বৈবাহিক ধর্ষণ: Impossible?

ভারতীয় আইনব্যবস্থা খুব সম্প্রতি কয়েকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন  যা ভারতবর্ষের মানবিকতার মূল চেতনাকেই পরিবর্তিত করে দিতে চলেছে অনতিদূর ভবিষ্যতে। বিরাট হিয়ার মাঝে বিরাটতর চেতনা-জাগরণের উত্থান হতে চলেছে কোর্টের এই রায় গুলির ফলে। তার মধ্যে একটি হল তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা, দুই, অপরিসীম ক্ষমতাধর রামরহিমের মত ভণ্ড বাবার ২০ বছরের কারাবাসের সাজা ঘোষণা এবং তিন, ব্যক্তিগত পরিসরকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া। এই তিন সিদ্ধান্তই যুগান্তকারী। এক একটি এক রকম মাত্রায় যুগান্তের দিক্ নির্দেশ করছে। স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে এবং একজন আধুনিক, স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে আমার গর্ব হচ্ছে যে আমি ভারতীয় আদালতের এই তিন ঘোষণাকে প্রত্যক্ষ করলাম। যদিও এই তিনটি রায়ের কোনটির বিষয়েই আমার এই লেখাটি নয়। এই লেখার বিষয়বস্তু অন্য আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেস, যা এই মুহূর্তে বিচারাধীন।

সম্প্রতি IPC section 375 সংক্রান্ত কেসটিতে কেন্দ্রীয় সরকার বিবাহ-সম্পর্কে আবদ্ধ নারীপুরুষের মধ্যে কোন ধর্ষণ ঘটতে পারে বলে মানতে চান নি। "Section 375, the provision of rape in the Indian Penal Code (IPC), has echoing very archaic sentiments, mentioned as its exception clause- “Sexual intercourse by  man with his own wife, the wife not being under 15 years of age, is not rape.”"  যতটুকু বুঝেছি, সরকারি কৌঁসুলির বক্তব্য হল, বৈবাহিক সম্পর্কেও যদি ধর্ষণ হতে পারে বলে মান্যতা দেওয়া হয়, তবে সেই আইনের অপব্যবহার হবে ৪৯৮A আইনটির মত। অর্থাৎ মহিলারা ব্যক্তিগত আক্রোশ বা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যে কোন সময়ে স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের চার্জ আনতে পারবেন এবং তার দ্বারা আইনটির অপব্যবহারের রাস্তা খুলে যাবে।

এই প্রসঙ্গে বলি, একজন মহিলা হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারি এই দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে আমি একেবারেই সহমত নই। কিছু মহিলার অপব্যবহারের সুযোগ আটকানোর জন্য দেশের অধিকাংশ বিবাহিত মহিলাকে against her will & without her consent স্বামীর সাথে স্বামীর ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোন পরিস্থিতিতে সহবাসে বাধ্য করে রাখাটা অমানবিক এবং সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার Right to Equality র পরিপন্থী। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে গায়ের জোরে স্বামীকে নিরস্ত করার ক্ষমতা অধিকাংশ মহিলার নেই। সুতরাং মানবিক চিন্তা, যুক্তি এবং শুভবোধের উপর নির্ভর করেই তাঁদের কথা ভারতীয় সমাজব্যবস্থাকে ভাবতে হবে বৈ কি! তবে এ কথাও সত্য যে কোন আইন বানাতে গেলে তার অপব্যবহারের সম্ভাবনার কথাও মাথায় রাখতে হয়। এবং এই আইনের ক্ষেত্রেও অপব্যবহারের সম্ভাবনা নির্মূল করার উপায় আছে বলে আমার মনে হয়েছে। কিভাবে তা বলব।

তবে সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে চলুন ৪৯৮Aআইনটি সম্বন্ধে একবার জেনে নিই। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত এই আইনটির বলে নববিবাহিত দম্পতির বিবাহের সাত বছরের মধ্যে স্ত্রী বা স্ত্রীয়ের হয়ে অন্য কেউ যদি পুলিশের কাছে একবার অভিযোগ জানাত যে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা তার উপর কোনপ্রকার অত্যাচার করছে, তাহলেই পুলিশের একমাত্র কর্তব্য ছিল বিনা প্রশ্নে এবং বিনা তদন্তে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ীর অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করা। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে burden of proof অর্থাৎ অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের দায় যে অভিযোগকারী, তাঁর উপরেই থাকে। কিন্তু একমাত্র ৪৯৮A আইনটির ক্ষেত্রে burden of proof থাকে অভিযুক্তের উপর। অর্থাৎ স্ত্রী বা স্ত্রীয়ের পক্ষের লোক যদি স্বামীর বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ আনে, তাহলে তাঁদেরকে তাঁদের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করার কোন দায় নিতে হবে না বরং অভিযুক্ত অর্থাৎ স্বামী এবং তাঁর বাড়ির লোকদেরকেই প্রমাণ করার দায় নিতে হবে যে তাঁরা অপরাধ করেন নি। প্রমাণ করতে পারলে তাঁরা ছাড়া পেয়ে যাবেন, নয়ত তাঁরা অপরাধী সাব্যস্ত হবেন। এবং আইনটি এমনই একপেশে যে যদি প্রমাণিত হয় যে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ী নির্দোষ, বরং স্ত্রীই vindictively আইনটির অপপ্রয়োগ করে স্বামীকে ফাঁসিয়েছিলেন, তাহলেও, স্বামী মুক্ত হবেন ঠিকই, কিন্তু মিথ্যা অভিযোগ করার দায়ে স্ত্রী'র কোন শাস্তি হওয়ার সুবন্দোবস্ত ৪৯৮Aআইনটিতে নেই। আইনটি অন্ধ ও একপেশেভাবে মহিলাঘেঁষা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। প্রকৃত অত্যাচারিত মহিলারা আইনটির দ্বারা যত না উপকৃত হয়েছেন, সুযোগসন্ধানী, নীতিহীন মহিলারা ব্যক্তিগত আক্রোশবশতঃ আইনটিকে অনেক বেশি ব্যবহার করেছেন এবং লাভবান হয়েছেন। 

