মাঝেরহাট ব্রিজ: সরকারি তঞ্চকতা নাকি আত্মপ্রবঞ্চনা?
ভেঙ্গে পড়ল আরেকটি ব্রিজ। Mid sixties থেকে এই মাঝেরহাট ব্রিজ মূল কলকাতার সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছিল বেহালাকে। সেই ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ল গত পরশুদিন।
বেহালা আমার শ্বশুরবাড়ি। বিয়ে হওয়া ইস্তক বর্ধমান রোড থেকে বেরিয়ে মাঝেরহাট ব্রিজে ওঠার ব্যাপারটা এমনকি sleep-walking এর মধ্যেও আমার সড়গড়।
মাঝেরহাট ব্রিজের এই ভেঙ্গে পড়া একটি প্রতীকের মত। কলকাতার এতদিনের একটি অস্তিত্বচিহ্ন যেন মুছে গেল। মানুষকে গোড়া থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে এই মাঝেরহাট ব্রিজের ভেঙ্গে পড়া।
যাই হোক্, প্রথমেই বলি, এখানে যা বলব, তা অনেকেরই পছন্দ হবে না হয়ত। কিন্তু তাতে কি? Truth is often far from being comfortable.
ইণ্ডিয়া টুডে চ্যানেলের খবরে প্রকাশিত হয়েছে যে রেলওয়েজের এঞ্জিনিয়ার KMDA কে আগেই একাধিকবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছিলেন যে ব্রিজটির অবস্থা বিপদসীমা স্পর্শ করেছে, এবং মেরামতি ও maintenance প্রয়োজন। কিন্তু KMDA তাতে কর্ণপাত করেনি।
https://www.indiatoday.in/india/story/majerhat-bridge-collapse-railways-had-warned-about-weak-beams-exposed-reinforcements-cracks-on-pier-1333034-2018-09-05
এখন যখন ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে, তখন সবাই দোষারোপ করছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরকে, মুখ্যমন্ত্রীকে, কলকাতা পুরসভাকে এমনকি চেতলার ববি হাকিমকেও। ববি যদিও বলেছেন কোনো বড় ক্ষয়ক্ষতি হয় নি, 'সামান্য ঘটনা'! অর্থাৎ উনি যা উহ্য রেখেছেন তা হল, অজস্র মানুষ মরে নি। অনেক টাকা ক্ষতিপূরণে বেরোবে না। ওঁরা তো আবার ঘটনার ছোট বড় নির্ধারণ করেন ক্ষতিপূরণের তাপ্পি দিতে কত টাকা যাবে, সেই হিসাব করে। ব্রিজ ভাঙ্গল, তাতে কি? আবার সিণ্ডিকেটের ভেজাল সিমেন্ট দিয়ে, বাজে কোয়ালিটির গার্ডার দিয়ে ব্রিজ উঠে যাবে। বরং ভালোই হল, আরও কিছু মাল ঝাঁপার সুযোগ এসে গেল। বিল হবে একরকম কোয়ালিটির মালের, সাপ্লাই হবে অন্য কোয়ালিটি। মজুর চাপা পড়ল, মানুষ আহত হল, মরল, তারপর দীর্ঘকাল যাবৎ নিত্যযাত্রীরা নাকানি চোবানি খাবে খাক। ওঁদের তো পৌষমাস এসে গেল। অপ্রত্যাশিত, হিসাব-বহির্ভূত পৌষমাস! মাল ঝাঁপার এই সুযোগটা হিসেবের মধ্যে ধরা ছিল না। ওঁদের মনে তো লাড্ডু ফুটছে।
না। এসব বলার জন্য লিখতে বসি নি। আমার কথা অন্য।
এই যে আমরা KMDA কে দায়ী করছি, এর মাধ্যমে আসলে দায়ী করছি কাকে? বা কাদেরকে? ব্রিজ যে ভাঙ্গল, তার দায় কার? অনেকেই হয়ত বলবেন মন্ত্রীদের। কিন্তু তাই কি? ব্রিজের হাল হকীকৎ কেমন, তার কোথায় কোন্ maintenance এর প্রয়োজন, ববি হাকিম তা জানবেন কেমন করে? ববি হাকিমের এসব বোঝার ক্ষমতাই বা কি? উনি ব্রিজের maintenance এর কি বোঝেন? কিচ্ছু না। ইংরিজিতে লেখা একটা চিঠি পড়ে ভালো করে বুঝতে পারেন কি না সন্দেহ। তাহলে? ববি হাকিমের কাজ হল সময়ে সময়ে ব্রিজ গুলির ইনস্পেকশন রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট চীফ এঞ্জিনিয়াররা রেখেছেন কিনা সে ব্যাপারে খোঁজখবর করা। আর যদি বিধানসভায় কখনও কোনো MLA, যাঁ(দে)র জ্ঞানও হয়ত ওই ববি হাকিমের জ্ঞানেরই তুল্যমূল্য, কোনো প্রশ্ন করেন, তবে তার জবাব দেওয়া। ব্যস্, ববির দায় ওই পর্যন্তই। আপনি হয়ত বলবেন, রেলওয়েজের এঞ্জিনিয়ার তো সময় থাকতে জানিয়েছিলেন যে বিপদ যে কোনো দিন ঘটতে পারে। তাহলে? তা সত্ত্বেও কেন ব্যবস্থা নিলেন না ওঁরা?
