এত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-খরা: কেন?
গত ২০১১ সাল পর্যন্ত বামফ্রন্ট-কন্টকিত পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর খাসতালুক এই রাজ্যে বেশ কিছু চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ পরিবর্তন বলতে সেটাই বোঝে যা সে চোখে দেখতে পায়। কনজিউমারিজম্ এর যুগে "জো দিখতা হ্যায়, ওহি বিকতা হ্যায়"! আসল পরিবর্তন যে চিন্তা ও বোধের জগতে আসে, বেশিরভাগ মানুষ তা এখনও উপলব্ধি করতে পারেন বলে আমার মনে হয় না। যদিও আমার এই মনে হওয়া ভুলও হতে পারে।
সিপিএম যেহেতু তাদের tenure এর একেবারে শেষের বেলায় আসার আগে পর্যন্ত রাস্তাঘাট বা শহরের সৌন্দর্য্যায়ন ইত্যাদি কাজ একেবারেই করে নি, ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজটা সহজ ছিল। মানুষকে উনি সহজেই বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন 'পরিবর্তন'! শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাটের সংস্কার সাধন করেছেন, বেশ কিছু পুরোনো বিল্ডিং renovate এবং সংস্কার করেছেন, বাড়ি ঘর ইত্যাদি রং করেছেন। এয়ারপোর্ট থেকে নিউটাউন হয়ে যদি কেউ মূল শহরে ঢোকে, তবে নিউটাউন তাঁর চোখে ময়দানবের বিশাল কর্মযজ্ঞ বলে মনে হবে। মনে হবে একটা ফাঁকা জায়গায় কেমনভাবে গড়ে উঠছে বিশাল এক অত্যাশ্চর্য নগরী।
মানুষ বোধ হয় এতদিনে ভুলে গেছে যে নিউটাউন গড়ে উঠছিল ২০০১ সাল থেকে। বরং ২০১১ সালে মমতাদেবী নির্বাচিত হয়ে আসার ঠিক পর পরই নিউটাউনের গড়ে ওঠার গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে গিয়েছিল। হয়ত সিপিএমের পুরোনো প্রজেক্ট বলেই ওঁর প্রথমে মনে হয়েছিল যে সিপিএমের সাধের প্রজেক্ট আমি কেন গড়ব? কিন্তু কেউ হয়ত ওনাকে বুঝিয়েছিল যে 'অচিরেই লোকে সিপিএমকে ভুলে যাবে। তখন নিউটাউন গড়ে তোলার গোটা কৃতিত্ব আপনারই হবে।' হয়েছেও তাই। ২০১২/১৩ থেকেই মুখ্যমন্ত্রী আবার নিউটাউন গড়ে তোলার কাজে গতি আনেন।
সেই নিউটাউনেই প্রতি বছর হয় গ্লোবাল বেঙ্গল বিজনেস সামিট। এ বছরও তা হচ্ছে। শিল্পপতিরা প্রতিবারই আসেন, এবছরও এসেছেন। সামিটের প্রথম দিনেই রাজ্য পেয়েছে সতেরো হাজার কোটি টাকার, না, লগ্নি নয়, লগ্নির প্রতিশ্রুতি। এমন প্রতিশ্রুতি এর আগের বছরগুলোতেও পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে বাস করি তারা জানি যে পশ্চিমবঙ্গে কোনো বৃহৎ ব্যবসায়িক বা উৎপাদন উদ্যোগ কোথাও নেই। গত ছ'বছরে হয় নি। অথচ প্রতিশ্রুতি নিয়মিতই এসেছে। অর্থাৎ ট্রেন্ড বলছে যে প্রতিশ্রুতি পালিত হয় না। শিল্পপতিরা নিশ্চয় মিথ্যে কথা বলতে রাজ্যে আসেন না? নিশ্চয় না! তাঁরা নিশ্চয় genuinely রাজ্যে বিনিয়োগ করতে চান। তাহলে করেন না কেন? শুধু এই বিজনেস সামিটের সময়ই রাজ্যে তাঁরা বিনিয়োগের কথা বলেন কেন? কেন ফাইনালি গিয়ে বিনিয়োগ করে উঠতে পারেন না? মুখ্যমন্ত্রী ভেবে দেখেছেন কি?
জমি জট পশ্চিমবঙ্গে শিল্পোদ্যোগ গড়ে তোলার অন্তরায়। কিন্তু একমাত্র অন্তরায় বোধ হয় নয়। মুখ্যমন্ত্রী প্রায়শঃ বলেন, আমরা ল্যান্ডব্যাঙ্ক থেকে জমি দিতে পারি। কিন্তু সেই ল্যান্ডব্যাঙ্কের জমি শিল্পপতিদের পছন্দ হয় না কেন? কেউ কেউ হয়ত ভাবছেন, "কে বলেছে পছন্দ হয় না?" আমার মন বলে, নিশ্চিত ভাবেই পছন্দ হয় না। নাহলে তো এতদিনে সেই ল্যান্ডব্যাঙ্কের জমিতে কোনো না কোনো শিল্পোদ্যোগ শুরু হত! অর্থাৎ শুধু জমি দিলেই হবে না। শিল্পপতিদের তা পছন্দ হওয়াও চাই।
আবার ল্যান্ডব্যাঙ্কের অন্তর্গত নয় এমন কোনো এলাকার জমি যদি কোনো শিল্পপতির পছন্দও হয়, তাহলেও এমন কোনো শিল্পপতি বোধ হয় নেই যিনি ঘুরে ঘুরে আলাদা আলাদা টুকরো টুকরো জমির মালিকদের সঙ্গে দরকষাকষি করে টুকরো টুকরো জমি কিনতে কিনতে নিজের প্রয়োজনীয় গোটা জমি কিনে নিয়ে নিজের জমির ব্যবস্থা আগে নিজে করে নেবেন, তারপর কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের ভালোর জন্য, শুধু পশ্চিমবঙ্গের মানুষের উপকার করার জন্য সেই জমিতে ব্যবসায়িক উদ্যোগ গড়ে তুলতে চাইবেন।
মুখ্যমন্ত্রী যদি সত্যিই রাজ্যের প্রকৃত শিল্পবিকাশ চান, তবে মুখ্যমন্ত্রীকে এটা বুঝতেই হবে যে শিল্পপতিরা যে কোনো স্থানে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ করেন প্রথমতঃ এবং প্রধানতঃ তাঁদের নিজেদের ব্যবসায়িক লাভের জন্য। সে-ই হল তাঁদের বৈশ্য ধর্ম। সেই বৈশ্য ধর্ম পালন করতে গিয়ে তাঁরা বহু মানুষকে সেই কর্মোদ্যোগে সামিল করেন বলে সামগ্রিক অর্থনীতিরও তাতে লাভ হয়। শিল্পপতিরা যেহেতু অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের মধ্যে থাকে বৈশ্যত্বের অহংকার। তা অত্যন্ত ভালো জিনিস, নিন্দনীয় নয়।
