রাজ্যে ইসলাম আগ্রাসনে বাংলাপক্ষের ভূমিকা: পর্ব ৪

পশ্চিমবঙ্গের ইসলাম আগ্রাসন বুঝতে গেলে বাংলাপক্ষ নামক অর্গানাইজেশনটির গুরুত্ব বোঝা প্রয়োজন। বিশদে যথাসম্ভব সহজ উপায়ে বলার চেষ্টা করছি। সকলের পড়া উচিত বলে মনে করি।

এটি ৪র্থ পর্ব। ফেসবুকে দিয়েছিলাম 2nd অক্টোবর।

https://www.facebook.com/story.php?story_fbid=339531596613261&id=100016692693608

ইসলাম আগ্রাসন facilitate করার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে শুধু মুসলিম তোষণ করছেন তা নয়, আরও নানাভাবে পশ্চিমবঙ্গের টোট্যাল পপুলেশনকে নিজের দিকে টানবার চেষ্টা করছেন। বাংলাপক্ষ এ বিষয়ে তাঁর অন্যতম উইং কম্যাণ্ডার।

এই সংস্থাটির কথা বার বার আসছে কারণ এই এটি পশ্চিমবঙ্গের ইসলামাইজেশনে instrumental. বাংলা ও বাঙালী সেন্টিমেন্টকে স্টিমুলেট করে একটা বৃহত্তর ভাষা আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে এঁরা আড়াল করছেন বলে সন্দেহ হয়।

এঁরা মুখে বাঙালীত্বের কথা বলেন। আগামী নির্বাচনে হয়ত ভোটেও দাঁড়াবেন, পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষের মন ভোলানোর ও ভোট আদায়ের চেষ্টা করবেন এবং তারপর সময় এলেই হয়ত বলবেন বাঙালী মানেই বাংলাদেশ।

বাংলাপক্ষের কর্ণধার বলেছেন যে "চাইনিজে কথা বলব, কিন্তু হিন্দি বলব না"। এই কথাকে extrapolate করতে হবে। ইনিই যে পরে বলবেন না যে, 'বাঙালী বিরিয়ানী খেতে ভালোবাসে তাই প্রয়োজনে উর্দুতে কথা বলব, গুটখাখোর হিন্দুত্ববাদীদের দাপট মানব না, বাঙালীত্বের জন্য বাঙালীত্বের খাতিরে প্রয়োজনে ইসলাম কবুল করব, কারণ ইসলামই প্রকৃত সাম্যবাদের কথা বলে। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের না, বাংলাদেশেরই হবে'—তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?

সঠিক সময় এলে উপরের কথাগুলি যে এঁরা বলতে পারেন, তা যদি অবিশ্বাস্য মনে হয়, তবে সঙ্গের ছবিগুলো দয়া করে খেয়াল করুন।

১ নম্বর ছবিটি দ্রষ্টব্য। বলা হচ্ছে আত্মপরিচিতি নিধন আসলে খুন। অথচ ২ নং ছবির শেষ লাইনে পশ্চিমবঙ্গে উর্দু আগ্রাসন যে হচ্ছে, তা পরোক্ষে অস্বীকার করা হয়েছে। তাহলে এঁরা কি বলতে চাইছেন যে বাঙালীর আত্মপরিচিতি উর্দুতে?

৩য় ছবিতে দাবী করা হয়েছে গোটা ভারতবর্ষে হিন্দি দিয়ে যা যা কাজ হয়, সেই সেই কাজগুলি বাংলাভাষা দিয়ে হোক্। এমন দাবী যদি সব রাজ্যই তোলে, তখন কি সঙ্গত মনে হবে সেই দাবী? সব রাজ্যই যদি তাদের রাজ্যগত অস্তিত্বকে দেশগত অস্তিত্বের ওপরে স্থান দিতে চায়, তখন তা কি আমাদের সার্বিক অস্তিত্ব ও সুরক্ষার পক্ষে ফেভারেবল? নাকি বাংলাপক্ষের এই দাবীও আদতে "ভারত তেরে টুকড়ে হোঙ্গে" দাবীটিরই একটি ভিন্ন প্রকাশভঙ্গি মাত্র? ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ ছবি থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মানসিকতা বোঝা যাচ্ছে।

কি বলতে চাইছেন এঁরা?