উত্তর হল, ওঁরা পাত্তা দেন নি। ব্রিজ যে ভাঙ্গবেই, তার গ্যারান্টি তো রেলওয়েজের এঞ্জিনিয়ার দেন নি। তিনি শুধু সতর্ক করেছেন মাত্র। তাও সতর্ক করেছেন কাকে বা কাদেরকে? KMDA র এঞ্জিনিয়ারদের। KMDA র এঞ্জিনিয়াররা মন্ত্রীদের চাকরবাকর মানুষ। চাকরদের কথা শুনে একগাদা টাকা খরচ করে ব্রিজ সারানোর কোনো মানে হয়? ব্রিজ যে ভাঙ্গবেই, তার কোনো গ্যারান্টি তো কেউ দেয় নি! কোনো ব্যাটা এঞ্জিনিয়ার এমন আছে যে গ্যারান্টি দিয়ে পারসোনাল বণ্ডে সই করে বলে দেবে যে অমুক দিন দিবা অমুক সময় গতে অমুক ব্রিজটি ভেঙ্গে পড়বে? না নেই। থাকলে নয় তার কথা শোনা যেত। তা নাহলে আর শুধু শুধু আগেভাগে টাকা খরচ করে লাভ কি? বরং ভাঙ্গলে পরে দেখা যাবে!
তাহলে? দায় কার? কাদের জানবার কথা? উত্তর হল, যাঁরা ইনস্পেকশন রিপোর্টে all ok দিয়ে সই করে দিচ্ছেন, দায় সেই কর্মচারী এঞ্জিনিয়ারদের।
অর্থাৎ এতক্ষণ ধরে এত ভণিতা করে যে বিষয়টির প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি তা হল এই যে সরকারি কাজের দায় সরকারি কর্মচারীদের উপর। মন্ত্রীদের উপর নয়। কাজের প্রকৃত দায় আমলা, এঞ্জিনিয়ার, কর্মচারী...এঁদের। মন্ত্রী, বিধায়ক, কাউন্সিলর ইত্যাদি জনপ্রতিনিধিদেরকে সময়ে সময়ে feedback নিতে হয় এঁদের কাছ থেকেই। তাঁদের কাজ হল পাবলিক মানির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা মনিটর করা। অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীরা অর্থাৎ আমাদের servant রা তাঁদের দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করছেন কি না, সেটা নজর করা এবং কোথাও কোন খামতি নজরে পড়লে বিষয়টি দপ্তরের কর্মচারীদের দিয়ে সংশোধন করিয়ে নেওয়াই জনপ্রতিনিধির একমাত্র কাজ।
এবার আশা করি বোঝা গেছে যে ব্রিজ ভেঙ্গে পড়া, রাস্তা বসে যাওয়া, এসব কিছুর দায় আসলে পুরসভা ও পূর্ত দপ্তরের কর্মচারী ও এঞ্জিনিয়ারদের? তাঁরা তাঁদের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করছেন না। বোধ হয় কোনোমতে রুটিন পালন করে পুরোনো রিপোর্টের কপিতে নতুন ডেট বসিয়ে আর একটা প্রিন্ট বের করে তাতে সই করে মন্ত্রীকে দিয়ে দিচ্ছেন। আর সব কিছুই যেহেতু হচ্ছে প্রপার চ্যানেলে, ফলে আলাদা করে বিশেষ কোনো কর্মচারী বা এঞ্জিনিয়ার বা অফিসার কাউকে দায়ী করাও সম্ভব হচ্ছে না।
রেলওয়েজের এঞ্জিনিয়ারের সতর্কীকরণের চিঠিও পূর্ত দপ্তরের এঞ্জিনিয়াররা নিশ্চয় কোনো একটি মিটিং এ তুলেছিলেন। সরকারি রেকর্ড চেক করলে রেকর্ডেড মিনিটস্ অব দ্য মিটিং এ তার উল্লেখও নিশ্চয় পাওয়া যাবে। অর্থাৎ পূর্ত দপ্তরের কোনো এঞ্জিনিয়ারকে অফিসিয়ালি শো'কজ করাও বোধ হয় যাবে না। কারণ অফিসিয়ালি তাঁরা হয়ত তাঁদের কাজটা করেছেন এবং কাজ ফুরিয়েও রেখে দিয়েছেন। কিন্তু সে হল কেবল কাজ ফুরোনোর কাজ করা। আসল দায়িত্ব তাঁরা নিচ্ছেন না।
এবার প্রশ্ন হল, তাহলে উপায়? পাবলিক সারভেন্ট, পাবলিকের কাজের দায়িত্ব নেবে না মানে? আমাদের করের টাকায় তাদের মাইনে হয়, সংসার চলে আর আমাদেরই জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করার জন্য তারা কাজে দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে শুধু নাম ফুরিয়ে রেখে দেয়? সত্যি তো, এঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত সমস্যা এঞ্জিনিয়াররা ববিকে বুঝিয়ে না বললে ববি বুঝবেন কেমন করে? ববির তো বোঝার কথা নয়!
এবার এসে পৌঁছনো গিয়েছে আসল পয়েন্টে। এবার বলুন তো, এঞ্জিনিয়াররা তাঁদের রুটিনের বাইরে বেরিয়ে সত্যিকারের ভালো কাজ করবেন কেন? কেন সত্যিকারের দায়িত্ব নেবেন? গত সাত বছর যাবৎ তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য মাইনে পর্যন্ত পাচ্ছেন না। সরকারি এঞ্জিনিয়ারদের সমপর্যায়ভুক্ত যে সব এঞ্জিনিয়ার বেসরকারি ক্ষেত্রে বা ব্যবসায় ঢেলে রোজগার করছেন, সেখানে সরকারী কর্মচারী এঞ্জিনিয়ারদের মাইনে দিনে দিনে কমে গিয়েছে। তবে? কেন করবেন ওঁরা ওঁদের প্রয়োজনীয় কাজটি? মোটিভেশন পাবেন কোত্থেকে? তাঁরা মানুষ নন? এঞ্জিনিয়ারদের তো ডাক্তারদের মত নন-প্র্যাকটিসিং অ্যালাওয়েন্স forego করে আলাদাভাবে consultancy করার উপায় নেই। আইন তাঁদের সেই সুযোগ দেয় নি। তাহলে? তাঁরা তাঁদের উপার্জন বাড়াবেন কিভাবে? তাঁরা যদি অসৎ হন, তাহলে ব্রিজ ভাঙ্গল কি থাকল তাতে তাঁদের কিচ্ছু যায় আসে না, আর যদি তাঁরা সৎ হন, তাহলেও কেবলমাত্র হতাশায় ডুবে থাকা ছাড়া এই সরকারি এঞ্জিনিয়াররা আর কি-ই বা করতে পারবেন? তাঁদের কাজ বিষয়টি দেখে সময় মত রিপোর্ট দেওয়া। সেই রিপোর্টকে কার্যে পরিণত করার সিদ্ধান্ত তো নেবে মমতা বা ববির মত লোকেরা! তবে?
