হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ: কাজী নজরুল ইসলাম

আজ রাজ্যের বাম-বুদ্ধিজীবীদের সম্প্রীতি মিছিল। তার প্রাক্কালে এই লেখাটি পেলাম WhatsApp এ। সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ীর লেখা, ছত্রে ছত্রে বামমনস্কতার উদ্ভাস। এ লেখা মানুষের মন না ছুঁয়েই যায় না। বাঙালীর আবেগের গালে টোল ফেলা হাসির শেষে উথলে ওঠা কান্না যদি গলার কাছে দলা পাকিয়ে না-ই উঠল, তবে আর এমন লেখার সার্থকতা কি? বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা তো প্রায়শঃ লেখেন এমন লেখা। ভণিতা অনেক হল। পড়ুন দেখি এবার লেখাটি।

না, দাঁড়ান, লেখাটি পড়ার আগে আর একটি কথা। লেখা পড়ে যতই আবেগ মথিত হয়ে পড়ুন না কেন, যদি সেখানেই থেমে যান, তবে হয়ত আপনিও হয়ে পড়তে পারেন তথাকথিত বামমনস্কতার ছোঁয়াচে রোগের শিকার। তাই সেই রোগের প্রতিষেধক টিকা হিসাবে আগেই বলে রাখি যে সেখানেই থেমে না গিয়ে দয়া করে শেষ পর্যন্ত পড়বেন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে।

"আসানসোলের চাঁদমারি মোড়ে দাঁড়িয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওকে রোড কী ভাবে যাব। ভদ্রলোক আঁতকে উঠলেন— ‘ওখানে যাবেন কেন! পুরোটাই মুসলিম মহল্লা। কখন কী হয়ে যাবে কিচ্ছু বলা যায় না। এখনও টেনশন রয়েছে। পুলিশ টহল দিচ্ছে। অন্য কোথাও যান।’’ ড্রাইভারও দেখলাম ইতস্তত করছেন। করারই কথা। একটু আগেই আমরা আধপোড়া রিলায়েন্স মার্কেট পেরিয়ে এসেছি। চাঁদমারি, কল্যাণপুর, কসাই মহল্লা, শ্রীনগর, আমবাগান ঘুরেছি। রিলিফ ক্যাম্পে গিয়েছি। আমরা ভয় দেখেছি। আমরা ভয় পেয়েছি। রিলায়েন্স মার্কেটের সামনে শুনশান রাস্তা। গাড়ি চলছে না। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। মোড়ে মোড়ে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি। সবমিলিয়ে একটা অদ্ভুত ইমেজ— শেষ মার্চের চাঁদিফাটা রোদ্দুর গায়ে মেখে অতিকায় সাপের মতো রাস্তা নেমে গিয়েছে। রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য গেরুয়া নিশান। এক একটা ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু। তার নীচে পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনীর ফ্ল্যাগ মার্চ। বাস্তবে, এই ক’দিন আসানসোল-রাণিগঞ্জে ঘুরে নতুন করে চিনেছি গেরুয়া পতাকাকে। মহল্লার পর মহল্লা গেরুয়া ঝান্ডায় ছয়লাপ। হাজার হাজার, অসংখ্য। শিল্পশহরের শরীরে উল্কির মতো ওই নিশানগুলিই বলে দেবে, আপনি একুশ শতকের ভারতবর্ষের বাসিন্দা। আপনি এসেছেন অধিকৃত এলাকায়।