এই সিরিজের ২য় পর্বে লিখেছিলাম (প্রয়োজনে ২য় পর্বটা refer করা যেতে পারে) বাংলাপক্ষের কর্ণধার ভদ্রলোকের প্রতিটি বক্তব্য থেকে মনে হয় যে ভারতবর্ষ যেমন একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র, তেমনি পশ্চিমবঙ্গও যেন আর একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র।

এবার মনে করা যাক্ আসাম NRC র খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তীব্র আপত্তি প্রকাশ করছিলেন, তখন তাঁর অনেকগুলি অভিযোগের মধ্যে একটি ছিল এই যে আসামে যে NRC করা হবে, তা মমতাকে আগে থেকে কেন জানানো হয় নি! প্রথমতঃ আসাম NRC হয়েছে আসাম অ্যাকর্ডের মত একটি চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী সাংবিধানিক প্রভিশনের অধীনে যে প্রভিশনটিকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন রাজীব গান্ধী, ১৯৮৫ সালে। দ্বিতীয়তঃ সেই আসাম অ্যাকর্ড অনুযায়ী আসাম NRC হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে ও তত্ত্বাবধানে। অর্থাৎ যে আসাম NRC সম্বন্ধে আগে থেকে মমতাকে জানানোর কোনো প্রশাসনিক বা আইনগত বা প্রোটোকলগত বা অন্য কোন প্রকার দায় আসাম সরকারের ছিল না, সেটাও ওঁকে আগে থেকে জানিয়ে কেন করা হল না, তাই নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচুর কথা বলেছিলেন।

এই আচরণের থেকেও নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার আবরণ দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা এবং যে গুরুত্ব সাংবিধানিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নেই, সেইরকম একটি অস্বাভাবিক গুরুত্ব assume করার প্রবণতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যেও স্পষ্ট দেখা যায়।

বাংলাপক্ষের ভদ্রলোকের সঙ্গে এ বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিল। উভয়েই পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণতার আবহ প্রত্যাশা করেন এবং সেইমত উপস্থাপনা করতেও চান, যদিও আর্থিক নির্ভরশীলতার দিক থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতসরকারের কাছ থেকে পাইপয়সা বুঝে নিতে চান। দিনের পর দিন ধার দেনায় রাজ্যকে ভারগ্রস্ত করেন নিজের সিদ্ধান্তে, কিন্তু আশা করেন যে ভারতসরকার সেই ঋণ মকুব করে দেবে। গ্রান্ট বা সেন্ট্রাল ফাণ্ড নেওয়ার প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো পশ্চিমবঙ্গকে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে উপস্থাপনা করেন নি।

অথচ রাজ্য সরকারের ওয়েলফেয়ার স্কীমগুলির প্রসেস অডিটের প্রশ্নে CAG'র সাথে অসহযোগিতা করে সেই একই রকম ভারতবিরোধী 'মানি না' attitude প্রদর্শন করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। এই দ্বৈততা অস্বস্তিকর ও অযৌক্তিক।

বাংলাপক্ষের কর্ণধার ও তৃণমূল-সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যেকার এই attitudinal মিল এবং দু'জনের আচরণের মধ্যেই যে প্রবল আত্মকেন্দ্রিকতা, opportunism ও "গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল" ভাব প্রত্যক্ষ করা যায়, তা কি কেবলই একটা কাকতালীয় মিল? নাকি এটি crafted?

আমার ধারণা এটা আদতে একই ব্র্যাণ্ডের "ডিফারেন্ট প্রেজেন্টেশনস্ ইন ডিফারেন্ট টার্গেট সেগমেন্টস্ অফ দ্য কাস্টমারস্" এর কনসেপ্ট।

ধরা যাক্ বিক্রি করতে হবে একটি ছুরি। রাঁধুনির কাছে সে ছুরির যে ব্যবহার ও গুণাগুণ সম্বন্ধে ইনফর্ম করতে হবে বা প্রোমাট করতে হবে, নাপিতের কাছে সেই একই ছুরির আলাদা ইউসেজ ও আলাদা ইউটিলিটিকে হাইলাইট করতে হবে। দুটো আলাদা সেগমেন্ট অফ কাস্টমারের কাছে শুধু ব্র্যাণ্ডের প্রেজেন্টেশন নয়, ব্র্যাণ্ড অ্যামবাসাডরের গেট আপ ও প্রেজেন্টেশনও আলাদা হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আরও একটু বিশদে বলি।

