জেলাপ্রতি শরিয়তী আদালতের দাবী মৌলানাদের স্বার্থে

এই লেখাটি স্বস্তিকা ।। ১৩ শ্রাবণ - ১৪২৫।। ৩০ শে জুলাই ২০১৮ সংখ্যায় ছাপা হয়েছে। তাই লেখাটি আমার হলেও এর স্বত্ব স্বস্তিকারই।


মুসলমানদের জীবনদর্শন ও ধর্মবোধমধ্যে যতদূর বোঝা যায়, নিজেদের জীবনধারণ, জৈবিকতাপালন ও সাম্রাজ্যবিস্তার ভিন্ন গভীরতর ও বিস্তৃততর জীবনের সন্ধান নেই। মহাবিশ্বের মূল সৃষ্টিসূত্রের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করবার নিরলস প্রয়াস, যা মানবকে মনুষ্যোন্নত করে তোলে, তা বোধ করি তাদের নেই। ফলে তারা যে কাজই করুক, তার পিছনে তাদের নিজস্ব জীবন ও জৈবিকতাসংক্রান্ত অথবা নিজবর্গের বিস্তার সংক্রান্ত কোনোপ্রকার উদ্দেশ্য থাকবে, এ-ই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।

এই কারণেই ভাবা প্রয়োজন, AIMPLB যে প্রতি জেলায় শরিয়তী আদালত দাবী করল, তার প্রকৃত সম্ভাব্য কারণ কি হতে পারে। কেবলমাত্র ভারতীয় মুসলমানদের মেরুকরণ করাই তাঁদের উদ্দেশ্য, এমনটা বোধ হয় নয়, কারণ কংগ্রেস বা অন্যান্য সেকুলার দলগুলি তাঁদের মেরুকরণের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে দিলে AIMPLB র যত না লাভ হবে, সেই দলগুলির লাভ হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ কেবলমাত্র অন্যান্য সেকুলার দলগুলির নির্বাচনী অঙ্কের সুবিধে করে দিয়ে, তাদের কাছ থেকে কিছু আদায় করার মত সামান্য প্রাপ্তির জন্য AIMPLB এই বিশেষ দাবীটি বোধ হয় করেন নি; বিশেষতঃ AIMPLB র দাবী কিংবা মতামত যে ভারত সরকারকে মানতেই হবে, এরকম কোন সুনিশ্চিত সাংবিধানিক নির্দেশিকা যেখানে নেই। সেই পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলে সন্দেহ হয় যে ওঁদের এমন দাবীর পিছনে নিশ্চিতভাবেই কোনো গভীরতর উদ্দেশ্য আছে, এবং সে উদ্দেশ্য যত না মুসলমান জনসাধারণের মঙ্গলার্থে, তার চেয়ে AIMPLB, উলেমা, মৌলানা ইত্যাদিদের মঙ্গলার্থে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