চাঁদমারি ছাড়ালাম। কিছু দূর যাওয়ার পরই শুরু হল ঘিঞ্জি, নোংরা এলাকা। গায়ে গায়ে লেগে থাকা বাড়ি। মসজিদ। ফেজ টুপির মানুষ। কয়েকটা চাঁদ-তারা আঁকা নিশান। সেই সঙ্গে গেরুয়া পতাকাও । তৃণমূল, বিজেপি’র অনেকগুলি দফতর। জমজমাট। একটা লাল পার্টির অফিস। বন্ধ। আরেকটু এগোতে এলাকার চরিত্র বদলে গেল। এখানে হিন্দুর সংখ্যা কম। রাস্তায় ভিড়। গরীব মহল্লা। মলিন পোশাক। ডাস্টবিন উপচে পড়ছে। একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ালাম। ভিড় জমে গেল। দোকানদারের চোখে সন্দেহ। জানতে চাইলাম, নূরানী মসজিদে কী করে যাব। পাশ থেকে উত্তর এল— ‘কী দরকার!’ বললাম, যে ইমাম সাহেবের ছেলে মারা গিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। ফোনে কথা হয়েছে। আসতে বলেছেন। এ বার পরিস্থিতি সহজ হল। পরিচয় জানতে চাইলেন স্থানীয়রা। কিছুক্ষণ কথা হল। রাস্তা বাতলে দিলেন দোকানদার। তারপর গলা নামিয়ে— ‘আসলে বুঝতেই পারছেন, এই ক’দিন ঝড় গেছে। এখনও পুরোপুরি মেটেনি। তাই…’

স্টেশনের কাছাকাছি যখন এলাম, রাস্তায় একটাও লোক নেই। ফাঁকা। এদিকে রাস্তাঘাটও চিনি না। ইমাম সাহেবকে ফোন করছি, ধরছেন না। আচমকাই একটি মুসলিম পরিবারের সঙ্গে দেখা হল। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, তিনি কারবালা মসজিদের ইমাম। সঙ্গে স্ত্রী এবং আরেক আত্মীয়া। বললেন, নূরানী মসজিদেই যাচ্ছেন। গাড়িতে তুলে নিলাম, গল্প শুরু হল। প্রথমে খানিক সাবধানী, তারপর মন খুলে কথা বললেন। কারা দাঙ্গা করল, কী ভাবে করল, কারা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ঘুঁটি সাজাল, কারা এই সুযোগ দখল বাড়াল কোলিয়ারিতে, কারা পড়শি রাজ্য থেকে বাইক নিয়ে ঢুকে পড়ল দলে দলে— শুনলাম। সে সব এখানে বলার নয়। শুধু একটি কথা কানে লেগে আছে— ‘আপনার বয়স কম, কলকাতায় থাকেন। কী বলব আপনাকে.. আমরা তিন পুরুষ ধরে এখানে থাকি। এই দাঙ্গা যে আমাদের কাছে কতবড় লজ্জা, তা বলে বোঝাতে পারব না। অথচ, বিশ্বাস করুন, এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। এটা করানো হল।’’

গলির পর গলি, সরু রাস্তা, রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকা গরু আর অসংখ্য ধর্মীয় নিশান পেরিয়ে জাহাঙ্গীরি মহল্লায় পৌঁছনো গেল। সম্পূর্ণ মুসলিম এলাকা। হিন্দু কার্যত নেই। নূরানী মসজিদে ঢোকার ঠিক আগে, গলির মুখে গাড়ি ঘিরে ধরলেন জনা কুড়ি যুবক। নামতে হল। কোথা থেকে আসছি, কী দরকার সে সব বিস্তারিত জানতে চাইলেন। বললাম। মনে হল, বিশ্বাস করছেন না। ইতিমধ্যে ফের ফোন করলাম ইমাম সাহেবকে। ধরলেন না। হাওয়া গরম হচ্ছে। আমাদের গাড়িতে করে যে ইমাম এসেছিলেন, তাঁকেও দেখতে পাচ্ছি না। একজন একটু গলা চড়িয়েই বললেন, ক্যমেরা গাড়ির ভিতরে থাকবে। রাখা হল। একটু অস্বস্তি হচ্ছে। বুঝতে পারছি না কী করব। আচমকাই ফোন বাজল। ইমাম সাহেব ফোন করেছেন। বললেন, মসজিদে চলে আসতে। এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন তাই কল রিসিভ করতে পারেননি। যাঁরা ঘিরে ধরেছিলেন, তাঁদের বললাম। সঙ্গে সঙ্গে সহজ হল পরিস্থিতি। সবচেয়ে উত্তেজিত ছিলেন রিয়াজ নামে এক যুবক, তিনি ক্ষমা চেয়ে বললেন, ‘‘ভাইসাব, রাগ করবেন না। আপনার বাইরে থেকে এসে ভাবতে পারবেন না গত কয়েকদিন কী চলেছে! দুই সম্প্রদায়েরই সাধারণ মানুষের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে এমন করতে হচ্ছে।’’ এরপর ঘটনাক্রমের বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন, সে সব এখানে বলার প্রয়োজন, ইচ্ছা কোনওটাই নেই।