অর্থাৎ শিল্পপতিদের সেই Manufacturers' Ego এবং Employers' Ego কে যতক্ষণ পর্যন্ত না তুষ্ট করা যাচ্ছে, ততক্ষণ পশ্চিমবঙ্গে শিল্প হবে না। শিল্পপতিদের যতক্ষণ পর্যন্ত না বোঝানো যাবে যে একই পরিমাণ লগ্নি তাঁরা অন্য কোনো রাজ্যে না করে পশ্চিমবঙ্গে করলে তাঁদের নিজস্ব লাভ significantly বেশি হবে, এবং তার ফলে রাজ্যও লাভবান হবে, কারণ শিল্প গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের মানুষের কর্মসংস্থান হবে, রাজ্যও আরও ঝাঁ চকচকে হয়ে উঠবে, ততক্ষণ এ রাজ্যে শিল্প গড়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অর্থাৎ একটা win-win চিত্র তুলে ধরতে না পারলে রাজ্যে আর সব কিছু হতে পারে, কিন্তু শিল্প হবে না। কারণ ব্যবসার দুনিয়ায় bottom-line হল profit. এবং তার জন্য চাই নির্ঝঞ্ঝাট কাজের মানসিকতা ও পরিবেশ।
আর এইটিই বোধ হয় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে সম্ভব না। সত্যিকারের যোগ্য লোককে যথোপযুক্ত মান দিতে গেলে যে বোধ, ধীশক্তি, আত্মমর্যাদাপূর্ণ জীবনবোধ ও বিশ্বের সমস্ত 'ভালো'র প্রতি যে শ্রদ্ধা ও সমর্পণ থাকা উচিত পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মানুষের তা আর নেই। এ রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ এখন স্বকপোলকল্পিত এক মিথ্যে অহংকারের ফানুসে ভর করে হাওয়ায় ভাসছে। সেখানে চাটুকারিতা আছে, অযোগ্যের পদলেহনও থাকতে পারে, মধ্যমানের মেধা ও অসম্পূর্ণ বিদ্যার অহংকার আছে, বিরাট attitudeও হয়ত আছে, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি-বাস্তবতার মাটির সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। যে সব শিল্পপতিরা আকাশচুম্বি সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করছেন দেশে বিদেশে, তাঁদের উদ্যোগের আলোয় রাজ্যকে আলোকিত করতে গেলে তাঁদের priorityগুলোকেই যে প্রাধান্য দিতে হবে, তাঁদের field এ তাঁরাই যে boss এবং এই মুহূর্তে রাজ্যেরই যে তাঁদেরকে প্রয়োজন, তাঁদের যে পশ্চিমবঙ্গে উদ্যোগ না সাজালেও কিচ্ছু যায় আসে না, মুখ্যমন্ত্রীকে তা বুঝতে হবে এবং সেই কারণেই প্রশাসনিক পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে তাঁদেরকে সব রকম সুবিধা দিতে হবে ও নিশ্চিত করতে হবে যে কোনো অঞ্চলে ব্যবসায়িক উদ্যোগ স্থাপন করতে গিয়ে লোক্যাল এবং রাজনৈতিক fringe element এর দ্বারা তাঁরা যেন কোনোভাবে লাঞ্ছিত না হন।
কিন্তু এইটি নিশ্চিত করা মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ ওঁর নিজের পলিটিক্যাল উত্থান fringe element হিসেবেই এবং পরবর্তীকালে সমস্ত fringe elementদেরকে motivate করেই crafted হয়েছে ওনার নিজের রাজনৈতিক জীবন। তাই এখন জীবনের এই পর্যায়ে এসে লোক্যাল গুণ্ডা, তোলাবাজ, অধিকারসচেতন, অল্পে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে আইন হাতে তুলে নেওয়া জনগণকে উল্টো শিক্ষা দিতে উনি পারবেন না, কারণ তা করতে গেলেই ওঁর ভোটবাক্স ফাঁকা হয়ে যাবে। মমতাদেবী চিরকালই মাটির কাছাকাছি মানুষদেরকে ক্ষেপিয়ে যে বিধ্বংসী শক্তি উৎপন্ন হয়েছে, তা ব্যবহার করে নেতিবাচক রাজনীতির পথে হেঁটেছেন। আজ ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে সেই মানুষগুলোকেই সুস্থিত, ধীর, ইতিবাচক, গঠনমূলক ও গ্রাউণ্ডেড হতে বলতে কি উনি পারবেন? না,পারবেন না। পারবেন না বলেই পশ্চিমবঙ্গে শিল্প হবে না। শিল্পের জন্য যে 'পরিবর্তন' প্রয়োজন ছিল, তা 'বহিরঙ্গের পরিবর্তন' নয়, প্রয়োজন ছিল 'মননশীলতার পরিবর্তনের'। সেই 'পরিবর্তন' এলে রাস্তাঘাট, জল, বিদ্যুত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সমস্ত 'পরিবর্তন' নিজে নিজেই হত; 'মননশীলতার পরিবর্তনের' ফলস্বরূপ। কিন্তু সেই 'পরিবর্তন' দূর-অস্ত।
মমতাদেবীর পক্ষে তো নয়ই, কারুর পক্ষেই এ রাজ্যে শিল্পোদ্যোগ গড়ে তোলা ততক্ষণ সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনের ধ্বংসাত্মক বামপন্থী ভাবধারার পরিবর্তন হচ্ছে। কথাটা আপনাদের কারুর কারুর একটু খারাপ, একটু বাড়াবাড়ি লাগল কি? বামপন্থা, সাম্যবাদের মত concept ধ্বংসাত্মক কিভাবে হতে পারে? এই বিষয়ে একটু বৈশ্লেষণিক চিন্তার প্রয়োজন আছে।
আমাদের রাজ্যে বামপন্থার হাওয়া বইতে শুরু করেছিল সেই ষাটের দশক থেকেই। গত চার দশক ধরে তা পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরও পন্থা। এই দীর্ঘ চার দশকে বামপন্থীরা রাজ্যের মানুষকে একটা কথা বুঝিয়ে দিতে পেরেছে যে মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ নেই, সবাই সমান এবং গণতন্ত্রে যে কোনো বিষয়ে কথা বলার অধিকার সবার আছে। এই অতিমাত্রায় অধিকার-সচেতনতার ভাবধারা মানুষের মনে যত বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে, রাজ্যের একদম সাধারণ মাটির মানুষগুলোর মধ্যে থেকে সত্যিকারের যোগ্যতা অর্জনের অর্থাৎ academic এবং non-academic প্রকৃত দক্ষতা বা skill অর্জনের ইচ্ছা তত নষ্ট হয়ে গেছে। বামপন্থা যত তাঁদেরকে অধিকার-সচেতন করে তুলতে চেয়েছে, তাঁদের দায়িত্ববোধ তত নষ্ট হয়ে গেছে। অধিকার আর দায়িত্ব যে পাশাপাশি চলে, বামপন্থা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তা ভুলিয়ে দিয়েছে। বামপন্থা তাঁদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও টাকাপয়সার basic needগুলিকে যত loudly রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছে, ততই তাঁদের 'achievement need' কে নষ্ট করেছে। মানুষে মানুষে সাম্য ও সমানাধিকারের উচ্চমার্গীয় দর্শনকে রাস্তায় লজেন্সের মতো বিলোতে শুরু করার মধ্যে দিয়ে বামপন্থা মানুষের সামনে achievement target বলে আর কিছু রাখতে চায় নি। একটি বাচ্চা বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। তাই আদর করে মা বাবা তার নামই রেখে দিল ডঃ শুভ হালদার। ফলে, শুভ'র জীবনে ডাক্তার হওয়া একটা স্বপ্ন হিসেবে আর থাকল না। ফলে সেই স্বপ্ন chase করতে গিয়ে সত্যিই ডাক্তার হয়ে ওঠা তার আর হল না।
বামপন্থীরা রাজ্যের সবচেয়ে বড় ক্ষতি যা করেছে তা হল, তারা মানুষের জীবনের quest নষ্ট করে দিয়েছে। যে quest একটা মানুষকে 'কিছু হয়ে ওঠা', 'কিছু করে দেখানো'র দিকে নিয়ে যেতে পারে, সেই খোঁজটা এ রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে নষ্ট করে দিয়েছে বামপন্থা। দিগ্বিদিকে দার্শনিক সাম্রাজ্যবাদের ঢক্কানিনাদে প্রচারিত হতে থেকেছে 'সকলে সমান', 'সবাই এক', 'কেউ কারুর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়', শুধু বামপন্থার ছাতার তলায় এস, তাহলেই শুভ হালদার হবে ডঃ শুভ হালদার।
আর যে সব বুদ্ধিমান মানুষ এই আপাত পণ্ডিতম্মন্য ধূর্ততা ধরতে পেরেছিলেন এবং যাঁদের সামর্থ্য ও দূরদৃষ্টি ছিল বা আছে, তাঁরা নিজেরা অথবা নিজেদের সন্তানদের রাজ্যের বাইরে বা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রকৃত শিক্ষা ও বৃহত্তর মনুষ্যত্ব লাভের উদ্দেশ্যে। এইভাবে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের মেধাবী মানুষেরা বেরিয়ে গিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে। সাম্যের গুরুপাক খাদ্য তাঁদের পাচনতন্ত্রে গোলমাল বাঁধিয়ে দিয়েছিল। আর পশ্চিমবঙ্গ পড়ে থেকে গিয়েছে বার বার মন্থন করে মাখন তুলে নেওয়া মাঠাহীন পাতলা ট্যালটেলে দুধের মত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে "দুধ ক্রমশঃই কাকচক্ষুর ন্যায় স্বচ্ছ, নীলবর্ণ ধারণ করিতেছে", অর্থাৎ দুধ গিয়ে পড়ে রয়েছে কেবলই জল।
তার উপর পশ্চিমবঙ্গের জনসম্পদকে ক্রমশঃ আরও ভারাক্রান্ত, আরও নিম্নমানের করে তুলেছে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর দল। যারা আগে বাম আর এখন অতিবাম মমতাদেবীর ডেডিকেটেড ভোটব্যাঙ্ক।
বামপন্থার Intellectual terrorism ও psychological pollution পশ্চিবঙ্গের মানুষের মনোজগতে যে আগ্রাসী হামলা করেছে, তার ফলে রাজ্যের বহু মানুষ psychologically এক একজন উগ্রপন্থীতে পরিণত হয়েছে।
এই মানুষগুলো শিল্পপতিদের শিল্পোদ্যোগের পথে প্রধান বাধা। এদের দৃষ্টিতে শিল্পপতি মানে হল মালিক যারা নিজেরা কোনো কাজ করে না, শ্রমিক খাটিয়ে শুধু মুনাফা লোটে। ফলে তাদের হয়ত মনে হয়, 'লাভ তুমি একা করবে কেন চাঁদ, আমাদেরও কিছু ছাড়! আগে আমাদেরকে মাল্লু ছাড়, তারপর আমাদের এলাকায় ব্যবসা করতে দেব।' ফলে শিল্পপতিদের আর এখানে ব্যবসা করা হয়না। মনে রাখতে হবে আমাদের রাজ্য মাফিয়াদের রাজ্য নয় কারণ লোক্যাল দাদারা এখানে প্রত্যেকেই এক এক জন অতি ক্ষুদ্র মাফিয়া। এই এতজন ক্ষুদ্র মাফিয়াকে simultaneously তুষ্ট করে ব্যবসা করা কোনো শিল্পপতির পক্ষে সম্ভব নয়। কেন বলুন তো? কারণ এই মাইক্রোস্কোপিক মাফিয়াদের তুষ্ট করা কোনোভাবে সম্ভবই নয়। কারণ আপাতভাবে এরা টাকাপয়সার দাবী তুললেও, এদের আসল দাবী টাকাপয়সা নয়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ money-minded নয়, এরা চায় গুরুত্ব, সম্মান। কারণ বামপন্থা তাদের মনোজগতে একটা কথা গজাল মেরে গুঁজিয়ে দিয়েছিল যে by their sheer existence, তারা কোনো অংশে কারুর চেয়ে কম নয়। শিল্পপতি যা, তারাও তাই। তাই শিল্পপতির ঠাট বাট রোয়াব তাদের মনোজগতে গোলমাল বাঁধিয়ে দেয়, তাদের মটকার ঘিলু ফুটতে আরম্ভ করে, নিঃশ্বাসে বেরোতে আরম্ভ করে ঈর্ষার বিষের ধোঁয়া। 'কিসের এত দেমাক তোর? পয়সা আছে বলে? যাঃ, করতে দেব না এখানে ব্যবসা! খাটবে এখানকার লোক আর পয়সা লুটবি তুই? তোর মাথা এমনিতেই তেলা, আরও তেল ঢালতে দেব না। ফোট্ এখান থেকে।' বেচারাদের অবচেতন মন যত বেশি করে উপলব্ধি করে যে তারা জীবনে হতে পারে নি কিছুই, সচেতন মনের বামপন্থী মিথ্যা স্তোকগুলি ততই তাদের বিদ্রোহী করে তোলে প্রকৃত মেধা, প্রকৃত সম্ভাবনার বিরুদ্ধে।
