DA ও সারমেয়ত্বপ্রাপ্তি

গত পরশুদিন সরকারি কর্মচারীদের সভায় মুখ্যমন্ত্রী এমন একটি মন্তব্য করেছেন, যাতে সরকারি কর্মচারীরা তো বটেই, আপামর জনসাধারণও বিচলিত এবং ক্ষুব্ধ। মুখ্যমন্ত্রী কি করে সরকারি কর্মচারীদের ঐ ভাষায় পরোক্ষে (নাকি সরাসরি?) কুকুর-বেড়ালের সঙ্গে তুলনা করতে পারলেন? ওঁর এই মন্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল! এই বিষয়েই আমারও দু একটি সামান্য কথা আছে। 


প্রথমেই বলি, আমি কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন বক্তব্যে আদৌ আশ্চর্যান্বিত হইনি বরং ওঁর এই মন্তব্য নিয়ে মানুষের over-reaction ই আমাকে অনেক বেশী হতাশ ও বিরক্ত করেছে। বাংলার মানুষের এই দ্বিচারিতা, এই চিন্তাহীনতা যেন আর সহ্য হচ্ছে না! আপনারা কি জানতেন না যে উনি এই ভাষায় কথা বলেন? কই এত দিন তো কেউ আপত্তি করেন নি? ওঁর ভাষা ও ভঙ্গী নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন গণপ্রতিবাদ হয়েছে কি? তাহলে আজ কেন? কি এমন নতুন ঘটল যে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী চিরকাল যে ভাষায় কথা বলে এসেছেন সেই ভাষায় আজ কথা বলাতেই আপনারা ক্ষুব্ধ হলেন? নাকি তিনি আপনাদের দীর্ঘপ্রতিক্ষিত এবং ন্যায্য DA না দিয়ে রেখেছেন বলেই এবং সেই বিষয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করেছেন বলেই আপনাদের এই ক্ষোভ? অর্থাৎ ক্ষোভ আসলে ওঁর ভাষার বিরুদ্ধে নয়, ক্ষোভ ব্যক্তিগত কারণে! এইখানেই মূল সংকট! 


কলকাতা একসময় ছিল ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানী। এখনও বহু মানুষ চিরাচরিত অভ্যেসের বশে বলে যান যে বাংলার মানুষ নাকি বোদ্ধা, সংস্কৃতিবান, চিন্তক এবং সংবেদনশীল! কথায় কথায় বাংলার মনীষীদের reference দেন আপনারা। এই কি সেই সংস্কৃতিচেতনা? যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ আহত হল ততক্ষণ পর্যন্ত মমতার কটুভাষ্যের প্রতিবাদ কেউ, কক্ষনোও, কোনওদিনও করলেন না? অর্থাৎ none of you could ever stand up for a cause, the cause being protesting against usage of indecent language by people's representatives? কোথায় সেই বাংলা যারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভারতবর্ষকে নেতৃত্ব দিয়েছিল? কি এমন ঘটল যে যে বঙ্গহৃদয় গোটা বিশ্বকে নিজের ভিতর সন্নিবিষ্ট করতে পারত, সেই বঙ্গহৃদয় সংকুচিত হতে হতে আজ কেবল একটি ১০ ফুট বাই ১০ ফুট কামরায় উপনীত হয়েছে? কেবলমাত্র একান্ত ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত না লাগলে কেউ টুঁ শব্দটি করছেন না? এমনকি ভালোমন্দ, ঠিকভুলের তফাৎ পর্যন্ত ঠিকঠাক বুঝতে পারছেন না? 