নূরানি মসজিদ খুব বড়ো নয়। সাধারণ, মাঝারি মাপের। মসজিদের বাইরে খানিকটা খোলা জায়গা। সেখানেই গাড়ি রাখলাম। ওই জমিতেই ইমাম সাহেবের খুন হওয়া পুত্র সিবঘাতুল্লার রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহটি রাখা ছিল ক’দিন আগে। জানাজার জন্য উপস্থিত হাজার হাজার উন্মত্ত জনতার সামনে বাওয়াব গাছের মতো দাঁড়িয়েছিলেন ইমাম মহম্মদ ইম্মাদুল্লাহ। শান্ত গলায় বলেছিলেন, ‘‘আল্লাহ সিবঘাতুল্লাকে যেটুকু জীবন দিয়েছিলেন, ও সে ক’দিনই বেঁচেছে। আমরা যেন কোনও নির্দোষ ব্যক্তির উপর সে জন্য চড়াও না হই। ও আমার সন্তান। বাবা হয়ে যদি এ আঘাত সহ্য করতে পারি, তাহলে তোমরা কেন পারবে না! যদি কেউ কোনওরকম হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাও, আমি এই মসজিদ এবং আসানসোল ছেড়ে চলে যাব।’’

মসজিদের সিঁড়ি দিয়ে উঠে দো’তলা আর তিনতলার মাঝখানে একটি ছোট্ট ঘর। দেওয়ালের রং সবুজ। একটাই জানলা। মাটির উপর কম্বল পাতা। জানলার দিকে মুখ করে বসে ছিলেন ইমাম সাহেব। আমি ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালেন, হাত ধরে নিয়ে এসে বসালেন। জানলা দিয়ে তখন এক চিলতে আলো তাঁর মুখে এসে পড়েছে। সদ্য সন্তানহারা বাবার চোখদু’টি শান্ত, উজ্জ্বল। চোখের নীচে গভীর কালি। সম্ভবত, রাত্রি জাগার চিহ্ন। বললেন, ‘‘কলকাতা থেকে এসেছেন! বলুন কী জানতে চান। আমার মতো সামান্য মানুষ আপনাকে কী-ই বা আর বলব!’’ এরপর এক ঘন্টা আমরা অনর্গল কথা বলেছি। উনি হিন্দি আর ভাঙা বাংলা মিশিয়ে, আমি উল্টোটা। ধর্ম নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, সংসার নিয়ে, ভালবাসা, মৃত্যু, সংস্কার-কুসংস্কার নিয়ে, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেছি আমরা। সে সব আপাতত বিশদে লিখতে ইচ্ছে করছে না। ঘন্টাখানেক পর যখন মসজিদ ছেড়ে বেরচ্ছি, মনে হচ্ছিল, স্নান করে উঠলাম।