আর পশ্চিমবঙ্গের এই মানুষগুলোরই যথার্থ প্রতিনিধি হলেন মমতাদেবী। তিনিও এই মানসিকতারই ধারক, বাহক ও প্রচারক। বাম-বাংলার সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি মমতাদেবীই, কারণ তিনিই পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর প্রকৃত প্রতিনিধি। তিনি একেবারেই তাদের মত। চিন্তায়, ভাবনায়, ভাষায়, মননে মমতাদেবী বামপন্থার সবচেয়ে glorified victim. হ্যাঁ victim. জ্যোতি বসুর বামপন্থী সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে glorified শিকার হলেন মমতাদেবী। জ্যোতি বসু বামপন্থার বিষ প্রয়োগ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজে সেই বিষ গ্রহন করেন নি কোনোদিন। তাই গলদা চিংড়ি আর blue label চালিয়ে গেছেন সারাজীবন। কিন্তু জ্যোতিবাবুর পশ্চিমবঙ্গে বেড়ে উঠে মমতাদেবী হলেন সেই বিষের প্রধান ও সবচেয়ে prominent শিকার।
আমাদের রাজ্যে আজ ঘরে ঘরে আছে মমতাদেবীর মত মানুষ। সহজ, সরল, সাধারণ, মাটির কাছাকাছি, বিদ্যা অল্পবিস্তর থাকলেও মূলতঃ শিক্ষার অভাবে অভাবগ্রস্ত, প্রবল অহংকারী, অবিমৃশ্যকারী এবং সেই জন্যই আগুপিছু ভাবতে না পেরে স্বেচ্ছাচারী। কেন তিনি অমন কবিতা লেখেন? কারণ তিনি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে ওগুলো ভালো কবিতা। এই বিশ্বাস সম্ভবতঃ আসে বোধের অভাব থেকে, intellectual dwarfism থেকে, যা বামপন্থার direct outcome. মানুষ যদি তেমন কিছু না করেই যে কোনো বিদ্বান, জ্ঞানী গুণী মানুষের সমকক্ষ বলে নিজেকে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে অল্প বয়স থেকে, তাহলে maniac হয়ে ওঠা বা intellectual dwarfism এর শিকার হয়ে পড়া তার পক্ষে কিছুই আশ্চর্য নয়। মমতাদেবী জানেন ওঁর রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ এরকম কবিতা কেন, নিজের নাম পর্যন্ত সঠিকভাবে লিখতে জানে না। অর্থাৎ তিনি যাঁদের প্রতিনিধি, তাদের চেয়ে ঢের এগিয়ে তো তিনি আছেনই।
এই মানসিকতা যতদিন পর্যন্ত না বদলাবে, যতদিন পর্যন্ত না রাজ্যের মানুষকে বোঝানো যাবে যে শিল্পায়ন প্রয়োজন রাজ্যের মানুষের স্বার্থেই, শিল্পপতিদের স্বার্থে নয়, শিল্পপতিরা কাজের সুযোগ তৈরি করেন বলেই শ্রমিক কাজ পায়, কাজের সুযোগ তৈরি করাও একটা বিরাট বড় কাজ যা একমাত্র শিল্পপতিরাই করতে পারেন, ততদিন এ রাজ্যে শিল্প হবে না। অর্থাৎ মানুষকে বুঝতে হবে যে শ্রমিক শ্রমিকের জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ, আর শিল্পপতি শিল্পপতির জায়গায়। দু'জনের তুলনা চলে না। সাম্যের অর্থ মুড়ি-মিছরির এক দর নয়। একথা মেনে নেওয়ার মধ্যে কোনো অগৌরব নেই যে বেশিরভাগ মানুষই মুড়ির মত সাধারণ এবং অল্পসংখ্যক লোক মিছরির মত বিশেষ বলেই মুড়ি ও মিছরির মিশ্রণটা সুস্বাদু। এই স্বীকারোক্তিতে মুড়িরও গৌরব বৃদ্ধি বই হ্রাস পায় না এবং বহু সংখ্যক মুড়ি তাতে পরবর্তীতে মিছরিতে পরিণত হওয়ার দিকে পা বাড়াতে পারে।
অর্থাৎ বামপন্থার ঠিক বিপরীতধর্মী একটি মনোভাব যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজ্যের একদম সাধারণ মানুষের মধ্যে আসছে, ততক্ষণ দু একটি কারখানা, দু একটি ছোটোখাটো ই কমার্স ব্যবসা দীর্ঘ বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায় যদি বা গড়ে উঠতেও পারে, কিন্তু রাজ্যের overall শিল্পহীন-বস্তি-look তাতে বদলাবে না। ঠিক যেমনভাবে সজ্জন জিন্দলদের একটি ইস্পাতকারখানা এ রাজ্যে গড়ে তোলার কথা শুরু হয়েছিল সেই সুদূর ১৯৯৫ এ, জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এবং সে কারখানা কোনোদিনই হয় নি, ঠিক সেভাবেই পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বিনিয়োগ সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে। আজ এতদিনে, দীর্ঘ ২২ বছর পর, সেই জিন্দলরা অবশ্য এ রাজ্যে একটি কারখানা গড়ে তুলতে পেরেছেন! ইস্পাতের নয়, সিমেন্টের। এখন দেখতে হবে সে কারখানা কতদিন চালু থাকে! আরও একটি বিষয় হল, কারখানা গড়লেও জিন্দলদের হেড অফিস কলকাতায় নয়। বড় বড় কর্পোরেটের হেড অফিস বা অন্ততঃ পক্ষে বড় রিজিওনাল অফিস যতদিন পর্যন্ত না কলকাতায় গড়ে উঠছে, ততদিন শহর কলকাতার গায়ে সেই পুরোনো কর্পোরেট হাওয়া লাগবে না আর কলকাতার প্রকৃত আধুনিক তিলোত্তমা হয়ে ওঠাও হবে না। ততদিন পর্যন্ত কলকাতাকে মমতাদেবীর signature শহর হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
সেই জন্য প্রথমেই বলেছিলাম যে রাজ্যের ধ্বংসাত্মক বাম-মানসিকতায় যতদিন পর্যন্ত 'পরিবর্তন' না আসে, ততদিন রাজ্যের প্রকৃত 'পরিবর্তন' সম্ভব নয়। ততদিন পর্যন্ত কেবলমাত্র শিল্প গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে রাজ্যের মানুষকে। কারণ শিল্পপতিরা জানেন যে মমতাদেবী নিজে বিজনেস সামিট করতে পেরে এবং লগ্নির মৌখিক আশ্বাস পেলে খুশি হন। তাই আশ্বাস দিতে তাঁরা কার্পণ্য করেন না। তাঁরা বোধ হয় আন্দাজ করেন যে তাঁদের এই আশ্বাসই আগামী এক বছর মমতাদেবীর বহু রাজনৈতিক ভাষণের রসদ জোগাবে। তাই বিজনেস সামিটে এসে যে আদরযত্ন তাঁরা পান, তার বদলে এই আশ্বাসটুকু দিলে তাঁদের কোনো ক্ষতি নেই বিবেচনা করেই হয়ত শিল্পপতিরা রাজ্যে লগ্নি করার মৌখিক ও লিখিত আশ্বাস দিয়ে যান। মনে মনে তাঁরা বোধ হয় জানেন, তাঁদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের যা আছে, তা jealousy, appreciation নয়। যতদিন পর্যন্ত এই jealousy appreciation এ পরিণত না হয়, ততদিন পশ্চিমবঙ্গে শিল্প হবে না।
