাস করতে পারো, কিন্তু একটি মালয়ালীকে নয়"। আবার গুজরাতী ও পাঞ্জাবীর মধ্যেও আছে প্রাদেশিকতার দ্বন্দ্ব। গুজরাতী মহিলারা খুব চিন্তিত থাকেন তাঁদের পুত্রেরা কোনো পঞ্জাবী মেয়েকে বধূ নির্বাচন করে ফেলবে কি না, তাই নিয়ে। ওঁদের অনীহা পাঞ্জাবী মেয়েরা মুরগী ইত্যাদি আমিষ খাদ্য গ্রহন করে অভ্যস্ত, অতএব গুজরাতী পরিবারের শুদ্ধ নিরামিষাশী খাদ্যসংস্কৃতিকে দূষিত করতে পারে পাঞ্জাব-দুহিতা। এই প্রাদেশিক দ্বন্দ্বগুলিও সন্দেহাতীতভাবে একধরনের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব। কিন্তু এইগুলি নিয়ে কেউই খুব সিরিয়াস নয়। বরং আমাদের রোজকার পানসে জীবনে এই ধরনের 'সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব' কিছুটা চাট মশলার মত। টিভি সিরিয়ালগুলি নিত্যদিন এইসব অম্লমধুর সাম্প্রদায়িকতার চাটনী পরিবেশন করে চলেছে এবং দেশজুড়ে মানুষ সেই চাটনী'র স্বাদ ও ঝটকায় কুপোকাৎ! 'সাম্প্রদায়িকতা' বলতে মানুষ এই ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে বোঝে না।


বাঙালী-অবাঙালীদের মধ্যে যে ভেদাভেদ, তাদের ভাষা, রীতি, আচার ও খাদ্যাভ্যাসের যে পার্থক্য এবং সেই পার্থক্যের যে প্রকাশ, সে ও কি সাম্প্রদায়িকতা নয়? এবং সেই সাম্প্রদায়িকতা কি খুবই স্বাভাবিক নয়? সমমনস্ক এবং সম-সংস্কৃতির মানুষের একত্রিত হওয়াই হল সম্প্রদায়-গঠন এবং তা অবশ্যম্ভাবী এক জৈব প্রবৃত্তি। Birds of same feather flock together. একেই বলে সাম্প্রদায়িকতা। তাকে অস্বীকার করা মানে প্রকৃতিকে অস্বীকার করা।


কিংবা ধরুন, পেশাগত সাম্প্রদায়িকতা। আপনার যদি অসুখ করে, তাহলে আপনি একজন ডাক্তারই ডাকবেন, প্লাম্বার নয়। এ-ও কি ডাক্তার সম্প্রদায়ের প্রতি আপনার পক্ষপাতীত্ব নয়? আবার ছাদে বৃষ্টির জল বসে গিয়ে ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আপনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ডাকলেন, ইলেকট্রিশিয়ান না ডেকে। এ কি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সম্প্রদায়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া এবং ইলেকট্রিশিয়ান সম্প্রদায়কে অবহেলা করা নয়? আপনি হয়ত বলবেন, যার যা কাজ! তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কি সম্পর্ক? কিন্তু এই কর্মবিভাগও আসলে একধরনের সাম্প্রদায়িক বিভাজন। কর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু তা নিয়েও আমরা অত চিন্তিত বা উত্তেজিত বোধ করি না। বরং কর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা সমর্থন করি। ধরুন একজন সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, যিনি কোন কোম্পানীর সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বিদেশের কোন ক্লায়েন্ট কোম্পানীতে বসেন, তাঁর প্রতি সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতীত্ব প্রদর্শন না করার জন্য যদি তাঁর বদলে একজন উকিলকে আমরা ওই একই কাজে নিয়োগ করি এবং সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে উকিলের কাজে বহাল করি, তাহলে কি কার্যসিদ্ধি হবে? অনেকেই ভাববেন, 'এ আবার কি ধরনের এঁড়ে তক্কো? উকিলের কাজ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে, ইঞ্জিনিয়ারের কাজ উকিল দিয়ে আবার হয় নাকি?' ঠিকই ধরেছেন, হয় না। কিন্তু সে ও অবশ্য একধরনের সাম্প্রদায়িকতাই। পেশাগত সাম্প্রদায়িকতা। এবং একমাত্র এই পেশাগত সাম্প্রদায়িকতাকেই আধুনিক মননশীল মানুষ সাদরে স্বীকৃতি দেন। এবং শুধু স্বীকৃতিই দেন না, বরং এই সাম্প্রদায়িকতারই জয়জয়কার চলেছে বিশ্বজুড়ে! অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা মানেই বর্জনীয় নয়, কোন কোন সাম্প্রদায়িকতা অত্যন্ত গ্রহনীয়!


সর্বোপরি, ধরুন, মানবতাবাদীদের কথা। তাঁরা মানবতা, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে সাধু সচেতন। সেও সাম্প্রদায়িকতা! শুধু যে মানবতার কথাই ভাবতে হবে, 'না-মানুষ'দের অগ্রাহ্য করলেও চলে, এই বা কেমন যুক্তি? মানবতাবাদীরাও সে অর্থে 'না-মানুষ' অথবা জান্তব সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে 'সাম্প্রদায়িক'। একটি বাঘের হাত থেকে একটি মানুষকে বাঁচানোর জন্য আমরা যদি বাঘটিকে হত্যা করি, তবে সেও সাম্প্রদায়িকতা। বাঘটি তার ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য মানুষটিকে খেতে এসেছিল, সে তো তার জন্মগত জৈবিক অধিকার! তবে তাকে মরতে হল কেন? সে ও বাঘের বিরুদ্ধে মানুষের সাম্প্রদায়িক বিভেদ-চেতনারই প্রকাশ মাত্র।
কিংবা ধরুন  রক্ষনশীলদের সঙ্গে উদারবাদীদের যে মতপার্থক্য তা ও কিন্তু সাম্প্রদায়িকতাই। নিজের নিজের চিন্তন-সম্প্রদায়ের পক্ষে প্রত্যেকেই দাঁড়ায় এবং সেটাই স্বাভাবিক।


আর একটি বিশ্বজোড়া সাম্প্রদায়িকতা হল নারী-পুরুষ সাম্প্রদায়িকতা, যেটা আবার এতই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এবং তাতে পারস্পরিক রেষারেষি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে তার জন্য আবার পৃথিবীতে একটা নতুন সমস্যার জন্ম হয়েছে। তার নাম, 'লিঙ্গবৈষম্য'!


কিংবা ধরুন শাশুড়ী-বউমা সাম্প্রদায়িকতা! এত ঘটনাবহুল, এত জনপ্রিয়, এত সর্বজনীন, এত খাঁটি অথচ এত বিভেদকামী সাম্প্রদায়িকতা পৃথিবীতে আর কি আছে? কিন্তু এই সাম্প্রদায়িকতাকেও মানুষ অতি স্বাভাবিক বলেই সানন্দে স্বীকৃতি দেয়।
অর্থাৎ, সাম্প্রদায়িকতা ভিন্ন জীবন বৃথা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা সাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িকতা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু তাহলে, 'সাম্প্রদায়িকতা' শব্দটির প্রতি আমাদের এত অনীহা কেন? কেন একটা নিরীহ শব্দ এমন ভয়ংকর ও বিকট অর্থবহ হয়ে উঠল? কি সেই কারণ, কি সেই মনস্তত্ব? সেই বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি আলোচনা করব আগামী এবং এই লেখার শেষ ভাগে।


বন্ধুদের মতামত সাদরে প্রার্থনীয়।

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?