বিউটি মালিক ও ফেমিনিজম্

নারীবাদীরা, শুনছেন? প্রকৃত নারীস্বাধীনতা চান আপনারা? তাহলে মেয়েদের সামাজিক দায়িত্বের দাবীতে সরব হোন। যতদিন আমাদের সমাজ মেয়েদের আইনতঃ 'দুধভাত', 'পুতুল', করে রাখবে, অথচ তাদের 'অধিকার' নিয়ে গলা ফাটাবে, ততদিন সেই আওয়াজ কেউ শুনতে পাবে না। আপনারা বরং মেয়েদের সামাজিক দায়িত্বের দাবীতে পথে নামুন। দাবী করুন মেয়েদের যেন আইন করে দায়বদ্ধ করা হয়।

গতকাল থেকে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখছি। দার্জিলিং এ নিহত পুলিশ SI অমিতাভ মালিকের স্ত্রী বিউটি মালিকের ছবি দিয়ে অনেকেই পোস্ট করছেন যে অমিতাভর মৃত্যুর ফলে লাভবান হয়েছেন বিউটি। Compassionate ground এ চাকরি পেয়েছেন এবং তারপর আর শ্বশুর শাশুড়ীর সঙ্গে আদৌ সম্পর্ক রাখেন নি। 

বিউটির চেহারা মিষ্টি। তিনি সুন্দর, confident ভঙ্গিমায় হেঁটে যাচ্ছেন রাস্তায় বা কোনো পাবলিক প্লেসে। এটা অনেকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। অনেকেই কল্পনা করতে চেয়েছিলেন যে অমিতাভ মারা যাওয়ার সময় যে ভাবে কাঁদছিলেন বিউটি, সেভাবেই শোকসন্তপ্ত হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেবেন তিনি। স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা, প্রেম ও সমর্পণের প্রতিমূর্তি হয়ে থাকবেন বিউটি। শ্বশুর-শাশুড়ী-শ্বশুরবাড়ীর একজন হয়ে, অমিতাভর আরব্ধ দায়িত্ব বহন করবেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে হয়ত ঘটল ঠিক তার উল্টোরকম। 

প্রশ্ন হল, ভেবে দেখেছেন কেন এমন হল? বা কেন এমন হয়? 

বিউটির সুন্দর, ঝরঝরে সালোয়ার কামিজ পরা চেহারার উপর রাগ করবেন না। তাঁর আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিমার উপরেও রাগ করবেন না। আবার বিউটি অমিতাভর মৃত্যুর অল্প ক'দিনের মধ্যেই নিজের স্বামী হারানোর যন্ত্রণা ভুলে গেছেন বলে মনে করেও তাঁর উপর অযথা বিক্ষুব্ধ হবেন না, কারণ এগুলো সবই বিউটির ব্যক্তিপরিসরের স্বাধীনতা। বিউটির দুঃখ, শোক, যন্ত্রণা, ভালোবাসা সবই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তা নিয়ে ফেসবুকে কাটাছেঁড়া করতে যাওয়া একান্তই মধ্যযুগীয় মানসিকতা।

রাগ যদি করতেই হয়, সমালোচনা যদি করতেই হয়, তাহলে করুন বিউটির দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে। বিউটি চাকরি পেয়েছেন অমিতাভর স্ত্রী হিসেবে। নিজের যোগ্যতায় নয়। ফলে সেই চাকরির সুফল যদি তাঁকে ভোগ করতে হয়, তাহলে অমিতাভর বিধবা স্ত্রী হিসেবেই তাঁকে সেই সুফল ভোগ করতে হবে। এবং সেই কারণেই বিউটির চাকরির অর্থমূল্যের ভাগ অবশ্যই পাওয়া উচিত অমিতাভর মা বাবা ভাইয়েরও। ঠিক ততটাই যতটা অমিতাভ থাকলে দিতেন। 