ধুরন্ধর শিল্পপতিরা বিলক্ষন জানেন যে এই রাজ্যে শিল্প-লগ্নির পথে সবচেয়ে বড় বাধা তিনিই যিনি তাঁদেরকে শিল্প গড়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
সিপিএম যেহেতু তাদের tenure এর একেবারে শেষের বেলায় আসার আগে পর্যন্ত রাস্তাঘাট বা শহরের সৌন্দর্য্যায়ন ইত্যাদি কাজ একেবারেই করে নি, ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজটা সহজ ছিল। মানুষকে উনি সহজেই বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন 'পরিবর্তন'! শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাটের সংস্কার সাধন করেছেন, বেশ কিছু পুরোনো বিল্ডিং renovate এবং সংস্কার করেছেন, বাড়ি ঘর ইত্যাদি রং করেছেন। এয়ারপোর্ট থেকে নিউটাউন হয়ে যদি কেউ মূল শহরে ঢোকে, তবে নিউটাউন তাঁর চোখে ময়দানবের বিশাল কর্মযজ্ঞ বলে মনে হবে। মনে হবে একটা ফাঁকা জায়গায় কেমনভাবে গড়ে উঠছে বিশাল এক অত্যাশ্চর্য নগরী।
মানুষ বোধ হয় এতদিনে ভুলে গেছে যে নিউটাউন গড়ে উঠছিল ২০০১ সাল থেকে। বরং ২০১১ সালে মমতাদেবী নির্বাচিত হয়ে আসার ঠিক পর পরই নিউটাউনের গড়ে ওঠার গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে গিয়েছিল। হয়ত সিপিএমের পুরোনো প্রজেক্ট বলেই ওঁর প্রথমে মনে হয়েছিল যে সিপিএমের সাধের প্রজেক্ট আমি কেন গড়ব? কিন্তু কেউ হয়ত ওনাকে বুঝিয়েছিল যে 'অচিরেই লোকে সিপিএমকে ভুলে যাবে। তখন নিউটাউন গড়ে তোলার গোটা কৃতিত্ব আপনারই হবে।' হয়েছেও তাই। ২০১২/১৩ থেকেই মুখ্যমন্ত্রী আবার নিউটাউন গড়ে তোলার কাজে গতি আনেন।
সেই নিউটাউনেই প্রতি বছর হয় গ্লোবাল বেঙ্গল বিজনেস সামিট। এ বছরও তা হচ্ছে। শিল্পপতিরা প্রতিবারই আসেন, এবছরও এসেছেন। সামিটের প্রথম দিনেই রাজ্য পেয়েছে সতেরো হাজার কোটি টাকার, না, লগ্নি নয়, লগ্নির প্রতিশ্রুতি। এমন প্রতিশ্রুতি এর আগের বছরগুলোতেও পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে বাস করি তারা জানি যে পশ্চিমবঙ্গে কোনো বৃহৎ ব্যবসায়িক বা উৎপাদন উদ্যোগ কোথাও নেই। গত ছ'বছরে হয় নি। অথচ প্রতিশ্রুতি নিয়মিতই এসেছে। অর্থাৎ ট্রেন্ড বলছে যে প্রতিশ্রুতি পালিত হয় না। শিল্পপতিরা নিশ্চয় মিথ্যে কথা বলতে রাজ্যে আসেন না? নিশ্চয় না! তাঁরা নিশ্চয় genuinely রাজ্যে বিনিয়োগ করতে চান। তাহলে করেন না কেন? শুধু এই বিজনেস সামিটের সময়ই রাজ্যে তাঁরা বিনিয়োগের কথা বলেন কেন? কেন ফাইনালি গিয়ে বিনিয়োগ করে উঠতে পারেন না? মুখ্যমন্ত্রী ভেবে দেখেছেন কি?
জমি জট পশ্চিমবঙ্গে শিল্পোদ্যোগ গড়ে তোলার অন্তরায়। কিন্তু একমাত্র অন্তরায় বোধ হয় নয়। মুখ্যমন্ত্রী প্রায়শঃ বলেন, আমরা ল্যান্ডব্যাঙ্ক থেকে জমি দিতে পারি। কিন্তু সেই ল্যান্ডব্যাঙ্কের জমি শিল্পপতিদের পছন্দ হয় না কেন? কেউ কেউ হয়ত ভাবছেন, "কে বলেছে পছন্দ হয় না?" আমার মন বলে, নিশ্চিত ভাবেই পছন্দ হয় না। নাহলে তো এতদিনে সেই ল্যান্ডব্যাঙ্কের জমিতে কোনো না কোনো শিল্পোদ্যোগ শুরু হত! অর্থাৎ শুধু জমি দিলেই হবে না। শিল্পপতিদের তা পছন্দ হওয়াও চাই।
আবার ল্যান্ডব্যাঙ্কের অন্তর্গত নয় এমন কোনো এলাকার জমি যদি কোনো শিল্পপতির পছন্দও হয়, তাহলেও এমন কোনো শিল্পপতি বোধ হয় নেই যিনি ঘুরে ঘুরে আলাদা আলাদা টুকরো টুকরো জমির মালিকদের সঙ্গে দরকষাকষি করে টুকরো টুকরো জমি কিনতে কিনতে নিজের প্রয়োজনীয় গোটা জমি কিনে নিয়ে নিজের জমির ব্যবস্থা আগে নিজে করে নেবেন, তারপর কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের ভালোর জন্য, শুধু পশ্চিমবঙ্গের মানুষের উপকার করার জন্য সেই জমিতে ব্যবসায়িক উদ্যোগ গড়ে তুলতে চাইবেন।
মুখ্যমন্ত্রী যদি সত্যিই রাজ্যের প্রকৃত শিল্পবিকাশ চান, তবে মুখ্যমন্ত্রীকে এটা বুঝতেই হবে যে শিল্পপতিরা যে কোনো স্থানে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ করেন প্রথমতঃ এবং প্রধানতঃ তাঁদের নিজেদের ব্যবসায়িক লাভের জন্য। সে-ই হল তাঁদের বৈশ্য ধর্ম। সেই বৈশ্য ধর্ম পালন করতে গিয়ে তাঁরা বহু মানুষকে সেই কর্মোদ্যোগে সামিল করেন বলে সামগ্রিক অর্থনীতিরও তাতে লাভ হয়। শিল্পপতিরা যেহেতু অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের মধ্যে থাকে বৈশ্যত্বের অহংকার। তা অত্যন্ত ভালো জিনিস, নিন্দনীয় নয়।
অর্থাৎ শিল্পপতিদের সেই Manufacturers' Ego এবং Employers' Ego কে যতক্ষণ পর্যন্ত না তুষ্ট করা যাচ্ছে, ততক্ষণ পশ্চিমবঙ্গে শিল্প হবে না। শিল্পপতিদের যতক্ষণ পর্যন্ত না বোঝানো যাবে যে একই পরিমাণ লগ্নি তাঁরা অন্য কোনো রাজ্যে না করে পশ্চিমবঙ্গে করলে তাঁদের নিজস্ব লাভ significantly বেশি হবে, এবং তার ফলে রাজ্যও লাভবান হবে, কারণ শিল্প গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের মানুষের কর্মসংস্থান হবে, রাজ্যও আরও ঝাঁ চকচকে হয়ে উঠবে, ততক্ষণ এ রাজ্যে শিল্প গড়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অর্থাৎ একটা win-win চিত্র তুলে ধরতে না পারলে রাজ্যে আর সব কিছু হতে পারে, কিন্তু শিল্প হবে না। কারণ ব্যবসার দুনিয়ায় bottom-line হল profit. এবং তার জন্য চাই নির্ঝঞ্ঝাট কাজের মানসিকতা ও পরিবেশ।