আচ্ছা বলুন তো, বাংলার রাজনীতিতে কুকথা ও অশালীন ভাষার ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল? মনে করতে পারছেন কি? মমতা যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখনও তিনি এই ভাষায়ই কথা বলতেন এবং সেই দোর্দন্ডপ্রতাপ সিপিএম (মমতার ভাষায় সিপিয়েম) জমানায় তাঁর মন্তব্যগুলিকে প্রচুর কাটাছেঁড়া করা হত এবং মূলতঃ সেগুলিকে laughing stock মনে করা হত। সিপিএম জমানায় মমতার কথা ছিল নেহাৎই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয় এবং বাংলার অধিকাংশ মানুষের কাছে favourite timepass. কিন্তু তার মধ্যেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল মমতার জনসমর্থন। ঐ আপাত তুচ্ছতাচ্ছিল্যের মধ্যে দিয়েই বহু মানুষ নিজেদের অজান্তেই মমতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিলেন। বহু মানুষ ওঁর ঐ rustic, অশালীন অথচ candid বক্তব্যের ধরনের সঙ্গে নিজেদেরকে একাত্ম করে তুলতে পারছিলেন। বাংলার বুকে বহতা প্রবল সিপিএম স্রোতের নীচে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো একটা মমতামুখী undercurrent তৈরী হচ্ছিল। সে কিন্তু মূলতঃ মমতার ঐ অপরিশীলিত মন্তব্যগুলির জন্যই। জানবেন তীব্র বিকর্ষণ কিন্তু তীব্র আকর্ষণেরই উল্টো পিঠ। 


ধীরে ধীরে বাংলার মানুষ মমতার অশালীন ভাষাকেই সিপিএমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বলে ধরে নিলেন। মমতা হয়ে উঠলেন প্রতিবাদের মুখ, মূলতঃ সিপিএম এর বিরুদ্ধে অপভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে। মমতা কি বলছেন তার উপর মানুষ অত মনোনিবেশ করেন নি, কিভাবে বলছেন, কতটা নির্ভীকতার সঙ্গে তিনি অশালীন কটুভাষ্য করছেন সেটাই মানুষকে তৃপ্ত করেছিল। সিপিএমের বিরুদ্ধে তাদের ত্রিদশকর্দ্ধো চাপা রাগ মমতার মুখ দিয়ে অশালীন ভাষা হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে যদি বলি বাংলার রাজনীতিতে অশালীন ভাষার চর্চা শুরু হয়েছে মমতার মাধ্যমে, তবে সত্যের অপলাপ হবে। অশালীন, কুৎসিত কথা ও হুমকির দ্বারা ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে মানুষের কণ্ঠরোধ করার সংস্কৃতি বাংলায় প্রবেশ করেছিল তথাকথিত মুক্তমনা বামপন্থীদের হাত ধরেই। কিন্তু অতি-বামপন্থী মমতার হাত ধরে সেই অপসংস্কৃতি গোটা পশ্চিমবঙ্গে pathological হয়ে উঠল। বামপন্থী জমানায় originally ভদ্র পরিবারের ছেলেরা বাম রাজনীতির দৌলতে haughty, obstinate, domineering & despotic হয়ে উঠেছিল এবং ধীরে ধীরে তাদের দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছিল আর অতি-বামপন্থী মমতার জমানায় দুর্বৃত্তরাই রাজনৈতিক ক্ষমতার helm এ পৌঁছে গেল।


২০১১ র বিধানসভা নির্বাচনের আগে যখন সিপিএম এর স্বনামধন্য অনিল বসু, আনিসুর রহমানের মত নেতৃবৃন্দ মমতারই কটুভাষ্যপন্থা অবলম্বন করে মমতাকেই জঘন্য ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসলেন, তখন বাংলা already মমতা-opioid এ intoxicated. এবং তার ঘোরেই বাংলার মানুষ ওই সব 'হার্মাদ' (মমতার ভাষায়) নেতাদের কটুভাষ্যের প্রতিবাদ করেছিল। অর্থাৎ সেখানেও প্রতিবাদ হয়েছিল not for a cause but for the personal choice.  সেই সময় মানুষের মমতাকে পছন্দ, তাই ওঁর অশালীন ভাষা উচ্চারন কোন বিশেষ দোষের নয়, আর সিপিএমকে অপছন্দ, তাই তাঁরা কটুবাক্য বললেই তা ঘোর অন্যায়! 


