গান্ধী 'মহাত্মা', গডসে মহান দেশপ্রেমিক: দুই-ই সত্য ইতিহাস

যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে চলছে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের ৭৮ তম অধিবেশন যার উদ্বোধন হয়েছে গত বৃহস্পতিবার।

প্রশ্ন ও তর্ক করার স্বাধীনতার সপক্ষে সওয়াল করেছেন ইতিহাসবিদরা। যেমন কৃষ্ণমোহন শ্রীমালি, ইরফান হাবিব, সুরঞ্জন দাস। কাটাছেঁড়া হয়েছে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের নীতি নিয়ে। অভিযোগ উঠেছে যে সঙ্ঘ পরিবার ইতিহাস বিকৃত করতে চায়, নিজেদের পছন্দের তত্ত্ব অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। একজন সচেতন নাগরিক এবং অ-বামপন্থী হিসেবে এই বিষয়ে আমারও কিছু বক্তব্য আছে। ছোটবেলা থেকেই তার্কিক, তাই আমার মতও তার্কিকতার ও প্রশ্ন করার স্বাধীনতার সপক্ষে। 

সেই তার্কিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে চাই যে প্রথাগত উচ্চশিক্ষায় ইতিহাসের ছাত্রী না হলেও একটি বিষয় স্কুল লেভেলেই জেনেছিলাম। ইতিহাস বা History হল his story. আর এই he হল একজন সমসাময়িক common man. অর্থাৎ ইতিহাস হল একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে তাঁর বা তাঁদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সমসাময়িক ঘটনার ইমপ্যাক্ট। History'র এই সংজ্ঞা থেকেই স্পষ্ট যে ঐতিহাসিক তথ্য ও তত্ত্ব নিয়ে মতপার্থক্য ও মতবহুত্ব থাকবেই কারণ একই ঘটনা আলাদা আলাদা কমন ম্যান আলাদা আলাদা perspective থেকে আলাদা আলাদা দৃষ্টিতে দেখবেন, এ-ই স্বাভাবিক।

এবং ঠিক এই কথাটাই বলেছেন যাদবপুরের VC ইতিহাসবিদ শ্রী সুরঞ্জন দাস। "ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হবে ব্যক্তিনির্ভর। কোনো ইতিহাসই চূড়ান্ত নয়।" বটেই তো। ইতিহাস চূড়ান্ত বলে কিছু তো হতে পারে না। কারণ একই সময়ে বহু আলাদা আলাদা 'he' এর story হল History. আর মানুষ যখন আলাদা, ফলে একই ঘটনার ব্যাখ্যাও মানুষভেদে আলাদা হবে। শ্রী সুরঞ্জন দাস যথার্থই বলেছেন, "ইতিহাসের ব্যাখ্যা আমাদের আপেক্ষিক সত্যের সামনে এনে দাঁড় করায়"। অবশ্যই তাই। এই আপেক্ষিকতাকে সম্মান করতে জানলেই মানব-ইতিহাসের প্রতি সঠিক সম্মান প্রদর্শন করা যায়। সেই কারণেই কিছু মানুষের কাছে যেমন গান্ধী 'মহাত্মা', ঠিক তেমনই অন্য বেশ কিছু মানুষের কাছে গান্ধী traitor এবং নাথুরাম গডসে নমস্য দেশপ্রেমিক কারণ গান্ধীকে হত্যা করে, সর্বসমক্ষে তা স্বীকার করে এবং সেই অপরাধের জন্য বিনম্রচিত্তে মৃত্যুদণ্ড বরণ করে নিয়ে স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বলতায় মহীয়ান ও গরীয়ান গডসে। দুই-ই ইতিহাস। ইতিহাস তো একমাত্রিক হতে পারে না।

ঠিক এই যুক্তিতেই ইতিহাসের হিন্দুত্বকরণের যে অভিযোগ উঠছে সঙ্ঘ ও বিজেপির বিরুদ্ধে, তা বোধ করি biased. কারণ তথ্য ও উপাদানের নিরিখে যে কোনো ঘটনাকে যুক্তিনির্ভর ভাবে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপনা করার অধিকার ইতিহাসসিদ্ধ। ঠিক যেমন বলেছেন ইরফান হাবিব, "সঙ্ঘ পরিবারের যেমন তত্ত্ব প্রচারের অধিকার রয়েছে, তেমনই সেই তত্ত্বের বিরোধিতা করার অধিকার রয়েছে অন্যদের।" সঙ্ঘ পরিবার অর্থাৎ একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী যদি কোনো একটি ঘটনাকে কোনো এক বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতে চায়, তবে তা-ও his story বা History.