আর এইটিই বোধ হয় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে সম্ভব না। সত্যিকারের যোগ্য লোককে যথোপযুক্ত মান দিতে গেলে যে বোধ, ধীশক্তি, আত্মমর্যাদাপূর্ণ জীবনবোধ ও বিশ্বের সমস্ত 'ভালো'র প্রতি যে শ্রদ্ধা ও সমর্পণ থাকা উচিত পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মানুষের তা আর নেই। এ রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ এখন স্বকপোলকল্পিত এক মিথ্যে অহংকারের ফানুসে ভর করে হাওয়ায় ভাসছে। সেখানে চাটুকারিতা আছে, অযোগ্যের পদলেহনও থাকতে পারে, মধ্যমানের মেধা ও অসম্পূর্ণ বিদ্যার অহংকার আছে, বিরাট attitudeও হয়ত আছে, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি-বাস্তবতার মাটির সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। যে সব শিল্পপতিরা আকাশচুম্বি সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করছেন দেশে বিদেশে, তাঁদের উদ্যোগের আলোয় রাজ্যকে আলোকিত করতে গেলে তাঁদের priorityগুলোকেই যে প্রাধান্য দিতে হবে, তাঁদের field এ তাঁরাই যে boss এবং এই মুহূর্তে রাজ্যেরই যে তাঁদেরকে প্রয়োজন, তাঁদের যে পশ্চিমবঙ্গে উদ্যোগ না সাজালেও কিচ্ছু যায় আসে না, মুখ্যমন্ত্রীকে তা বুঝতে হবে এবং সেই কারণেই প্রশাসনিক পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে তাঁদেরকে সব রকম সুবিধা দিতে হবে ও নিশ্চিত করতে হবে যে কোনো অঞ্চলে ব্যবসায়িক উদ্যোগ স্থাপন করতে গিয়ে লোক্যাল এবং রাজনৈতিক fringe element এর দ্বারা তাঁরা যেন কোনোভাবে লাঞ্ছিত না হন।
কিন্তু এইটি নিশ্চিত করা মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ ওঁর নিজের পলিটিক্যাল উত্থান fringe element হিসেবেই এবং পরবর্তীকালে সমস্ত fringe elementদেরকে motivate করেই crafted হয়েছে ওনার নিজের রাজনৈতিক জীবন। তাই এখন জীবনের এই পর্যায়ে এসে লোক্যাল গুণ্ডা, তোলাবাজ, অধিকারসচেতন, অল্পে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে আইন হাতে তুলে নেওয়া জনগণকে উল্টো শিক্ষা দিতে উনি পারবেন না, কারণ তা করতে গেলেই ওঁর ভোটবাক্স ফাঁকা হয়ে যাবে। মমতাদেবী চিরকালই মাটির কাছাকাছি মানুষদেরকে ক্ষেপিয়ে যে বিধ্বংসী শক্তি উৎপন্ন হয়েছে, তা ব্যবহার করে নেতিবাচক রাজনীতির পথে হেঁটেছেন। আজ ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে সেই মানুষগুলোকেই সুস্থিত, ধীর, ইতিবাচক, গঠনমূলক ও গ্রাউণ্ডেড হতে বলতে কি উনি পারবেন? না,পারবেন না। পারবেন না বলেই পশ্চিমবঙ্গে শিল্প হবে না। শিল্পের জন্য যে 'পরিবর্তন' প্রয়োজন ছিল, তা 'বহিরঙ্গের পরিবর্তন' নয়, প্রয়োজন ছিল 'মননশীলতার পরিবর্তনের'। সেই 'পরিবর্তন' এলে রাস্তাঘাট, জল, বিদ্যুত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সমস্ত 'পরিবর্তন' নিজে নিজেই হত; 'মননশীলতার পরিবর্তনের' ফলস্বরূপ। কিন্তু সেই 'পরিবর্তন' দূর-অস্ত।
মমতাদেবীর পক্ষে তো নয়ই, কারুর পক্ষেই এ রাজ্যে শিল্পোদ্যোগ গড়ে তোলা ততক্ষণ সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনের ধ্বংসাত্মক বামপন্থী ভাবধারার পরিবর্তন হচ্ছে। কথাটা আপনাদের কারুর কারুর একটু খারাপ, একটু বাড়াবাড়ি লাগল কি? বামপন্থা, সাম্যবাদের মত concept ধ্বংসাত্মক কিভাবে হতে পারে? এই বিষয়ে একটু বৈশ্লেষণিক চিন্তার প্রয়োজন আছে।
আমাদের রাজ্যে বামপন্থার হাওয়া বইতে শুরু করেছিল সেই ষাটের দশক থেকেই। গত চার দশক ধরে তা পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরও পন্থা। এই দীর্ঘ চার দশকে বামপন্থীরা রাজ্যের মানুষকে একটা কথা বুঝিয়ে দিতে পেরেছে যে মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ নেই, সবাই সমান এবং গণতন্ত্রে যে কোনো বিষয়ে কথা বলার অধিকার সবার আছে। এই অতিমাত্রায় অধিকার-সচেতনতার ভাবধারা মানুষের মনে যত বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে, রাজ্যের একদম সাধারণ মাটির মানুষগুলোর মধ্যে থেকে সত্যিকারের যোগ্যতা অর্জনের অর্থাৎ academic এবং non-academic প্রকৃত দক্ষতা বা skill অর্জনের ইচ্ছা তত নষ্ট হয়ে গেছে। বামপন্থা যত তাঁদেরকে অধিকার-সচেতন করে তুলতে চেয়েছে, তাঁদের দায়িত্ববোধ তত নষ্ট হয়ে গেছে। অধিকার আর দায়িত্ব যে পাশাপাশি চলে, বামপন্থা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তা ভুলিয়ে দিয়েছে। বামপন্থা তাঁদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও টাকাপয়সার basic needগুলিকে যত loudly রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছে, ততই তাঁদের 'achievement need' কে নষ্ট করেছে। মানুষে মানুষে সাম্য ও সমানাধিকারের উচ্চমার্গীয় দর্শনকে রাস্তায় লজেন্সের মতো বিলোতে শুরু করার মধ্যে দিয়ে বামপন্থা মানুষের সামনে achievement target বলে আর কিছু রাখতে চায় নি। একটি বাচ্চা বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। তাই আদর করে মা বাবা তার নামই রেখে দিল ডঃ শুভ হালদার। ফলে, শুভ'র জীবনে ডাক্তার হওয়া একটা স্বপ্ন হিসেবে আর থাকল না। ফলে সেই স্বপ্ন chase করতে গিয়ে সত্যিই ডাক্তার হয়ে ওঠা তার আর হল না।