প্রশ্ন হল, বিউটির কি আবার নতুন করে জীবন শুরু করার অধিকার নেই? নিশ্চয় আছে! কিন্তু যতই বিউটি আবার নতুন করে জীবন শুরু করুন না কেন, যতদিন তিনি এই চাকরিটি করবেন, ততদিন বিউটির অবশ্যই উচিত অমিতাভর পরিবারের অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব সাধ্যমত বহন করা। অমিতাভ বেঁচে থাকলে যতটা করতেন, ঠিক ততটাই। এমনকি বিউটি যদি নতুন কোন পরিবারের অংশ হন, তাহলেও তাঁর প্রাক্তন স্বামীর পরিবারের দায় তাঁর কাঁধে থাকাই উচিত, যদি না তিনি অমিতাভর পরিচয়সূত্রে পাওয়া এই চাকরিটি ছেড়ে দেন।

কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, অমিতাভ অন ডিউটি মারা গিয়েছিলেন, তার দায় বিউটি নেবেন কেন? তার উত্তর হল, একজন সরকারি কর্মচারীকে, একজন পুলিশ SI কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছিলেন বিউটি, সেই মুহূর্তেই অমিতাভর চাকরির occupational hazards গুলোকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তিনি। এ-ই আমাদের আইন। পরিবারও সরকারি কর্মচারীর ডিউটির শর্তে রাজি, এটি স্বতঃসিদ্ধ। ফলে অমিতাভর মৃত্যুর পর বিউটির সেই দায় নিতে না চাওয়া বেআইনিও এবং তার চেয়েও অনেক বেশি অনৈতিক। 

তা সত্ত্বেও সেই অনৈতিক  কাজ বিউটি করতেই পারেন, দায় না-ই নিতে পারেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে compassionate ground এর চাকরিটি থেকেও তাঁর ইস্তফা দেওয়া উচিত। 

আর যদি বিউটি সওয়াল করেন যে স্বামীকে হারাতে হয়েছে বলে স্বামীর বদলি হিসেবেই তিনি চাকরিটিকে দেখছেন, সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিউটির আবার নতুন করে অন্য কারুর সঙ্গে জীবন শুরু করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। কারণ তাঁর জীবনে তাঁর স্বামীর জায়গাটিতেই আছে তাঁর চাকরিটি। অর্থাৎ স্বামীর জায়গাটি খালি নেই। চাকরি স্বামীর বিকল্প হতে পারে কিনা তা অবশ্য জানা নেই, কিন্তু যদি চাকরি স্বামীর বিকল্প হিসেবেই বিউটির জীবনে এসে থাকে, তাহলে কিন্তু ধরে নিতে হবে স্বামীর সান্নিধ্য ও দায়দায়িত্ব দুই-ই চাকরির রূপে একসাথে এসেছে।

সরকারি আইন অনুসারে স্বামীর মৃত্যুর পর ফ্যামিলি পেনশন তুলবার সময় স্ত্রী কে যেমন নন-রি-ম্যারেজ সার্টিফিকেট জমা দিতে হয়, ঠিক অনুরূপ আইন এক্ষেত্রেও বলবৎ হোক যে, স্বামীর মৃত্যুর পর কমপ্যাশনেট গ্রাউণ্ডে স্ত্রী যদি চাকরি পান, তাহলে সেই চাকরি রাখতে গেলেও স্ত্রী কে নিয়মিত ওই নন-রি-ম্যারেজ সার্টিফিকেট জমা দিয়ে যেতে হবে। তাহলেই স্বামীর বদলি হিসেবে চাকরিটি করতে পারবেন স্ত্রী। 

আমাদের সমাজ যতদিন পর্যন্ত না মেয়েদের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের দায়িত্ব সম্বন্ধেও সরব হয়ে উঠবে, ততদিন প্রকৃত নারীমুক্তি আসবে না। নারীবাদীরা নারীর অধিকার নিয়ে যত কথা বলেন, তার একশ ভাগের এক ভাগ কথাও যদি মেয়েদের দায়িত্ব নিয়ে বলতেন, সমাজ বদলে যেত। কারণ মেয়েদেরকে সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল করে তোলার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত নারীস্বাধীনতা ও মুক্তির হদিশ। 

শুধু পাবো আর দেওয়ার বেলায় অবলা নারী হয়ে থাকবো, এই ধাষ্টামো আর কতদিন? পুরুষতন্ত্রকে আঘাত করতে চান? সামাজিক ও আইনগত স্বীকৃতিসহ পুরুষের দায়িত্ব share করতে চাওয়ার দাবী তুলুন।

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

Karnataka Election Result 2023: Observations

এত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-খরা: কেন?