অথচ এই সরকারি এঞ্জিনিয়ারদের অনেকের ক্লাসমেটরাই হয়ত আজ বেসরকারি সেক্টরে বা নিজস্ব ব্যবসায় দেদার রোজগার করছেন। তাঁদের অনেকের চাইতে সরকারি এঞ্জিনিয়ারদের অনেকে হয়ত ছাত্র হিসেবে যোগ্যতর ছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা পাশ করে সরকারি চাকরিতে আসার ফলে তাঁদের জীবনে এখন শুধুই হতাশা। ন্যায্য মাইনেটাও আটকে আছে মমতার মত মানুষের মর্জির উপর।
মেধা ও যোগ্যতাকে অগ্রাহ্য করাই যেখানে সিস্টেম, সেখানে তার দায় তো সাধারণ মানুষকে জীবন দিয়েই চোকাতে হবে।
আজ কোথায় অশিক্ষার পরাকাষ্ঠা সেই ব্যক্তি যিনি মনে করেন সরকারী কর্মচারীদের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই? যিনি সাত বছর ধরে তাঁদের মাইনের টাকা বাকি রেখে ইমাম-মোয়াজ্জিন পুষছেন আর মোচ্ছব করছেন?
এই কি আমাদের চিরায়ত আদর্শ সেই সমাজ যে সমাজে বিদ্বান ও প্রকৃত দক্ষ ব্যক্তির আলাদা সম্মান থাকার কথা?
এই সরকারের মন্ত্রীরা বেশিরভাগই বিদ্যাবুদ্ধিতে বৃহষ্পতি। ফলে শিক্ষিত, বিদ্বান লোকেদের সঙ্গে ওঁদের ক্ষারাক্ষারির সম্পর্ক। ওঁদের নেত্রী তো বুঝতেই পারেন না, সরকারী চাকরি যাঁরা করেন, তাঁরা না থাকলেই বা ক্ষতি কি?
ওঁর এই মানসিকতার সুযোগ নিয়ে এমনকি ডাক্তারদেরও তাঁদের কর্মক্ষেত্রে মার খেতে হচ্ছে, অপদস্থ হতে হচ্ছে। তার প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় জননেত্রী ডাক্তারদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন ও পুলিশকে দিয়ে প্রতিবাদরত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছেন। এরপর যদি রুগী মরে, তাহলে, ভালো করে ভেবে দেখুন, দোষ কাকে দেবেন, ডাক্তারদেরকে নাকি পুলিশমন্ত্রী জননেত্রীকে? জননেত্রী নিজের ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ঢাকতে সাধারণ মানুষের জীবন বাজি রাখেন।
এমনকি এখনও উনি তঞ্চকতা করে চলেছেন মানুষের সঙ্গে। ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দফতরের গাফিলতিতে, আর উনি দোষারোপ করছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষকে।
অন্য সব মানুষকে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন এবং নিজেকে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভাবলে মানুষের সঙ্গে এমন তঞ্চকতা করা যায়।
https://ebela.in/amp/central-minister-babul-supriyo-arises-new-questions-against-state-government-dgtl-1.859227
অর্থাৎ, এই অনাচারের রাজ্যে ব্রিজ ভাঙ্গবে, রাস্তা ধ্বসবে, মানুষও মরবে। কিন্তু কিচ্ছু করা যাবে না। কারণ মানুষ সচেতন নয়। তাঁদের নেত্রীই পরোক্ষে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন তাঁদের। অথচ তাঁরা বুঝতেও পারেন না।
এবারে মনে করুন, সরকারের জায়গায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থেকে যদি কোনো কর্পোরেট হাউস থাকত, এবং ব্রিজটি যদি কারুর ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হত, তাহলে আজ কিন্তু এই ব্রিজ ভাঙ্গার জন্য সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হত সেই কর্পোরেট হাউসের মালিক। ভাঙ্গা ব্রিজটি নতুন করে তৈরি করার যা খরচ, তা নিঃসন্দেহে আগে থেকে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের খরচের চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাই সেই মালিক নিঃসন্দেহে একান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থেই খেয়াল রাখতেন যাতে সেই রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকভাবে হয়, যাতে a stitch in time can save nine, অর্থাৎ ভাঙ্গা ব্রিজ নতুন করে গড়ার খরচ যাতে তাঁকে কোনোদিনই করতে না হয়।
এখন প্রশ্ন হল, এই রক্ষণাবেক্ষণের খরচের মধ্যে কি কি আছে? না। শুধু রং, তুলি, রূপচর্চার উপকরণ নয়। এই রক্ষণাবেক্ষণের খরচের মধ্যেই পড়ে কর্মী এঞ্জিনিয়ারদের মাইনে, সময়ে সময়ে নতুন প্রযুক্তিবিদ্যায় তাঁদের প্রশিক্ষিত করার খরচ, তাঁরা যাতে তাঁদের কাজের প্রতি সঠিক উৎসাহ বজায় রাখতে পারেন সে ব্যাপারে বিভিন্ন উৎসাহমূলক প্রকল্প ও ভাতার খরচ ইত্যাদিও। যে কোনো কর্পোরেট হাউস তার কর্মচারীদের পিছনে যে খরচ করে তা কখনোই বিনা স্বার্থে করে না। তারা জানে যে কর্মচারীদের পিছনে করা খরচ তাদেরকে আরও বড় খরচ বাঁচাতে সাহায্য করবে।