ইমাম বললেন, ‘‘আমাকে অনেকে খুব অসাধারণ মানুষ ভাবছেন। আমি সত্যিই জানি না এর কারণ কী! আপনি পারতেন আপনার ছেলের মৃত্যুর জবাব হিসাবে আরও অনেকগুলো লাশ ফেলতে? তাতে কি আপনার মৃত সন্তানেরই অসম্মান হত না? এমন কেন করবে মানুষ! সকলে যা করতেন আমি সেটুকুই করেছি।’’ বললেন, ‘‘আমি আপনাদের মতো শিক্ষিত নই। খুব সাধারণ একজন মানুষ। আল্লার সেবক। ইমাম হিসাবে আমি মনে করি, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃস্টান সকলেই আমার সন্তান। তাছাড়া, মৃত্যুর জবাব কখনও মৃত্যু হতে পারে না। হওয়া সম্ভব নয়। আমি যতদিন বাঁচব, আপ্রাণ ধর্মের নামে হানাহানি আর হিংসা রুখব। এটাই আমার ধর্ম। মানুষের ধর্ম।’’ বললেন, ‘‘আমরা ভারতবর্ষের মানুষ। এ এক আশ্চর্য দেশ। কত বড় বড় ধর্মগুরুরা এ দেশে জন্মেছেন। এই দেশের মূল কথাই হল সম্প্রীতি। আমরা ছেলের স্মৃতির মধ্যে দিয়ে আমি এই চিরন্তন ভারতবর্ষের খোঁজ করছি। যে ভারতবর্ষে ধর্মের নামে হানাহানি নেই, রক্তপাত নেই, তেমন ভারতবর্ষের খোঁজ করছি আমি।’’ বললেন, ‘‘আমি রামায়ণের গল্প শুনেছি। আমি শুনেছি, রামচন্দ্র খুব বড় রাজা ছিলেন। দেশ ভাল চললে বলা হয় রামরাজ্য। আমার ছেলেকে যারা খুন করল, তারা রামকে চেনে না, হিন্দু ধর্মকেও জানে না, ইসলাম সম্পর্কেও জানে না। যদি ওরা সত্যিই ধর্ম সম্পর্কে জানত, তাহলে অমন ফুটফুটে ছেলেটাকে মারতে পারত না। ওদের হাত কাঁপত। আমি ওদের ক্ষমা করে দিয়েছি।’’ প্রশ্ন করলাম, ‘‘আপনার ছেলেকে যারা খুন করেছে, তাদের নামে অভিযোগ করবেন না পুলিশে!’’ উত্তর দিলেন, ‘‘আমি তো সেই সময় ঘটনাস্থলে ছিলাম না। কী করে নিশ্চিত হব যে ২৪ জনের নাম আমার কাছে আছে, তারাই সিবঘাতুল্লাকে মেরেছে! নির্দোষরাও তো শাস্তি পেতে পারে। তাই আমি কারও নাম বলব না। বলতে পারব না। আমি শান্তি চাই। যদি এই শহরে শান্তি ফেরে তাহলেই সিবঘাতুল্লার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।’’

ইমাম সাহেব অস্বাভাবিক শান্তভাবে উত্তর দিচ্ছিলেন আমার প্রশ্নের। একবার শুধু একটু রেগে গেলেন। বলেছিলাম— ‘আপনি নিশ্চয় জানেন, আপনার সম্পর্কে বলা হচ্ছে, এই শহরের বাসিন্দাই নন আপনি। সিবঘাতুল্লাও না কি বাইরে থেকে এসেছে।’’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর মৃত ছেলের ছবি আর কিছু ধর্মীয় বইপত্রের ভিতর থেকে দু’টো আধার কার্ড বের করে বললেন, ‘‘ছবি তুলে নিন এগুলোর। যারা এমন বলছে, তাদের গিয়ে বলুন, আমরা শতাধিক বছর ধরে এই শহরে রয়েছি। আমার বাবাও আসানসোলেরই ইমাম ছিলেন। কেন এমন করছে ওরা! কী পাচ্ছে! আমার ছেলেটাকে মেরেও শান্তি হল না! আমি তো কাউকে কিছু বলিনি। নিজের মতো রয়েছি। কেন আমার নামে, আমার মরা ছেলের নামে এ রকম বলছে! ওরা কি জানে না মৃত্যুর পর মানুষকে বিরক্ত করতে নেই!’’

ছোটবেলায় আসানসোলেই পড়াশোনা করেছেন ইম্মাদুল্লাহ। তারপর উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষার জন্য চলে যান সাহারানপুরে। সেখান থেকে ফিরে ১৯৮৯ সালে ২০ বছর বয়সে নূরানি মসদিজের ইমাম হন। স্ত্রীর নাম খাদিজাতুলকুব্রা। বলছিলেন, ‘‘আমি তো কোনওরকমে ঠিক আছি, কিন্তু আমার স্ত্রীর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ছেলে মারা যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভুল বকছে, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। আসলে ছেলেটাকে বড্ড ভালবাসতাম আমরা। কেমন মন দিয়ে পড়াশোনা করত! ছোট থেকেই খুব পড়ুয়া ছিল। এই তো মাধ্যমিক দিল। দেখবেন, ভাল নম্বর পাবে। ইচ্ছে ছিল, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে পড়াব। হল না! সব কী আর হয়!’’ মনে হল, এই এতক্ষণ পর ঈষৎ গলা কাঁপল ইমাম সাহেবের। তারপরই সামলে নিয়ে বললেন, ‘‘আমার একার তো ছেলে মরেনি। আরও মরেছে। সব সম্প্রদায়েরই মরেছে। আমরা যদি একসঙ্গে চেষ্টা করতে পারি, যদি আমরা প্রতিজ্ঞা করি আর হানাহানি করতে দেব না, দেখবেন অবস্থাটা বদলে যাবে।’’

