স্বপ্ন রবীন্দ্র
আজ বড় সকাল সকাল ঘুম ভাঙল এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। ভোরের দিকে, আবছা হয়ে আসা ঘুমের ঘোরে কাকে দেখলাম জানেন? রবীন্দ্রনাথ। কি যেন বলছিলেন ক্রান্তদর্শী, তার সবটা বুঝতে পারিনি, যদিও তাঁর কথার অর্থ সম্যক বুঝতে পারব এমন আশাও করি নি। স্বপ্নের ঘোরে ওঁর ভাষা, আমার অনুলিখন। তাই এতে যা কিছু ভ্রান্তি, তা নিতান্তই এই অধমের।
"ইহা আমারই ব্যর্থতা যে এত দূর পর্যন্ত আমি দেখিতে পাই নাই। ভাবিয়াছিলাম, "কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা"! কিন্তু তাহা হয় নাই! প্রকাশের ব্যথা দূর হইবার পরিবর্তে প্রকাশের প্রয়োজনই দূরীভূত হইয়াছে। কেহই কাহারও নিকট আজ আর কোন কিছুই প্রকাশ করিতেছে না, সকলে সকলকে কেবলই উত্তমমধ্যম গালি পারিতেছে। প্রবল যন্ত্রণা বুঝিবা সহ্য করিয়া লওয়া যায়। কিন্তু এই প্রকার অসার যন্ত্রণাহীনতার যন্ত্রণা? তাহা কি সহে? আজ মনে হইতেছে, ইহাও পরমেশ্বরেরই লীলা। আমাকে তিনি আমার আলোকময় সোনার বাংলার এমন নিকষ আঁধারের উপলক্ষ্য করিয়াছেন। আমার প্রকাশের তাড়না সকল মাটির মানুষের প্রকাশের ক্ষমতাই কাড়িয়া লইয়াছে। ইহা আমার সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য তাহা বুঝি নে।
ভাবিয়াছিলাম, "সংসার মাঝে দু একটি সুর, রাখি দিয়া যাব করিয়া মধুর, দু একটি কাঁটা করি দিব দূর। তার পর ছুটি লব।" ইহাই বোধ করি ভুল হইয়াছিল। মাটির উপরে মাথা উঁচাইয়া রওয়া কাঁটাগুলিকেই দেখিয়াছিলাম। ভূমির অভ্যন্তরে যে অগণ্য কন্টকাকীর্ণ নিম্নস্তর, তাহা অনুভব করি নাই। তাই, আজ যেথা নবযুগের বাতাস আসিয়া উপরস্থ ভূস্তর সরাইয়া দিয়াছে, তখন তাহার কন্টকাচ্ছাদিত নিম্নস্তর নগ্ন হইয়া পড়িয়াছে। উহার উপর দাঁড়াইবই বা কি করিয়া? কন্টক দূর হইবে কেমনে?
বিশ্বমানবতার মাঝে যে এক ও অদ্বিতীয় বিরাট হিয়ার সুর ও বাণী ধ্বনিত হয়, তাহা সকলকে শোনাইতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু তাহারা যে পরবর্তী সময়ে বিশ্বমানবতাবাদ হইতে মানবতা কেই বাদ দিয়া দিবে, ইহা ভাবিতে চাহি নাই। ইহা আমারই ব্যর্থতা, আমারই বোধ ও চিন্তনের দৈন্য! 'ঘরে বাইরে'র সন্দীপকে দেখিয়াছি, তথাপি অনুমান করিতে পারিলাম না কেন যে উদারবাদ লইয়াও সন্দীপের দল অচিরেই বেসাতি শুরু করিয়া দিবে এবং সেই ব্যবসায় দেশ ও কালের সীমা লঙ্ঘন করিয়া মানুষের অন্তর্মনকেও বিক্রয় করিবার উদ্যোগ লইবে?
উদারতার মূল্য বুঝিতে হইলে কঠোর অনুশাসনের মধ্য হইতেই বুঝিতে হয়। আমার বাংলাভূমি অনুশাসনকেই অনুদারতা জ্ঞান করিল!? ইহা আমার ব্যর্থতা ভিন্ন আর কি? আমারই কথার অপপ্রয়োগকৌশলের দ্বারা সকল মানুষকে অভিভাবকহীন, অনুশাসনহীন করিয়া তুলিল! মানবতাবাদের নামে মানবতার এই চরম অবমাননা? পরমেশ্বরের এ কেমন লীলা?
বিশ্বমানবতাপথের যাত্রী হইতে গেলে আপন জন্মভূমির মৃত্তিকাতিলক কপালে আঁকিয়া লইলে মানবতার যাত্রাপথে দেশজননীর আশীর্বাদ সদা অক্ষয় হয়। ইহারা সাম্যের নামে জাতীয়তাবোধ কে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া বিশ্বমানবতার অনুসন্ধান করিবার কৌশল করিতে গেল! সকল বেসাতি-আয়োজনের মাঝে মানবতা ই ফাঁকিতে পড়িল।
হিন্দু সমাজ ও মুসলমানগণের ভিতর যে সম্প্রীতি ও সখ্যের স্বপ্ন আমি দেখিয়াছিলাম, তাহাকে সত্য করিয়া তুলিতে গেলে পরস্পরের দোষ ও গুণ, উভয় বিষয়েই জ্ঞান ও সম্ভ্রমের প্রয়োজন ছিল। ইহারা সম্ভ্রমের পরিবর্তে অনন্ত ভ্রমের আয়োজন করিয়া বসিয়াছে। মুসলমানকে সকলবিধ উপায়ে তুষ্ট করিবার আয়োজনের মধ্য দিয়া ইহারা দরিদ্র মুসলমানের সকলপ্রকার পরিশীলনের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে। যে শিশুর সকল আবদার রক্ষা করা হয়, ইহা নিশ্চিত যে সে গৃহের কেহই সেই শিশুর প্রকৃত হিতাকাঙ্খী নহে। এবং সেই শিশুর পক্ষেও বুঝি ভবিষ্যতের সুনাগরিক হওয়া অসম্ভব। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের 'বর্ণপরিচয়' এ উল্লিখিত ভুবন ও তাহার মাসির কথা মনে পড়িতেছে। শিশুকাল হইতে ভুবনের মাসি ভুবনের সকল অনাচার মানিয়া লইয়া, তাহাকে অত্যধিক প্রশ্রয় দিয়া লালন করিবার ফলে ভুবনের যেদিন জেল হইল, সেই দিন সে মাসির নিকট কাঁদিয়া অভিযোগ করিয়াছিল, সময় থাকিতে মাসি কেন তাহাকে শাসন করেন নাই! মুসলমানদিগকে ভালোবাসিবার ছল করিতে গিয়া উহাদের চরম আত্মিক সর্বনাশের দিকে ঠেলিয়া দেওয়া হইয়াছে। বুঝি নাই যে মিথ্যার বেসাতি করিতে গিয়া ইহারা আপনাদিগের ও বিশ্বমানবেরও চরম সর্বনাশ করিয়া বসিবে। আমার সকল প্রকাশকে চরম অপ্রকাশের অতলে তলাইয়া যাইতে দেখিয়া বারংবার বলিতেছি, সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।"
ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি, বিদায় নিয়েছেন কবি!
Comments
Post a Comment