কিন্তু সরকারি ক্ষেত্রে কি হয়? সরকারি ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত মালিক যেহেতু জনগণ এবং সরকারি কর্মচারীরাও সেই জনগণেরই একটি অংশ, তাই এক্ষেত্রে 'মালিক জনগণ' প্রতি মুহূর্তে 'কর্মচারী জনগণের' সম্বন্ধে সম্ভবতঃ এক প্রচ্ছন্ন ঈর্ষায় ভুগতে থাকেন। কোনো কোম্পানীর মালিক যদি নিজেই তাঁর কর্মচারীদের ঈর্ষা করেন এবং কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনাগণ্ডাকে অন্যায্য সুবিধাভোগ বলে মনে করতে থাকেন, তবে সেই কোম্পানীর সার্বিক ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী।
সরকারি ক্ষেত্রের দশা এরকম। সাধারণ মানুষ ও তাদের প্রতিনিধিরা বিশ্বাসই করেন না যে সরকারি কর্মচারীদের কিছু করণীয় আছে। তাঁদের কাছে সরকারি কর্মচারীরা আসলে ফালতু, বাড়তি। ফলে দিনে দিনে কর্মচারীদের নিজেদের মনেও এই ধারণাটি বদ্ধমূল হয়ে গেছে। দিনের পর দিন নিজেদের একান্ত ন্যায্য প্রাপ্য আদায়েও লড়াই করতে করতে তাঁদের আত্মবিশ্বাসও আজ তলানিতে। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা আজ আর বুঝতে পারেন না। তাই সত্যিকারের ভালো কিছু করার বদলে কোনোমতে কাজ ফুরিয়ে রাখার দিনগত পাপক্ষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে তাঁদের কর্মদক্ষতা ও ছাত্রাবস্থায় অর্জিত জ্ঞান। নিতান্ত হতাশার থেকে বাঁচার উপায় হিসেবেই reflex action এ তাঁরা তাঁদের অতীতের সমস্ত জ্ঞান ও যোগ্যতাকে ভুলে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
ব্রিজ তাই একজন সরকারি এঞ্জিনিয়ারের কাছে যতটা না একটি প্রযুক্তিগত কাঠামো, তার চেয়ে অনেক বেশি একটি নীরস ফাইল যার সঙ্গে তাঁদের এঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার কোনো সম্পর্ক তাঁরা আজ আর খুঁজে পান না।
ববি হাকিমের মত মন্ত্রীদের কাছে ব্রিজ ভাঙ্গার ঘটনা হয়ত শুধুই একটি ক্ষতিপূরণের অঙ্ক, সরকারি এঞ্জিনিয়ারদের কাছেও তা শুধুই একটি ফাইল যাতে প্রযুক্তির থেকে অর্থ বরাদ্দের অঙ্ক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্ঘটনা, ট্র্যাজেডি সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করে কিন্তু তার আড়ালে থাকা সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বছরের পর বছরের উদাসীন তাচ্ছিল্য সম্বন্ধে তাদের মাথাব্যথা নেই। যতদিন আমরা সাধারণ মানুষরা বিশ্বাস করব যে সরকারি কর্মচারীরা শুধু আসেন, যান, মাইনে পান, যতদিন না আমরা সরকারের প্রকৃত মালিকেরা কর্মচারীদের কাজের মূল্যকে যথাযোগ্য সম্মানের সাথে স্বীকৃতি দেব, ততদিন সরকারি কর্মচারীরা নিজেরাও নিজেদের কাজকে সম্মান করতে পারবেন না। এবং এইরকম দুর্ঘটনা ঘটেই চলবে এবং তাতে প্রাণও হারাতে হবে আমাদের মত সাধারণ মানুষকেই। আজ ভেঙ্গেছে মাঝেরহাট ব্রিজ, কাল হয়ত ঢাকুরিয়া ব্রিজের পালা। আজ মারা গিয়েছেন শীলপাড়ার সৌমেন বাগ, ঢাকুরিয়া ব্রিজে হয়ত আমার বা আপনার টার্ণ! বহুদিন আগেই সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে যে ইঁদুরেরা ঢাকুরিয়া ব্রিজের তলার ভিত দুর্বল করে দিয়েছে। অথচ তার কোনো প্রযুক্তিগত সমাধানের পথ খোঁজা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
সেনাবাহিনীতে কর্মরত জওয়ানেরা তাদের নিজেদের কাজকে সম্মান করেন। কারণ সাধারণ মানুষ তাঁদের সেই সম্মান অনুভব করান। তবেই সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে। তেমনি যেদিন সাধারণ মানুষ ও তাঁদের জনপ্রতিনিধিরা সরকারি কর্মচারীদের কাজকে মুক্তকন্ঠে সম্মান ও স্বীকৃতি জানাতে পারবেন, সেদিনই সরকারি কর্মচারীরাও অনুভব করবেন যে বিনিময়ে উন্নততম পরিষেবা দেওয়ার দায়ও তাঁদের। সেদিনই আমরা এই ধরণের দুর্ঘটনার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারব।
তার আগে পর্যন্ত আপনার আমার জীবন এই ভাবেই সুতোর উপর ঝুলবে এবং কিছু মনুষ্যত্ববিহীন, অজ্ঞান, অসংবেদনশীল লোক আমাদেরই টাকা দিয়ে কখনও হাজারে কখনও লাখে আমাদেরই জীবনের দাম হাঁকবে।
বেহালা আমার শ্বশুরবাড়ি। বিয়ে হওয়া ইস্তক বর্ধমান রোড থেকে বেরিয়ে মাঝেরহাট ব্রিজে ওঠার ব্যাপারটা এমনকি sleep-walking এর মধ্যেও আমার সড়গড়।
মাঝেরহাট ব্রিজের এই ভেঙ্গে পড়া একটি প্রতীকের মত। কলকাতার এতদিনের একটি অস্তিত্বচিহ্ন যেন মুছে গেল। মানুষকে গোড়া থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে এই মাঝেরহাট ব্রিজের ভেঙ্গে পড়া।
যাই হোক্, প্রথমেই বলি, এখানে যা বলব, তা অনেকেরই পছন্দ হবে না হয়ত। কিন্তু তাতে কি? Truth is often far from being comfortable.