প্রণাম করতে গেলাম। হাত চেপে ধরলেন। জড়িয়ে নিলেন বুকে। খানিকক্ষণ চেপে ধরে রইলেন। সন্তানহারা বাবার ঘামের গন্ধ নাকে আসছিল। আমার ব্যক্তিগত ঈশ্বরের গন্ধ।"
সৌজন্যে :সাংবাদিক Arka Bhaduri

এতক্ষণে বুঝেছেন নিশ্চয় কি বলতে চেয়েছেন কমরেড অর্ক ভাদুড়ী? শিবঘাতুল্লার ঘাতকদের ইমাম সাহেব চিনতে পারেন নি। কিন্তু ইনটেলিজেন্স তো পারবে। পুত্রহারা পিতা ঘাতকদের ক্ষমা করতে পারেন, কিন্তু শিবঘাতুল্লা যাদের সন্তান নয়, অর্থাৎ আমরা, তারাও কি পারি সেই ঘাতকদের ক্ষমা করতে? না পারি না। তাই আমরা চাই, এই হত্যার তদন্ত হোক্। দাঙ্গার পিছনে কাদের হাত? তদন্ত হোক! কমরেড সবই বললেন। কলমের সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন দাঙ্গার কারিগর বহিরাগত গেরুয়া বাহিনী। ঠিক যে কায়দায় এতকাল পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষের মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করা হয়েছে, সেই একই কায়দায়, কোনো তথ্য, কোনো প্রমাণ ব্যতিরেকেই কমরেড এই কথাটা অতি সযত্নে মানুষের মনে প্রোথিত করে দিতে চাইলেন যে দাঙ্গা বাঁধিয়েছে গেরুয়াবাহিনী। খেয়াল করুন, উনি বা ওনারা কিন্তু কোনো তদন্তের দাবী তোলেন নি। সত্য জানতেও চান নি। কারণ ওঁরা সর্বজ্ঞ, আর ওঁদের ইজম্ 'সর্বশক্তিমান'!

কিন্তু আমরা সর্বজ্ঞ নই। আমরা চাই সত্য উন্মোচিত হোক্। আমরা শিবঘাতুল্লার পরিচয় জানতে চাই, ইমাম সাহেবের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি কেন ছড়ালো তা জানতে চাই, এমনকি ইমাম সাহেবের মর্মবিদারক আত্মত্যাগের ঘটনার পর থেকেই আন্তর্জালে রাজ্যের ভোটার লিস্ট আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কেন, তা-ও জানতে চাই। কমরেড, কিছু জানেন নাকি?