বামপন্থীরা রাজ্যের সবচেয়ে বড় ক্ষতি যা করেছে তা হল, তারা মানুষের জীবনের quest নষ্ট করে দিয়েছে। যে quest একটা মানুষকে 'কিছু হয়ে ওঠা', 'কিছু করে দেখানো'র দিকে নিয়ে যেতে পারে, সেই খোঁজটা এ রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে নষ্ট করে দিয়েছে বামপন্থা। দিগ্বিদিকে দার্শনিক সাম্রাজ্যবাদের ঢক্কানিনাদে প্রচারিত হতে থেকেছে 'সকলে সমান', 'সবাই এক', 'কেউ কারুর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়', শুধু বামপন্থার ছাতার তলায় এস, তাহলেই শুভ হালদার হবে ডঃ শুভ হালদার।
আর যে সব বুদ্ধিমান মানুষ এই আপাত পণ্ডিতম্মন্য ধূর্ততা ধরতে পেরেছিলেন এবং যাঁদের সামর্থ্য ও দূরদৃষ্টি ছিল বা আছে, তাঁরা নিজেরা অথবা নিজেদের সন্তানদের রাজ্যের বাইরে বা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রকৃত শিক্ষা ও বৃহত্তর মনুষ্যত্ব লাভের উদ্দেশ্যে। এইভাবে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের মেধাবী মানুষেরা বেরিয়ে গিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে। সাম্যের গুরুপাক খাদ্য তাঁদের পাচনতন্ত্রে গোলমাল বাঁধিয়ে দিয়েছিল। আর পশ্চিমবঙ্গ পড়ে থেকে গিয়েছে বার বার মন্থন করে মাখন তুলে নেওয়া মাঠাহীন পাতলা ট্যালটেলে দুধের মত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে "দুধ ক্রমশঃই কাকচক্ষুর ন্যায় স্বচ্ছ, নীলবর্ণ ধারণ করিতেছে", অর্থাৎ দুধ গিয়ে পড়ে রয়েছে কেবলই জল।
তার উপর পশ্চিমবঙ্গের জনসম্পদকে ক্রমশঃ আরও ভারাক্রান্ত, আরও নিম্নমানের করে তুলেছে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর দল। যারা আগে বাম আর এখন অতিবাম মমতাদেবীর ডেডিকেটেড ভোটব্যাঙ্ক।
বামপন্থার Intellectual terrorism ও psychological pollution পশ্চিবঙ্গের মানুষের মনোজগতে যে আগ্রাসী হামলা করেছে, তার ফলে রাজ্যের বহু মানুষ psychologically এক একজন উগ্রপন্থীতে পরিণত হয়েছে।
এই মানুষগুলো শিল্পপতিদের শিল্পোদ্যোগের পথে প্রধান বাধা। এদের দৃষ্টিতে শিল্পপতি মানে হল মালিক যারা নিজেরা কোনো কাজ করে না, শ্রমিক খাটিয়ে শুধু মুনাফা লোটে। ফলে তাদের হয়ত মনে হয়, 'লাভ তুমি একা করবে কেন চাঁদ, আমাদেরও কিছু ছাড়! আগে আমাদেরকে মাল্লু ছাড়, তারপর আমাদের এলাকায় ব্যবসা করতে দেব।' ফলে শিল্পপতিদের আর এখানে ব্যবসা করা হয়না। মনে রাখতে হবে আমাদের রাজ্য মাফিয়াদের রাজ্য নয় কারণ লোক্যাল দাদারা এখানে প্রত্যেকেই এক এক জন অতি ক্ষুদ্র মাফিয়া। এই এতজন ক্ষুদ্র মাফিয়াকে simultaneously তুষ্ট করে ব্যবসা করা কোনো শিল্পপতির পক্ষে সম্ভব নয়। কেন বলুন তো? কারণ এই মাইক্রোস্কোপিক মাফিয়াদের তুষ্ট করা কোনোভাবে সম্ভবই নয়। কারণ আপাতভাবে এরা টাকাপয়সার দাবী তুললেও, এদের আসল দাবী টাকাপয়সা নয়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ money-minded নয়, এরা চায় গুরুত্ব, সম্মান। কারণ বামপন্থা তাদের মনোজগতে একটা কথা গজাল মেরে গুঁজিয়ে দিয়েছিল যে by their sheer existence, তারা কোনো অংশে কারুর চেয়ে কম নয়। শিল্পপতি যা, তারাও তাই। তাই শিল্পপতির ঠাট বাট রোয়াব তাদের মনোজগতে গোলমাল বাঁধিয়ে দেয়, তাদের মটকার ঘিলু ফুটতে আরম্ভ করে, নিঃশ্বাসে বেরোতে আরম্ভ করে ঈর্ষার বিষের ধোঁয়া। 'কিসের এত দেমাক তোর? পয়সা আছে বলে? যাঃ, করতে দেব না এখানে ব্যবসা! খাটবে এখানকার লোক আর পয়সা লুটবি তুই? তোর মাথা এমনিতেই তেলা, আরও তেল ঢালতে দেব না। ফোট্ এখান থেকে।' বেচারাদের অবচেতন মন যত বেশি করে উপলব্ধি করে যে তারা জীবনে হতে পারে নি কিছুই, সচেতন মনের বামপন্থী মিথ্যা স্তোকগুলি ততই তাদের বিদ্রোহী করে তোলে প্রকৃত মেধা, প্রকৃত সম্ভাবনার বিরুদ্ধে।
আর পশ্চিমবঙ্গের এই মানুষগুলোরই যথার্থ প্রতিনিধি হলেন মমতাদেবী। তিনিও এই মানসিকতারই ধারক, বাহক ও প্রচারক। বাম-বাংলার সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি মমতাদেবীই, কারণ তিনিই পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর প্রকৃত প্রতিনিধি। তিনি একেবারেই তাদের মত। চিন্তায়, ভাবনায়, ভাষায়, মননে মমতাদেবী বামপন্থার সবচেয়ে glorified victim. হ্যাঁ victim. জ্যোতি বসুর বামপন্থী সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে glorified শিকার হলেন মমতাদেবী। জ্যোতি বসু বামপন্থার বিষ প্রয়োগ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজে সেই বিষ গ্রহন করেন নি কোনোদিন। তাই গলদা চিংড়ি আর blue label চালিয়ে গেছেন সারাজীবন। কিন্তু জ্যোতিবাবুর পশ্চিমবঙ্গে বেড়ে উঠে মমতাদেবী হলেন সেই বিষের প্রধান ও সবচেয়ে prominent শিকার।