ইণ্ডিয়া টুডে চ্যানেলের খবরে প্রকাশিত হয়েছে যে রেলওয়েজের এঞ্জিনিয়ার KMDA কে আগেই একাধিকবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছিলেন যে ব্রিজটির অবস্থা বিপদসীমা স্পর্শ করেছে, এবং মেরামতি ও maintenance প্রয়োজন। কিন্তু KMDA তাতে কর্ণপাত করেনি।
https://www.indiatoday.in/india/story/majerhat-bridge-collapse-railways-had-warned-about-weak-beams-exposed-reinforcements-cracks-on-pier-1333034-2018-09-05
এখন যখন ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে, তখন সবাই দোষারোপ করছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরকে, মুখ্যমন্ত্রীকে, কলকাতা পুরসভাকে এমনকি চেতলার ববি হাকিমকেও। ববি যদিও বলেছেন কোনো বড় ক্ষয়ক্ষতি হয় নি, 'সামান্য ঘটনা'! অর্থাৎ উনি যা উহ্য রেখেছেন তা হল, অজস্র মানুষ মরে নি। অনেক টাকা ক্ষতিপূরণে বেরোবে না। ওঁরা তো আবার ঘটনার ছোট বড় নির্ধারণ করেন ক্ষতিপূরণের তাপ্পি দিতে কত টাকা যাবে, সেই হিসাব করে। ব্রিজ ভাঙ্গল, তাতে কি? আবার সিণ্ডিকেটের ভেজাল সিমেন্ট দিয়ে, বাজে কোয়ালিটির গার্ডার দিয়ে ব্রিজ উঠে যাবে। বরং ভালোই হল, আরও কিছু মাল ঝাঁপার সুযোগ এসে গেল। বিল হবে একরকম কোয়ালিটির মালের, সাপ্লাই হবে অন্য কোয়ালিটি। মজুর চাপা পড়ল, মানুষ আহত হল, মরল, তারপর দীর্ঘকাল যাবৎ নিত্যযাত্রীরা নাকানি চোবানি খাবে খাক। ওঁদের তো পৌষমাস এসে গেল। অপ্রত্যাশিত, হিসাব-বহির্ভূত পৌষমাস! মাল ঝাঁপার এই সুযোগটা হিসেবের মধ্যে ধরা ছিল না। ওঁদের মনে তো লাড্ডু ফুটছে।
না। এসব বলার জন্য লিখতে বসি নি। আমার কথা অন্য।
এই যে আমরা KMDA কে দায়ী করছি, এর মাধ্যমে আসলে দায়ী করছি কাকে? বা কাদেরকে? ব্রিজ যে ভাঙ্গল, তার দায় কার? অনেকেই হয়ত বলবেন মন্ত্রীদের। কিন্তু তাই কি? ব্রিজের হাল হকীকৎ কেমন, তার কোথায় কোন্ maintenance এর প্রয়োজন, ববি হাকিম তা জানবেন কেমন করে? ববি হাকিমের এসব বোঝার ক্ষমতাই বা কি? উনি ব্রিজের maintenance এর কি বোঝেন? কিচ্ছু না। ইংরিজিতে লেখা একটা চিঠি পড়ে ভালো করে বুঝতে পারেন কি না সন্দেহ। তাহলে? ববি হাকিমের কাজ হল সময়ে সময়ে ব্রিজ গুলির ইনস্পেকশন রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট চীফ এঞ্জিনিয়াররা রেখেছেন কিনা সে ব্যাপারে খোঁজখবর করা। আর যদি বিধানসভায় কখনও কোনো MLA, যাঁ(দে)র জ্ঞানও হয়ত ওই ববি হাকিমের জ্ঞানেরই তুল্যমূল্য, কোনো প্রশ্ন করেন, তবে তার জবাব দেওয়া। ব্যস্, ববির দায় ওই পর্যন্তই। আপনি হয়ত বলবেন, রেলওয়েজের এঞ্জিনিয়ার তো সময় থাকতে জানিয়েছিলেন যে বিপদ যে কোনো দিন ঘটতে পারে। তাহলে? তা সত্ত্বেও কেন ব্যবস্থা নিলেন না ওঁরা?