আমার প্রশ্ন হল, 'যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা', এই দ্বিচারিতা থেকে কবে মুক্ত হবে বাংলার মানুষ? কবে Bengal would be free from this shameless practice of personal bias, selectivity & specificity? 


তারপর ২০১১ য় এল বাংলার সেই তথাকথিত ঐতিহাসিক "পরিবর্তন" এর নির্বাচন। বাম সাম্রাজ্যবাদকে বাম সাম্রাজ্যবাদের অস্ত্রেই পরাস্ত করে এবং প্রচুর টাকা ছড়িয়ে (কোথা থেকে এল সেই টাকা? জানেন না আপনারা?) নির্বাচনে জিতলেন অতি-বামপন্থী মমতা। বাংলার মানুষ ওঁর উপর পুষ্পবৃষ্টি করলেন। 


তারপর থেকে গত ছ'বছরে উনি যে কত অজস্র বার, কত অজস্র উপলক্ষ্যে, কত অসংখ্য অশালীন মন্তব্য করেছেন, তার বুঝি ইয়ত্তা নেই। Legislature form করার পর রাজ্যের মুখ্য জনপ্রতিনিধি হিসেবে যাঁর ভাষা ও মনোভাব আরও grounded, আরও down to earth হওয়া উচিত ছিল, তাঁর মনোভাব হয়ে উঠল আরও বেপরোয়া।   কোন বিরুদ্ধমত তিনি আর মুহূর্তের জন্যও সহ্য না করার পণ করলেন। কোনরকম বিরোধিতার সামান্যতম আভাসেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে তিনি বিন্দুমাত্র সময় নিলেন না। 


অথচ এতদ্ সত্ত্বেও তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকু টাল খায় নি (সত্যিই কি টাল খায় নি?) বরং বহু অশালীন মন্তব্যের জন্য মানুষ ওঁকে তুমুল করতালি দিয়ে ধন্য ধন্য করেছেন। তাহলে আজ কি এমন হল যে ওঁর মুখে সামান্য 'ঘেউ ঘেউ' শুনে আপনারা এত বিচলিত হলেন? কারণ কি এই যে বাংলার আকাশে আবার একটু একটু করে ঘনিয়ে উঠছে বিরোধিতার মেঘ? জননেত্রীর বিরুদ্ধে? যদি তা-ও হয়, তাহলেও বাংলার মানুষের কাছে আমার মত এক সামান্য সাধারণ মানুষের অনুরোধ, অশালীন ভাষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যদি করতেই হয়, তবে স্থান কাল ও পাত্র নির্বিশেষে তা করুন। যে পার্টি legislature form করেছে এবং যে সব পার্টি তার বিরোধিতা করছে, সমস্ত পার্টির সমস্ত নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করুন যদি তাঁরা কটুভাষ্য প্রয়োগ করেন। 


প্রতিবাদ করুন যে কটুভাষ্য কোন রাজ্যের political culture হতে পারে না। প্রতিবাদ করুন যে অশালীন ভাষা কোন প্রতিবাদের উপায় বা মাধ্যম কোনটাই হতে পারে না। প্রতিবাদ হোক ঘটনার বিরুদ্ধে, ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণে নয়। 