আমাদের রাজ্যে আজ ঘরে ঘরে আছে মমতাদেবীর মত মানুষ। সহজ, সরল, সাধারণ, মাটির কাছাকাছি, বিদ্যা অল্পবিস্তর থাকলেও মূলতঃ শিক্ষার অভাবে অভাবগ্রস্ত, প্রবল অহংকারী, অবিমৃশ্যকারী এবং সেই জন্যই আগুপিছু ভাবতে না পেরে স্বেচ্ছাচারী। কেন তিনি অমন কবিতা লেখেন? কারণ তিনি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে ওগুলো ভালো কবিতা। এই বিশ্বাস সম্ভবতঃ আসে বোধের অভাব থেকে, intellectual dwarfism থেকে, যা বামপন্থার direct outcome. মানুষ যদি তেমন কিছু না করেই যে কোনো বিদ্বান, জ্ঞানী গুণী মানুষের সমকক্ষ বলে নিজেকে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে অল্প বয়স থেকে, তাহলে maniac হয়ে ওঠা বা intellectual dwarfism এর শিকার হয়ে পড়া তার পক্ষে কিছুই আশ্চর্য নয়। মমতাদেবী জানেন ওঁর রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ এরকম কবিতা কেন, নিজের নাম পর্যন্ত সঠিকভাবে লিখতে জানে না। অর্থাৎ তিনি যাঁদের প্রতিনিধি, তাদের চেয়ে ঢের এগিয়ে তো তিনি আছেনই।
এই মানসিকতা যতদিন পর্যন্ত না বদলাবে, যতদিন পর্যন্ত না রাজ্যের মানুষকে বোঝানো যাবে যে শিল্পায়ন প্রয়োজন রাজ্যের মানুষের স্বার্থেই, শিল্পপতিদের স্বার্থে নয়, শিল্পপতিরা কাজের সুযোগ তৈরি করেন বলেই শ্রমিক কাজ পায়, কাজের সুযোগ তৈরি করাও একটা বিরাট বড় কাজ যা একমাত্র শিল্পপতিরাই করতে পারেন, ততদিন এ রাজ্যে শিল্প হবে না। অর্থাৎ মানুষকে বুঝতে হবে যে শ্রমিক শ্রমিকের জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ, আর শিল্পপতি শিল্পপতির জায়গায়। দু'জনের তুলনা চলে না। সাম্যের অর্থ মুড়ি-মিছরির এক দর নয়। একথা মেনে নেওয়ার মধ্যে কোনো অগৌরব নেই যে বেশিরভাগ মানুষই মুড়ির মত সাধারণ এবং অল্পসংখ্যক লোক মিছরির মত বিশেষ বলেই মুড়ি ও মিছরির মিশ্রণটা সুস্বাদু। এই স্বীকারোক্তিতে মুড়িরও গৌরব বৃদ্ধি বই হ্রাস পায় না এবং বহু সংখ্যক মুড়ি তাতে পরবর্তীতে মিছরিতে পরিণত হওয়ার দিকে পা বাড়াতে পারে।
অর্থাৎ বামপন্থার ঠিক বিপরীতধর্মী একটি মনোভাব যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজ্যের একদম সাধারণ মানুষের মধ্যে আসছে, ততক্ষণ দু একটি কারখানা, দু একটি ছোটোখাটো ই কমার্স ব্যবসা দীর্ঘ বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায় যদি বা গড়ে উঠতেও পারে, কিন্তু রাজ্যের overall শিল্পহীন-বস্তি-look তাতে বদলাবে না। ঠিক যেমনভাবে সজ্জন জিন্দলদের একটি ইস্পাতকারখানা এ রাজ্যে গড়ে তোলার কথা শুরু হয়েছিল সেই সুদূর ১৯৯৫ এ, জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এবং সে কারখানা কোনোদিনই হয় নি, ঠিক সেভাবেই পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বিনিয়োগ সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে। আজ এতদিনে, দীর্ঘ ২২ বছর পর, সেই জিন্দলরা অবশ্য এ রাজ্যে একটি কারখানা গড়ে তুলতে পেরেছেন! ইস্পাতের নয়, সিমেন্টের। এখন দেখতে হবে সে কারখানা কতদিন চালু থাকে! আরও একটি বিষয় হল, কারখানা গড়লেও জিন্দলদের হেড অফিস কলকাতায় নয়। বড় বড় কর্পোরেটের হেড অফিস বা অন্ততঃ পক্ষে বড় রিজিওনাল অফিস যতদিন পর্যন্ত না কলকাতায় গড়ে উঠছে, ততদিন শহর কলকাতার গায়ে সেই পুরোনো কর্পোরেট হাওয়া লাগবে না আর কলকাতার প্রকৃত আধুনিক তিলোত্তমা হয়ে ওঠাও হবে না। ততদিন পর্যন্ত কলকাতাকে মমতাদেবীর signature শহর হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
সেই জন্য প্রথমেই বলেছিলাম যে রাজ্যের ধ্বংসাত্মক বাম-মানসিকতায় যতদিন পর্যন্ত 'পরিবর্তন' না আসে, ততদিন রাজ্যের প্রকৃত 'পরিবর্তন' সম্ভব নয়। ততদিন পর্যন্ত কেবলমাত্র শিল্প গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে রাজ্যের মানুষকে। কারণ শিল্পপতিরা জানেন যে মমতাদেবী নিজে বিজনেস সামিট করতে পেরে এবং লগ্নির মৌখিক আশ্বাস পেলে খুশি হন। তাই আশ্বাস দিতে তাঁরা কার্পণ্য করেন না। তাঁরা বোধ হয় আন্দাজ করেন যে তাঁদের এই আশ্বাসই আগামী এক বছর মমতাদেবীর বহু রাজনৈতিক ভাষণের রসদ জোগাবে। তাই বিজনেস সামিটে এসে যে আদরযত্ন তাঁরা পান, তার বদলে এই আশ্বাসটুকু দিলে তাঁদের কোনো ক্ষতি নেই বিবেচনা করেই হয়ত শিল্পপতিরা রাজ্যে লগ্নি করার মৌখিক ও লিখিত আশ্বাস দিয়ে যান। মনে মনে তাঁরা বোধ হয় জানেন, তাঁদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের যা আছে, তা jealousy, appreciation নয়। যতদিন পর্যন্ত এই jealousy appreciation এ পরিণত না হয়, ততদিন পশ্চিমবঙ্গে শিল্প হবে না।
ধুরন্ধর শিল্পপতিরা বিলক্ষন জানেন যে এই রাজ্যে শিল্প-লগ্নির পথে সবচেয়ে বড় বাধা তিনিই যিনি তাঁদেরকে শিল্প গড়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
Comments
Post a Comment