উত্তর হল, ওঁরা পাত্তা দেন নি। ব্রিজ যে ভাঙ্গবেই, তার গ্যারান্টি তো রেলওয়েজের এঞ্জিনিয়ার দেন নি। তিনি শুধু সতর্ক করেছেন মাত্র। তাও সতর্ক করেছেন কাকে বা কাদেরকে? KMDA র এঞ্জিনিয়ারদের। KMDA র এঞ্জিনিয়াররা মন্ত্রীদের চাকরবাকর মানুষ। চাকরদের কথা শুনে একগাদা টাকা খরচ করে ব্রিজ সারানোর কোনো মানে হয়? ব্রিজ যে ভাঙ্গবেই, তার কোনো গ্যারান্টি তো কেউ দেয় নি! কোনো ব্যাটা এঞ্জিনিয়ার এমন আছে যে গ্যারান্টি দিয়ে পারসোনাল বণ্ডে সই করে বলে দেবে যে অমুক দিন দিবা অমুক সময় গতে অমুক ব্রিজটি ভেঙ্গে পড়বে? না নেই। থাকলে নয় তার কথা শোনা যেত। তা নাহলে আর শুধু শুধু আগেভাগে টাকা খরচ করে লাভ কি? বরং ভাঙ্গলে পরে দেখা যাবে!
তাহলে? দায় কার? কাদের জানবার কথা? উত্তর হল, যাঁরা ইনস্পেকশন রিপোর্টে all ok দিয়ে সই করে দিচ্ছেন, দায় সেই কর্মচারী এঞ্জিনিয়ারদের।
অর্থাৎ এতক্ষণ ধরে এত ভণিতা করে যে বিষয়টির প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি তা হল এই যে সরকারি কাজের দায় সরকারি কর্মচারীদের উপর। মন্ত্রীদের উপর নয়। কাজের প্রকৃত দায় আমলা, এঞ্জিনিয়ার, কর্মচারী...এঁদের। মন্ত্রী, বিধায়ক, কাউন্সিলর ইত্যাদি জনপ্রতিনিধিদেরকে সময়ে সময়ে feedback নিতে হয় এঁদের কাছ থেকেই। তাঁদের কাজ হল পাবলিক মানির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা মনিটর করা। অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীরা অর্থাৎ আমাদের servant রা তাঁদের দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করছেন কি না, সেটা নজর করা এবং কোথাও কোন খামতি নজরে পড়লে বিষয়টি দপ্তরের কর্মচারীদের দিয়ে সংশোধন করিয়ে নেওয়াই জনপ্রতিনিধির একমাত্র কাজ।
এবার আশা করি বোঝা গেছে যে ব্রিজ ভেঙ্গে পড়া, রাস্তা বসে যাওয়া, এসব কিছুর দায় আসলে পুরসভা ও পূর্ত দপ্তরের কর্মচারী ও এঞ্জিনিয়ারদের? তাঁরা তাঁদের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করছেন না। বোধ হয় কোনোমতে রুটিন পালন করে পুরোনো রিপোর্টের কপিতে নতুন ডেট বসিয়ে আর একটা প্রিন্ট বের করে তাতে সই করে মন্ত্রীকে দিয়ে দিচ্ছেন। আর সব কিছুই যেহেতু হচ্ছে প্রপার চ্যানেলে, ফলে আলাদা করে বিশেষ কোনো কর্মচারী বা এঞ্জিনিয়ার বা অফিসার কাউকে দায়ী করাও সম্ভব হচ্ছে না।
রেলওয়েজের এঞ্জিনিয়ারের সতর্কীকরণের চিঠিও পূর্ত দপ্তরের এঞ্জিনিয়াররা নিশ্চয় কোনো একটি মিটিং এ তুলেছিলেন। সরকারি রেকর্ড চেক করলে রেকর্ডেড মিনিটস্ অব দ্য মিটিং এ তার উল্লেখও নিশ্চয় পাওয়া যাবে। অর্থাৎ পূর্ত দপ্তরের কোনো এঞ্জিনিয়ারকে অফিসিয়ালি শো'কজ করাও বোধ হয় যাবে না। কারণ অফিসিয়ালি তাঁরা হয়ত তাঁদের কাজটা করেছেন এবং কাজ ফুরিয়েও রেখে দিয়েছেন। কিন্তু সে হল কেবল কাজ ফুরোনোর কাজ করা। আসল দায়িত্ব তাঁরা নিচ্ছেন না।
এবার প্রশ্ন হল, তাহলে উপায়? পাবলিক সারভেন্ট, পাবলিকের কাজের দায়িত্ব নেবে না মানে? আমাদের করের টাকায় তাদের মাইনে হয়, সংসার চলে আর আমাদেরই জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করার জন্য তারা কাজে দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে শুধু নাম ফুরিয়ে রেখে দেয়? সত্যি তো, এঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত সমস্যা এঞ্জিনিয়াররা ববিকে বুঝিয়ে না বললে ববি বুঝবেন কেমন করে? ববির তো বোঝার কথা নয়!
এবার এসে পৌঁছনো গিয়েছে আসল পয়েন্টে। এবার বলুন তো, এঞ্জিনিয়াররা তাঁদের রুটিনের বাইরে বেরিয়ে সত্যিকারের ভালো কাজ করবেন কেন? কেন সত্যিকারের দায়িত্ব নেবেন? গত সাত বছর যাবৎ তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য মাইনে পর্যন্ত পাচ্ছেন না। সরকারি এঞ্জিনিয়ারদের সমপর্যায়ভুক্ত যে সব এঞ্জিনিয়ার বেসরকারি ক্ষেত্রে বা ব্যবসায় ঢেলে রোজগার করছেন, সেখানে সরকারী কর্মচারী এঞ্জিনিয়ারদের মাইনে দিনে দিনে কমে গিয়েছে। তবে? কেন করবেন ওঁরা ওঁদের প্রয়োজনীয় কাজটি? মোটিভেশন পাবেন কোত্থেকে? তাঁরা মানুষ নন? এঞ্জিনিয়ারদের তো ডাক্তারদের মত নন-প্র্যাকটিসিং অ্যালাওয়েন্স forego করে আলাদাভাবে consultancy করার উপায় নেই। আইন তাঁদের সেই সুযোগ দেয় নি। তাহলে? তাঁরা তাঁদের উপার্জন বাড়াবেন কিভাবে? তাঁরা যদি অসৎ হন, তাহলে ব্রিজ ভাঙ্গল কি থাকল তাতে তাঁদের কিচ্ছু যায় আসে না, আর যদি তাঁরা সৎ হন, তাহলেও কেবলমাত্র হতাশায় ডুবে থাকা ছাড়া এই সরকারি এঞ্জিনিয়াররা আর কি-ই বা করতে পারবেন? তাঁদের কাজ বিষয়টি দেখে সময় মত রিপোর্ট দেওয়া। সেই রিপোর্টকে কার্যে পরিণত করার সিদ্ধান্ত তো নেবে মমতা বা ববির মত লোকেরা! তবে?