হয়ত অনেকেই বলবেন, বিরোধী নেত্রী যে ভাষা ব্যবহার করতে পারেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কেন সেই ভাষায় কথা বলবেন? আমার কথা হল, এমন যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটকেই অস্বীকার করছেন। মুখ্যমন্ত্রী আলাদা কেউ নন, তিনি কেবলমাত্র আপনার, আমার, আমাদের সবার মুখ্য প্রতিনিধি মাত্র। আমরা তাঁর কাছে দায়বদ্ধ নই বরং তিনিই আমাদের কাছে দায়বদ্ধ তাঁর প্রতিটি কাজের জন্য। আমরা সবাই মিলে ভোট দিয়ে তাঁকে নির্বাচন করেছি আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের রাজ্যের ভালোমন্দ দেখাশোনা করার জন্য। ফলে, আমরা নিজেরা যা কিছু করতে পারি বা বলতে পারি, মুখ্যমন্ত্রীও ঠিক তাই করতে বা বলতে পারেন। He / she is as common a human being as you & me. তাঁর ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে আমাদের সকলের সম্মিলিত ক্ষমতার সমান। আর বিরোধী নেতা বা নেত্রী হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ভবিষ্যতে আপনার, আমার প্রতিনিধি হতে চাইছেন। এর অতিরিক্ত কিছু না। সুতরাং অশালীন ভাষা ব্যবহারকারী কাউকে যদি আমরা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন এবং নিয়োগ করি, তবে ধরে নিতে হবে যে তাঁর ওই অশালীন ভাষা ব্যবহারকেও স্বীকৃতি দিয়েছি আমরা নিজেরাই। নির্বাচনের মাধ্যমে। অতএব নির্বাচনের পর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উনি যত কটুবাক্যই বলুন না কেন, সেটা হজম করা ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। অর্থাৎ উনি 'ঘেউ ঘেউ' বা 'মিউ মিউ' করলেও আমাদের মেনে নিতেই হবে। 


কিন্তু বাস্তবতঃ মমতা DA না দিয়ে রাখতে পারেন না, ওঁর সেই অধিকার নেই। DA অর্থাৎ মহার্ঘ্যভাতা। জিনিসপত্রের দাম যখন বাড়ে বা মহার্ঘ্য হয়, তখন সরকারি কর্মচারীদের হাতে available টাকার buying power কমে। তখন সেই বাড়তি খরচের চাপ সামলানোর জন্য সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ্যভাতা দিয়ে compensate করা হয়। প্রত্যেকটি পদের মাইনে fix করা হয় pay commission এ, সেটাকে বলা হয় basic pay. পরবর্তীকালে যখন জিনিসের দাম বাড়ে তখন basic pay র ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ হরেদরে মাইনে কমে যায়। যেহেতু মূল্যবৃদ্ধি যদি ঘটে, তাহলে সরকার মূল্যবৃদ্ধির দায় অস্বীকার করতে পারে না, তাই এই কমে যাওয়া মাইনেকে compensate করার জন্য মূল্যবৃদ্ধির price index দিয়ে গুণ করে তার ক্রয়ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখবার জন্য যে বাড়তি টাকাটা দেওয়া হয়, তাকেই বলে মহার্ঘ্যভাতা। যত পারসেন্ট মূল্যবৃদ্ধি, তত পারসেন্ট মহার্ঘ্যভাতা। অর্থাৎ DA না দিতে গেলে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে সময় যাবৎ সরকার কর্মচারীদের DA দিচ্ছে না, সেই সময়ে রাজ্যে সেই অনুপাতে কোন মূল্যবৃদ্ধি হয় নি। অর্থাৎ price index অপরিবর্তিত আছে। এটি statistically prove করতে না পারলে DA দিতে সরকার বাধ্য এবং সেটা মুখ্যমন্ত্রীর আইনি বাধ্যবাধকতা হওয়া উচিত। সুতরাং আপনারা বরং যুক্তিসঙ্গতভাবে সাংবিধানিক ভাষায় আপনাদের ন্যায্য দাবীটিকে প্রতিষ্ঠা করুন। দাবী করুন সরকার যাতে তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেন যে এই এতদিন যাবৎ এ রাজ্যে জিনিসপত্র মহার্ঘ্য হয় নি। আর ২০১৯ এর মধ্যে সরকার যদি এই মুহুর্তে বাকি থাকা DA মিটিয়েও দেন, তাহলেও সরকারকে সেই সময় প্রমাণ করতে হবে যে ২০১৯ এর price index এর নিরিখে আপনাদের মাইনে যথাযথ। এই দাবী তুলুন। 


কারুর 'ঘেউ ঘেউ' এ কান দেবেন না।

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

West Bengal: A Security Threat to India