আর কমরেড ভাদুড়ীর মত এই সব বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা কলমের খোঁচায় মানুষের আবেগ নিয়ে, জীবন নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে লোফালুফি খেলেন শুধু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে, যাঁরা শ্রেণীশত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামের নাম করে মানুষের স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক সমন্বয়ে ভাঙ্গন ধরান, আবেগে আঘাত করে সৃষ্টি করেন শ্রেণীবিভাজন এবং নিজেরা হয়ে ওঠেন স্বঘোষিত পৃথক একটি এলিট শ্রেণী, যেসব ধান্দাবাজেরা এতকাল যাবৎ পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির স্বতঃপ্রবহমান ধারাকে ধূর্ততার সাথে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছেন, বাঙালীকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতবে নিবীর্য করে দিতে চেয়েছেন, তাঁদের এমন তথাকথিত আবেগ মথিত লেখার জবাব বহুদিন আগেই লিখে গিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। আমি নিশ্চিন্তে তাঁকে উদ্ধৃত করতে পারি। কেউ আমাকে সাম্প্রদায়িক বলতে পারবেন না। বামপন্থীরা তো নয়ই। না, নজরুলের কবিত্ব প্রতিভার প্রতি সম্মানজনিত কারণে তাঁরা আমাকে সাম্প্রদায়িক বলতে পারবেন না, তা নয়। নজরুল মুসলমান ছিলেন বলে পারবেন না। এ কবিতাই যদি রবীন্দ্রনাথও লিখতেন, তাহলেও বামপন্থীদের দৃষ্টিতে তা হত 'সাম্প্রদায়িক', ঠিক যেমনভাবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বহুকাল তাঁদের কাছে 'বুর্জোয়া কবি'। এ কবিতা নজরুল লিখেছেন, তাই কেউ বলতে পারবেন না যে এর মাধ্যমে আমি দাঙ্গায় উস্কানি দিচ্ছি। এ কবিতা নজরুল লিখেছেন এবং কমরেড ভাদুড়ীর মত বুদ্ধিজীবীদের তিনি যথেচ্ছ গাল পেড়েছেন, তাই কেউ বলতে পারবেন  না এঁদেরকে 'দালাল' বলে গালাগালি আমি দিচ্ছি। নজরুল এক্সাটলি এই শ্রেণীটিকেই তুলোধোনা করেছেন এই বলে যে
"হায়, এই সব দুর্বল-চেতা,
হবে অনাগত বিপ্লব নেতা!"

এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল, নজরুলের "মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান" যতখানি বহুচর্চিত, নজরুলের এই কবিতাটি ঠিক ততখানিই অনুচ্চারিত। কতজন জানে নজরুলের এই কবিতাটির অস্তিত্ব? আমি নিশ্চিন্তে উদ্ধৃত করব। তাহলেই আমার সব কথা বলা হয়ে যাবে। কেউ আমাকে জেলে পাঠাতে পারবে না। কারণ এই প্রচণ্ড উস্কানিমূলক আহ্বানের উদ্গাতা কাজী নজরুল ইসলাম। বলছিলেন না সুবোধ সরকার, রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলা নাকি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখে নি? কবিতাটিতে এই ধরণের বক্তব্যকেই কি নজরুল 'প্রলাপ' বলেছেন? কবি সুবোধ সরকারের সমালোচনা করার যোগ্যতা আমার না-ই থাকতে পারে, কিন্তু নজরুলেরও নেই, তা নিশ্চয় কেউ বলবেন না? পড়ুন কবিতাটি। নামটিও দেখুন।
সঞ্চিতা, মে, ২০০৩ সংস্করন, পৃষ্ঠা নং ১১৪


হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ


মাভৈঃ মাভৈঃ এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ,
সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান গোরস্থান!
ছিল যারা চির-মরণ আহত,
উঠিয়াছে জাগি' ব্যথা-জাগ্রত,
খালেদ আবার ধরিয়াছে অসি, অর্জুন ছোঁড়ে বাণ!
জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান!



মরিছে হিন্দু, মরে মুসলিম এ উহার ঘায়ে আজ,
বেঁচে আছে যারা মরিতেছে তারা, এ-মরণে নাহি লাজ!
জেগেছে শক্তি তাই হানাহানি,
অস্ত্রে অস্ত্রে নব জানাজানি!
আজি পরীক্ষা -- কাহার দস্ত্ হয়েছে, কত দরাজ!
কে মরিবে কাল সম্মুখ-রণে, মরিতে কা'রা নারাজ!



মূর্চ্ছাতুরের কণ্ঠে শুনে যা জীবনের কোলাহল,
উঠিবে অমৃত দেরী নাই আর, উঠিয়াছে হলাহল!
থামিস নে তোরা, চালা মন্থন!
উঠেছে কাফের, উঠেছে যবন;
উঠিবে এবার সত্য হিন্দু-মুসলিম মহাবল।
জেগেছিস তোরা, জেগেছে বিধাতা, ন'ড়েছে খোদার কল!