অথচ এই সরকারি এঞ্জিনিয়ারদের অনেকের ক্লাসমেটরাই হয়ত আজ বেসরকারি সেক্টরে বা নিজস্ব ব্যবসায় দেদার রোজগার করছেন। তাঁদের অনেকের চাইতে সরকারি এঞ্জিনিয়ারদের অনেকে হয়ত ছাত্র হিসেবে যোগ্যতর ছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা পাশ করে সরকারি চাকরিতে আসার ফলে তাঁদের জীবনে এখন শুধুই হতাশা। ন্যায্য মাইনেটাও আটকে আছে মমতার মত মানুষের মর্জির উপর।
মেধা ও যোগ্যতাকে অগ্রাহ্য করাই যেখানে সিস্টেম, সেখানে তার দায় তো সাধারণ মানুষকে জীবন দিয়েই চোকাতে হবে।
আজ কোথায় অশিক্ষার পরাকাষ্ঠা সেই ব্যক্তি যিনি মনে করেন সরকারী কর্মচারীদের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই? যিনি সাত বছর ধরে তাঁদের মাইনের টাকা বাকি রেখে ইমাম-মোয়াজ্জিন পুষছেন আর মোচ্ছব করছেন?
এই কি আমাদের চিরায়ত আদর্শ সেই সমাজ যে সমাজে বিদ্বান ও প্রকৃত দক্ষ ব্যক্তির আলাদা সম্মান থাকার কথা?
এই সরকারের মন্ত্রীরা বেশিরভাগই বিদ্যাবুদ্ধিতে বৃহষ্পতি। ফলে শিক্ষিত, বিদ্বান লোকেদের সঙ্গে ওঁদের ক্ষারাক্ষারির সম্পর্ক। ওঁদের নেত্রী তো বুঝতেই পারেন না, সরকারী চাকরি যাঁরা করেন, তাঁরা না থাকলেই বা ক্ষতি কি?
ওঁর এই মানসিকতার সুযোগ নিয়ে এমনকি ডাক্তারদেরও তাঁদের কর্মক্ষেত্রে মার খেতে হচ্ছে, অপদস্থ হতে হচ্ছে। তার প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় জননেত্রী ডাক্তারদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন ও পুলিশকে দিয়ে প্রতিবাদরত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছেন। এরপর যদি রুগী মরে, তাহলে, ভালো করে ভেবে দেখুন, দোষ কাকে দেবেন, ডাক্তারদেরকে নাকি পুলিশমন্ত্রী জননেত্রীকে? জননেত্রী নিজের ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ঢাকতে সাধারণ মানুষের জীবন বাজি রাখেন।
এমনকি এখনও উনি তঞ্চকতা করে চলেছেন মানুষের সঙ্গে। ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দফতরের গাফিলতিতে, আর উনি দোষারোপ করছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষকে।
অন্য সব মানুষকে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন এবং নিজেকে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভাবলে মানুষের সঙ্গে এমন তঞ্চকতা করা যায়।
https://ebela.in/amp/central-minister-babul-supriyo-arises-new-questions-against-state-government-dgtl-1.859227
অর্থাৎ, এই অনাচারের রাজ্যে ব্রিজ ভাঙ্গবে, রাস্তা ধ্বসবে, মানুষও মরবে। কিন্তু কিচ্ছু করা যাবে না। কারণ মানুষ সচেতন নয়। তাঁদের নেত্রীই পরোক্ষে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন তাঁদের। অথচ তাঁরা বুঝতেও পারেন না।
এবারে মনে করুন, সরকারের জায়গায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থেকে যদি কোনো কর্পোরেট হাউস থাকত, এবং ব্রিজটি যদি কারুর ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হত, তাহলে আজ কিন্তু এই ব্রিজ ভাঙ্গার জন্য সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হত সেই কর্পোরেট হাউসের মালিক। ভাঙ্গা ব্রিজটি নতুন করে তৈরি করার যা খরচ, তা নিঃসন্দেহে আগে থেকে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের খরচের চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাই সেই মালিক নিঃসন্দেহে একান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থেই খেয়াল রাখতেন যাতে সেই রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকভাবে হয়, যাতে a stitch in time can save nine, অর্থাৎ ভাঙ্গা ব্রিজ নতুন করে গড়ার খরচ যাতে তাঁকে কোনোদিনই করতে না হয়।
এখন প্রশ্ন হল, এই রক্ষণাবেক্ষণের খরচের মধ্যে কি কি আছে? না। শুধু রং, তুলি, রূপচর্চার উপকরণ নয়। এই রক্ষণাবেক্ষণের খরচের মধ্যেই পড়ে কর্মী এঞ্জিনিয়ারদের মাইনে, সময়ে সময়ে নতুন প্রযুক্তিবিদ্যায় তাঁদের প্রশিক্ষিত করার খরচ, তাঁরা যাতে তাঁদের কাজের প্রতি সঠিক উৎসাহ বজায় রাখতে পারেন সে ব্যাপারে বিভিন্ন উৎসাহমূলক প্রকল্প ও ভাতার খরচ ইত্যাদিও। যে কোনো কর্পোরেট হাউস তার কর্মচারীদের পিছনে যে খরচ করে তা কখনোই বিনা স্বার্থে করে না। তারা জানে যে কর্মচারীদের পিছনে করা খরচ তাদেরকে আরও বড় খরচ বাঁচাতে সাহায্য করবে।