ফলে, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট খুব সম্প্রতি এই আইনের অপব্যবহার রুখতে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি কড়া নির্দেশিকা জারি করেছেন অভিযোগ পাওয়ামাত্র automatic arrest এর বিরুদ্ধে। অর্থাৎ IPC র ৪৯৮A ধারায় অভিযোগ পাওয়ামাত্র বিনা প্রশ্নে এবং বিনা তদন্তে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ীর অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করার যে provision ছিল, তার বিরুদ্ধে কড়া নির্দেশিকা জারি করেছেন মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। তাছাড়াও মহামান্য আদালত এই আইনটির আরও নানা প্রয়োজনীয় modification ঘটিয়েছেন যার ফলে পুরুষদের বিরুদ্ধে আইনটির virulence এখন বেশ খানিকটা কমেছে। 

আমার মনে আছে, বিয়ের পর বহু ঝগড়া আমি মন এবং গলা খুলে করতেই পারি নি শুধু এই ভয়ে যে একটা সামান্য ঝগড়া করার কারণে আমার স্বামী বেচারি জেলে চলে যেতে পারে। At least আইনে সেই provision আছে। সেই দিন থেকেই এই IPC Section 498A আইনটি আমার অপছন্দ, কারণ আইনটির abuse potential খুব বেশি।

এবার আসি বৈবাহিক ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনটির বিষয়ে। বৈবাহিক ধর্ষণের সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ rule out না করেও আইনটির অপব্যবহারের সম্ভাবনাকে minimize করা যায়। যদি IPC Section 375 এ কেবলমাত্র একটি explanation insert করা যায়।

বিবাহের পর প্রথমবার স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনবার পূর্বে স্বামী-স্ত্রীর কোন সম্পর্ককেই ধর্ষণ বলে গণ্য করা হবে না। এমনকি যে ঘনিষ্ঠতার জন্য স্ত্রী প্রথমবার স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনছেন সেটিকেও ধর্ষণ বলে গণ্য করা হবে না। 

প্রথমবার স্ত্রী যখন স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনবেন, তখন সেই অভিযোগটিকে চূড়ান্ত অভিযোগ বলে গণ্য না করে, স্বামীকে কেবল সতর্কবাণী দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। এবং তার পর থেকে স্ত্রী যতদিন পর্যন্ত না স্বামীর বিরুদ্ধে তাঁর সেই অভিযোগ Withdraw করছেন, ততদিন পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর যে কোন মিলনই ধর্ষণ বলে treated হবে। অর্থাৎ স্ত্রী যদি একবার স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন, তবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি নিজে convinced হয়ে সেই অভিযোগ withdraw করছেন, ততক্ষণ শুধু যে স্বামী তাঁর কাছে ঘেঁষতে পারবেন না তা নয়, তিনিও তাঁর স্বামীর কাছে যেতে পারবেন না কারণ সে ক্ষেত্রে ধর্ষণের দায়ে দোষী হবেন স্বামী। এবং স্বামী নিজের গরজেই তা হতে দেবেন না। 

স্ত্রী অভিযোগ withdraw করলে আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনর্স্থাপিত হতে কোন বাধা থাকবে না।

স্ত্রী যদি আবার কখনও স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন, তাহলেও সেই অভিযোগটিকে base করে স্বামীকে warning দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং আবার যতদিন না স্ত্রী তাঁর অভিযোগ প্রত্যাহার করে সেই পর্যন্ত তার মধ্যবর্তী সময়টিতে পরষ্পর পরষ্পরের থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য থাকবেন। অর্থাৎ প্রতিবারই প্রথম অভিযোগটিকে চূড়ান্ত গণ্য করা হবে না, বরং প্রথমটির পরের যে কোন অভিযোগই হবে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর আনা বৈবাহিক ধর্ষণের চূড়ান্ত অভিযোগ।

আইনটির যদি এরকম একটি explanation insert করা যায়, তাহলে বৈবাহিক ধর্ষণের অস্তিত্বকে স্বীকার করেও আইনটির অপপ্রয়োগকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিহত করতে পারা যাবে।

এক্ষেত্রে যে সমস্ত অসহায় মহিলা সত্যিই বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছেন, তাঁরা আইনের সুরক্ষা পেতে পারবেন, কিন্তু যে সব মহিলারা কেবল ব্যক্তিগত ভিন্ন স্বার্থে স্বামীকে অপদস্থ করার জন্য প্রতিহিংসামূলকভাবে আইনটির অপপ্রয়োগ করতে চাইবেন, তাঁদের পক্ষে তা করা প্রায় কখনোই সম্ভব হবে না যদি না তাঁদের স্বামীরাই তাঁদের হাতে সেই সুযোগ তুলে দেন। 

আমার মনে হয় IPC section 375 এর এরকম একটি modification প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বহু মহিলাকে  তাঁদের স্বামীদের অযাচিত এবং অশালীন ঘনিষ্ঠতাকে নিরূপায় হয়ে মেনে নিতে বাধ্য হতে হবে না। এবং বহু পুরুষও তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্ত্রীয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার দায়মুক্ত হতে পারবেন।

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

West Bengal: A Security Threat to India