আজি ওস্তাদে শাগরেদে যেন শক্তির পরিচয়!
মেরে মেরে কাল করিতেছে ভীরু-ভারতেরে নির্ভয়!
হেরিতেছে কাল, -- কবজি কি মুঠি
ঈষৎ আঘাতে পড়ে কি-না টুটি'
মারিতে মারিতে কে হ'ল যোগ্য, কে করিবে রণ-জয়!
এ 'মক্ ফাইটে' কোনো সেনানীর বুদ্ধি হয় নি লয়!



ক'ফোঁটা রক্ত দেখিয়া কে বীর টানিতেছে লেপ-কাঁথা!
ফেলে রেখে অসি মাখিয়াছে মসী বকিছে প্রলাপ যা-তা!
হায়, এই সব দুর্বল-চেতা,
হবে অনাগত বিপ্লব নেতা!
ঝড় সাইক্লোনে কি করিবে এরা! ঘূর্ণিতে ঘোরে মাথা?
রক্ত-সিন্ধু সাঁতারিবে কা'রা -- করে পরীক্ষা ধাতা!



তোদেরই আঘাতে টুটেছে তোদের মন্দির মসজিদ,
পরাধীনদের কলুষিত ক'রে উঠেছিল যার ভিত!
খোদা খোদ যেন করিতেছে লয়
পরাধীনদের উপাসনালয়!
স্বাধীন হাতের পূত মাটি দিয়া রচিবে বেদী শহীদ!
টুটিয়াছে চূড়া? ওরে ঐ সাথে টুটেছে তোদের নিদ!



কে কাহারে মারে, ঘোচেনি ধন্দ, টুটেনি অন্ধকার,
জানে না আঁধারে শত্রু ভাবিয়া আত্মীয়ে হানে মার!
উদিবে অরুণ, ঘুচিবে ধন্দ,
ফুটিবে দৃষ্টি, টুটিবে বন্ধ,
হেরিবে মেরেছে আপনার ভায়ে বন্ধ করিয়া দ্বার!
ভারত-ভাগ্য ক'রেছে আহত ত্রিশূল ও তরবার!



যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির চূড়া,
সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দুর্গ গুঁড়া!
প্রভাতে হবে না ভায়ে ভায়ে রণ,
চিনিবে শত্রু, চিনিবে স্বজন!
করুক কলহ -- জেগেছে তো তবু বিজয়-কেতন উড়া!
ল্যাজে তোর যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া!



কি বুঝলেন? নজরুলের মত আমিও বিশ্বাস করি যে নিজেদের মধ্যে হানাহানি, কাটাকাটি করতে করতেই হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত প্রকৃত পশ্চিমবঙ্গবাসী একদিন চিনে নেবে প্রকৃত শত্রুদের। সেদিন তারা একযোগে আঘাত হানবে সেই শত্রুদের ভণ্ডামির দুর্গে। ছিঁড়ে ফেলবে মেকি বুদ্ধিজীবীর মুখোশ। গুঁড়িয়ে দেবে তথাকথিত বাম-তৃণমূলীমনস্কতার ধোঁয়াশাচ্ছন্ন স্বার্থসিদ্ধির ইমারতকে, চিনে নেবে মানসিকভাবে বহিরাগতদের, চিনে নেবে বিদেশী পূজকদের, চিনে নেবে তাদের আসল শ্রেণীশত্রুদের। অর্ক ভাদুড়ীদের কলম সেদিন যাবে ভোঁতা হয়ে। সেদিন সে কলমের খোঁচায় আর কারুর হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণ হবে না। সেদিন হয়ত, 'উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল' থেমে গিয়ে সেই উৎপীড়িতদের হাতের 'Sword' will be proven to be mightier than the 'pen'. কি কমরেড, বড় ভয় পান না হানাহানির রাত্রিশেষে নতুন প্রভাতকালের সেই স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণকে? যে বিপ্লব আপনারা আনবেন না, আপনি আসবে, সে বিপ্লবকে বড় ভয়, তাই না, কমরেড?

Comments

  1. দারুণ লিখেছেন ।একদম মূলে কুঠারাঘাত করেছেন।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?