কিন্তু সরকারি ক্ষেত্রে কি হয়? সরকারি ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত মালিক যেহেতু জনগণ এবং সরকারি কর্মচারীরাও সেই জনগণেরই একটি অংশ, তাই এক্ষেত্রে 'মালিক জনগণ' প্রতি মুহূর্তে 'কর্মচারী জনগণের' সম্বন্ধে সম্ভবতঃ এক প্রচ্ছন্ন ঈর্ষায় ভুগতে থাকেন। কোনো কোম্পানীর মালিক যদি নিজেই তাঁর কর্মচারীদের ঈর্ষা করেন এবং কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনাগণ্ডাকে অন্যায্য সুবিধাভোগ বলে মনে করতে থাকেন, তবে সেই কোম্পানীর সার্বিক ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী।
সরকারি ক্ষেত্রের দশা এরকম। সাধারণ মানুষ ও তাদের প্রতিনিধিরা বিশ্বাসই করেন না যে সরকারি কর্মচারীদের কিছু করণীয় আছে। তাঁদের কাছে সরকারি কর্মচারীরা আসলে ফালতু, বাড়তি। ফলে দিনে দিনে কর্মচারীদের নিজেদের মনেও এই ধারণাটি বদ্ধমূল হয়ে গেছে। দিনের পর দিন নিজেদের একান্ত ন্যায্য প্রাপ্য আদায়েও লড়াই করতে করতে তাঁদের আত্মবিশ্বাসও আজ তলানিতে। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা আজ আর বুঝতে পারেন না। তাই সত্যিকারের ভালো কিছু করার বদলে কোনোমতে কাজ ফুরিয়ে রাখার দিনগত পাপক্ষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে তাঁদের কর্মদক্ষতা ও ছাত্রাবস্থায় অর্জিত জ্ঞান। নিতান্ত হতাশার থেকে বাঁচার উপায় হিসেবেই reflex action এ তাঁরা তাঁদের অতীতের সমস্ত জ্ঞান ও যোগ্যতাকে ভুলে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
ব্রিজ তাই একজন সরকারি এঞ্জিনিয়ারের কাছে যতটা না একটি প্রযুক্তিগত কাঠামো, তার চেয়ে অনেক বেশি একটি নীরস ফাইল যার সঙ্গে তাঁদের এঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার কোনো সম্পর্ক তাঁরা আজ আর খুঁজে পান না।
ববি হাকিমের মত মন্ত্রীদের কাছে ব্রিজ ভাঙ্গার ঘটনা হয়ত শুধুই একটি ক্ষতিপূরণের অঙ্ক, সরকারি এঞ্জিনিয়ারদের কাছেও তা শুধুই একটি ফাইল যাতে প্রযুক্তির থেকে অর্থ বরাদ্দের অঙ্ক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্ঘটনা, ট্র্যাজেডি সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করে কিন্তু তার আড়ালে থাকা সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বছরের পর বছরের উদাসীন তাচ্ছিল্য সম্বন্ধে তাদের মাথাব্যথা নেই। যতদিন আমরা সাধারণ মানুষরা বিশ্বাস করব যে সরকারি কর্মচারীরা শুধু আসেন, যান, মাইনে পান, যতদিন না আমরা সরকারের প্রকৃত মালিকেরা কর্মচারীদের কাজের মূল্যকে যথাযোগ্য সম্মানের সাথে স্বীকৃতি দেব, ততদিন সরকারি কর্মচারীরা নিজেরাও নিজেদের কাজকে সম্মান করতে পারবেন না। এবং এইরকম দুর্ঘটনা ঘটেই চলবে এবং তাতে প্রাণও হারাতে হবে আমাদের মত সাধারণ মানুষকেই। আজ ভেঙ্গেছে মাঝেরহাট ব্রিজ, কাল হয়ত ঢাকুরিয়া ব্রিজের পালা। আজ মারা গিয়েছেন শীলপাড়ার সৌমেন বাগ, ঢাকুরিয়া ব্রিজে হয়ত আমার বা আপনার টার্ণ! বহুদিন আগেই সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে যে ইঁদুরেরা ঢাকুরিয়া ব্রিজের তলার ভিত দুর্বল করে দিয়েছে। অথচ তার কোনো প্রযুক্তিগত সমাধানের পথ খোঁজা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
সেনাবাহিনীতে কর্মরত জওয়ানেরা তাদের নিজেদের কাজকে সম্মান করেন। কারণ সাধারণ মানুষ তাঁদের সেই সম্মান অনুভব করান। তবেই সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে। তেমনি যেদিন সাধারণ মানুষ ও তাঁদের জনপ্রতিনিধিরা সরকারি কর্মচারীদের কাজকে মুক্তকন্ঠে সম্মান ও স্বীকৃতি জানাতে পারবেন, সেদিনই সরকারি কর্মচারীরাও অনুভব করবেন যে বিনিময়ে উন্নততম পরিষেবা দেওয়ার দায়ও তাঁদের। সেদিনই আমরা এই ধরণের দুর্ঘটনার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারব।
তার আগে পর্যন্ত আপনার আমার জীবন এই ভাবেই সুতোর উপর ঝুলবে এবং কিছু মনুষ্যত্ববিহীন, অজ্ঞান, অসংবেদনশীল লোক আমাদেরই টাকা দিয়ে কখনও হাজারে কখনও লাখে আমাদেরই জীবনের দাম হাঁকবে।
Comments
Post a Comment