তাছাড়া ইতিহাস পড়ানোর নাম করে যে বিষয়টি বর্তমানে স্কুল কলেজে পড়ানো হয়, তা-ও বেশ খানিকটা অসার কারণ সেগুলি biased এবং একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণিত। সেগুলি অসার কারণ সেগুলি বর্ননাধর্মী। ইতিহাসবিদদের ভার্সনকে রিপিট করেই বলছি, ইতিহাস কেবলমাত্র বর্ননাধর্মী অতীতচারণা নয়। যেমন ধরুন গতকালের ঘটনাও আজ অতীত অর্থাৎ ইতিহাস হয়েছে। কিন্তু গতকালের সব ঘটনা কি সব মানুষ একইভাবে জানে, ব্যাখ্যা করে বা অনুভব করে? নিশ্চয় না। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত না গতকালের ঘটনার সমস্ত রকম সম্ভাব্য ব্যাখ্যার একটা সামগ্রিক চিত্র নির্লিপ্ত ও আনবায়াসড্ ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে, ততক্ষণ গতকালের ইতিহাস সম্পূর্ণ হল না। এই সামগ্রিক ইতিহাস চর্চার উপর জোর দেওয়ার দাবী তুলবেন ইতিহাসবিদরা, এই আশা করি।

ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের এই ৭৮ তম অধিবেশনকে সার্থক বলা যাবে যদি ইতিহাসবিদরা এই মঞ্চ থেকে এই দাবী তোলেন যে একই বিষয়ের সমস্ত কটি প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যাই না হয় পড়ানো হোক ছাত্রছাত্রীদের। ইতিহাস সংক্রান্ত পড়াশোনাটা না হয় স্কুল লেভেল থেকেই প্রজেক্ট ও গবেষণাভিত্তিক এবং ওপেন বুক টাইপ হোক। সত্যিকারের unbiased history পড়ানো হোক। অর্থাৎ প্রতিটা পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যাই সমান নির্লিপ্তির সাথে তুলে ধরা হোক। এবং সমস্ত আপাত পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যাকে regress করে গোটা চিত্রকে তুলে ধরার জন্য ছাত্রছাত্রীদের গবেষকের স্বাধীনতা দেওয়া হোক। তবেই গিয়ে ইতিহাস নামক বিষয়টির প্রকৃত প্রাসঙ্গিকতা এবং উপযোগিতা স্পষ্ট হবে। নাহলে ইতিহাস কেবলমাত্র ক্ষমতার তর্কযুদ্ধে শাণ দেওয়ার কিছু শুকনো পরস্পরবিরোধী reference হিসেবে থেকে যাচ্ছে।

ইতিহাসবিদরা প্রশ্ন করার স্বাধীনতা ও নিজের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যার আপেক্ষিকতার হয়ে সওয়াল করেছেন। সেই সওয়ালকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েই বলছি, সেই স্বাধীনতা সকলেরই আছে। বামপন্থীদের যেমন আছে, সঙ্ঘ পরিবারেরও তেমনই আছে। এই মুহূর্তে দেশের পার্লামেন্টে যেহেতু বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা, ফলে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারকে ভারতবর্ষের বর্তমান রাজা এবং অন্যান্য সকল বিরোধীপক্ষকে রাজবিরোধী প্রজা মনে করার পুরোনো কংগ্রেসী লেগ্যাসি থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন আছে। ফলে ইতিহাসবিদরা যে তর্কের স্বাধীনতার কথা বলছেন, সেই স্বাধীনতা যেমন বিজেপি বিরোধীদের আছে, তেমনই বিজেপিরও আছে।সঙ্ঘ পরিবার সনাতন ভারতীয়ত্বের প্রচারক যেখানে অধিকার ও কর্তব্য দুই-ই সকলের সমান, কংগ্রেস আমলে যা ছিল না বলেই History হয়ে উঠেছিল কেবলমাত্র দু-একজন 'he' এর পছন্দসই story. কিন্তু বর্তমান ভারতবর্ষ হোক্ প্রকৃতই ভারতীয় জনতার ভারতবর্ষ। সেখানে History হবে প্রকৃতই his story. সেই 'he' এর মধ্যে যেমন ঔপনিবেশিক মানসিকতার মমতা, মনমোহন, রাহুল, আসাদউদ্দিন থাকবেন, তেমনই চিরায়ত, প্রি-কলোনিয়াল ভারতপন্থীরাও থাকবেন। ন্দ্র

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

Karnataka Election Result 2023: Observations

এত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-খরা: কেন?