মুসলমান সমাজে মৌলানাদের গুরুত্ব অত্যধিক। তাঁদের বিধানানুসারে ওঠাবসা করতে তারা বাধ্য হয়। প্রকৃতার্থে মুসলমানদের সর্বজনীন ঐক্যের সূত্রটি ঐ উলেমাশ্রেণীর হাতেই বাঁধা। একত্রিত মুসলমানভোট কার ঝুলিতে যাবে তা স্থির করার পরিবর্তে ক্ষীরটিও ওঁরাই লেহন করেন।  সাধারণ দরিদ্র মুসলমান তার কোন ভাগ পায় না। তাই প্রশ্ন হল, জেলাপ্রতি শরিয়তী আদালত স্থাপন করতে পারলে এই ধর্মগুরুদের কি এমন অতিরিক্ত সুবিধা হবে যা তাঁদের এখন হচ্ছে না? এর মাধ্যমে ওঁরা কি কিছু  অতিরিক্ত লাভ করতে চাইছেন? নাকি কোনোপ্রকার সম্ভাব্য ক্ষতি রোধ করতে চাইছেন?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট বোঝা প্রয়োজন। প্রায় সকলেই হয়ত অবগত যে তিন তালাক বিরোধী বিলটি সংসদের রাজ্যসভায় এখনও পাশ হয় নি। উক্ত বিলটিতে তিন তালাককে cognizable, non-bailable offence বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তিন তালাকপ্রাপ্ত মুসলমান নারী নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে তিন তালাক দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে পুলিশের সাহায্যপ্রার্থী হওয়া মাত্র পুলিশ তাঁর অভিযোগ গ্রহন করতে বাধ্য থাকবে (cognizable)। অর্থাৎ বিলটি অনুসারে পুলিশের পক্ষে অভিযোগের cognizance না নিয়ে বা অভিযোগ গ্রহন না করে স্বামীটির সুবিধা করে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। পুলিশকে অভিযোগ গ্রহন করতে হবে ও প্রয়োজনে স্বামীকে গ্রেফতার করতেও হবে। আর একবার গ্রেফতার করলে আদালতে না নিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্তে পুলিশের পক্ষে তাকে জামিন দিয়ে বা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার উপায় থাকবে না (non-bailable)। বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে কোর্ট অবধি গড়াবে এবং আদালত চাইলে সেই স্বামীকে জামিন দিতে পারবেন।

এই বিল একবার আইনে পরিণত হলে এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মুসলমান সমাজ থেকে তাৎক্ষণিক তিন তালাকের কুপ্রথাটি বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না। এবং তার ফলও হবে সুদূরপ্রসারী। বহুবিবাহ প্রথাটিও এর ফলে অনতিবিলম্বেই ধাক্কা খাবে। কিভাবে? আসুন দেখা যাক্।

ইসলামে একজন পুরুষ চারটি বৈধ বিবাহ করতে পারে। কিন্তু ইসলামের নির্দেশ হল একাধিক বিবাহ একজন পুরুষ তখনই করতে পারে যদি সে তার প্রতি স্ত্রীকে সম্পূর্ণ সমদৃষ্টিতে দেখতে পারে এবং তাদেরকে সম্পূর্ণ সমান স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করতে পারে। তা যদি সে না পারে, তাহলে একাধিক বিবাহ ইসলামসম্মত নয়। তবে, এক বা একাধিক (৪ এর কম) স্ত্রী বর্তমান থাকাকালীন নূতন কোনো নারীকে বিবাহেচ্ছুক কোনো বিশেষ মুসলমান পুরুষ তার নূতন স্ত্রীকে পুরাতন স্ত্রী(দে)র সাথে সমদৃষ্টিতে দেখতে সক্ষম কিনা, সেকথা স্থির করার অধিকার সম্ভবতঃ কেবলমাত্র তার বর্তমান স্ত্রী(দে)রই আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো মুসলমান পুরুষ তার স্ত্রী বর্তমান থাকতেও পুনর্বিবাহ করতে গেলে বর্তমান স্ত্রী(দে)'র তা নিয়ে আপত্তি জানানোর বাস্তবে কোনো উপায়ই নেই কারণ আপত্তি জানাতে গেলে তা(দে)র তিন তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু তিন তালাকের ভয় না থাকলে স্বাভিমানী নারী অনায়াসে তার স্বামীর পুনর্বিবাহে এই বলে আপত্তি জানাতেই পারে যে তার স্বামীর পক্ষে একাধিক স্ত্রীকে সমান সমাদর করা সম্ভব নয়। এবং এমতাবস্থায় পুরুষের একাধিক বিবাহ ইসলামের নিয়ম অনুসারে অনুমোদনযোগ্য নয়। অর্থাৎ তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথার বিলুপ্তির প্রায় অবশ্যম্ভাবী after effect হল বহুবিবাহ প্রথায় বাধা। কারণ মুসলমান পুরুষের পক্ষে আপন খেয়ালখুশি মত এক স্ত্রীকে তিন তালাকের অভিঘাতে ত্যাগ করে অথবা ত্যাগ করার ভয় দেখিয়ে অন্য কোনো মহিলাকে বিবাহ করে ফেলার বিষয়টি আর এত জলের মত সহজ থাকবে না।

ওদের এই সমস্ত সামাজিক প্রথা / কুপ্রথার নিয়ামক রূপে বিরাজ করেন এই কাজী, মৌলানাদি ব্যক্তিবর্গ। এতে করে ওঁদের প্রভূত অর্থযোগও থাকে। পুরুষ চাইলেই তালাক দেবে, আবার বিবাহ করবে। তালাকপ্রাপ্তা মহিলা উলেমাদের কাছে গিয়ে কেঁদে পড়বে, তারপর তাকে উদ্ধার করতে হলেও করবেন মৌলানারাই। এই প্রতিটি ধাপেই মৌলানাদের উপার্জনযোগ থাকে। তিন তালাক প্রথা হঠাৎ এরকম একটি কঠোর আইনের দ্বারা বাতিল হয়ে গেলে মৌলানাদের উপার্জন বহুলাংশে কমবে। উপরন্তু নিকাহ্ হালালাও যদি ভারতীয় আদালতের নির্দেশে কালক্রমে রদ হয়ে যায়, তা হলেও ওঁদের মুদ্রাপ্রাপ্তি ও অন্যতর ইহলৌকিক প্রাপ্তি আরও হ্রাস পাবে। এই সমস্ত আসন্ন ক্ষতির উপক্রম আঁচ করতে পেরেই বোধ করি AIMPLB জেলাপ্রতি শরিয়তী আদালত চেয়ে বসেছে, যদিও সে চাহিদা পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই ঘোষণা করেছেন ভারত সরকার।

এইবার প্রশ্ন হল, তিন তালাক বিরোধী আইন যদি এসেই যায়, তবে প্রতি জেলায় শরিয়তী আদালত থাকলেই বা কি উপকার হবে? তিন তালাকের দ্বারা অপদস্থ মুসলমান নারী তো এমন আইনের সুবিধা নেবেই। তারা শরিয়তী আদালতের দ্বারস্থ হবে কেন?

বোধ করি এই খানেই রয়েছে আসল প্রশ্নের উত্তর। মুসলমান নারী তিন তালাকের অভিযোগ নিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হলে পুলিশ যখন স্বামীকে তলব করবে, তখন স্বামী যদি দেখিয়ে দিতে পারে যে সে তার স্ত্রীকে তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেয় নি, বরং প্রথা মেনে শরিয়তী আদালতকে সাক্ষী রেখে ইসলাম নির্দিষ্ট পথে বৈধ তালাকই দিয়েছে, তা হলে সেই তালাককে বৈধ ও ইসলামসম্মত বলে গ্রহন করবার নৈতিক দায় পুলিশ ও আদালত উভয়েরই থাকবে। এবং প্রতি অবৈধ তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বৈধকরণ উপলক্ষ্যে মৌলানাদের মুদ্রাপ্রাপ্তি ঘটতেই থাকবে। আর শরিয়তী আদালত যদি নিকটবর্তী অঞ্চলে না থাকে, তবে তিন তালাক দেওয়ার পর স্ত্রী যদি পুলিশে অভিযোগ করে, তবে স্বামীর পক্ষে খুব শীঘ্র তার বৈধকরণ করে তার মিথ্যা প্রমাণ পেশ করতে অসুবিধা হবে। তাই শরিয়তী কোর্ট যদি প্রতি জেলায় থাকে, তবে ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে প্রায় সমস্ত মুসলমানেরই অবৈধ তালাকের বৈধকরণে সুবিধা হবে।

সন্দেহ হয় যে তাৎক্ষণিক তিন তালাক ও নিকাহ্ হালালার মত কুপ্রথাকে Article 25 এর দোহাই দিয়ে ঘুর পথে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়া এবং ভারতীয় আইন সেগুলিকে অবৈধ ঘোষণা করলেও সেই অবৈধ কার্যের অন্যায্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈধকরণের অভিসন্ধিই প্রতি জেলায় শরিয়তী আদালত দাবী করার প্রধান কারণ। 

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

এত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-খরা: কেন?

West Bengal: A Security Threat to India