পশ্চিমবঙ্গে এক শ্রেণীর মানুষ এখনও আছেন, যাঁদের মধ্যে বাঙালীত্বের উন্মাদনা আছে। যাঁরা আজও মনে করেন বাঙালীরা ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মানুষের থেকে উন্নততর শ্রেণীর মানুষ। অন্যান্য প্রদেশের মানুষদের তারা হিন্দুস্তানী, খোট্টা, মেড়ো, গুজ্জু এসব বলে ছোটো করে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। সেই শ্রেণীর মানুষের একাংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পছন্দ করলেও মমতাকে সর্বান্তকরণে গ্রহন করতে একটু যেন খুঁতখুঁত করেন। তার অন্যতম কারণ হল মমতার মধ্যে শিক্ষিত সফিস্টিকেশনের অভাব, ভাষার অপরিশীলিত প্রয়োগ এবং অসংস্কৃত আচরণ। মমতা তাঁদের শিক্ষার অহংকারের প্রতি মূর্তিমতী চ্যালেঞ্জ। তাঁদের শিক্ষার অহংকার আছে, আবার অহংকার করার মত শিক্ষাও আছে, বামপন্থীদের প্রতি তাঁদের বিতৃষ্ণাও আছে, আবার মনের গভীরে বামপন্থাও আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যে 'দেখুন, শিক্ষা, বিত্ত, ক্লাস দিয়েই সব কিছু হয় না। কালীঘাট বস্তি থেকেও সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসা যায়।' এই অপমানটা যাঁরা পুরোপুরি হজম করতে পারেন না, অথচ বাঙালী উন্মাদনায় আক্রান্ত, সেই মানুষগুলিরই মনের কথা বলেন বাংলাপক্ষের কর্ণধার। এই টার্গেট অডিয়েন্সকে ইমপ্রেস করার ক্ষমতা একা মমতার নেই। সেখানেই বাংলাপক্ষের প্রাসঙ্গিকতা। 

এই মানুষেরাই বাংলাপক্ষের টার্গেট অডিয়েন্স।

ভদ্রলোক ISI এর মত elite Institution এ পড়ান। অর্থাৎ এঁর প্রথাগত শিক্ষা মমতার মত সন্দেহজনক নয়। ফলে পশ্চিমবঙ্গের যে শ্রেণীর মানুষের কথা উপরে উল্লেখিত হল অর্থাৎ যাঁরা বাঙালীত্ব নিয়ে তথাকথিতভাবে obsessed, তাঁরা এবং যে সব কমিউনিস্টভাবাপন্ন, নাকউঁচু অথচ চিন্তার গভীরতাহীন লোক আজও পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের একত্রিকরণের কথা ভেবে মনে রোমান্টিসাইজ করেন তাঁদের ফেলে আসা দিনগুলির কথা, তাঁদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অল্টারনেটিভ ফেস হল বাংলাপক্ষের কর্ণধার। এই সেগমেন্টের ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসাডর বলা যেতে পারে।

আগামী নির্বাচনে ইনি হয়ত হবেন তৃণমূলের একজন প্রার্থী এবং জ্বালাময়ী তথাকথিত প্রো-বাঙালী বক্তৃতা জায়গায় জায়গায় দেবেন। বিশেষ করে শিক্ষিত বাঙালী অধ্যুষিত শহরাঞ্চলে।

সাধারণ অন্য সব নাগরিকের জন্য ফেস হলেন মমতা নিজে। একই প্রোডাক্ট, আলাদা প্রেজেন্টেশন ইন ডিফারেন্ট টার্গেট সেগমেন্টস্ অফ দ্য কাস্টমারস্। ব্র্যাণ্ড মমতা। একটি সেগমেন্টে তিনি তৃণমূলের মমতা, আর একটি সেগমেন্টে তিনি বাংলাপক্ষ। শুধু প্রেজেন্টেশন ও গেট আপ্ আলাদা। ভুললে চলবে না, পশ্চিমবঙ্গ এমন একটি রাজ্য যেখানে বামপন্থা ঢুকে গিয়েছে সেই ষাটের দশক থেকে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের মেজরিটি মানুষ, by default বামপন্থী। যাঁরা রাজনৈতিক মতাদর্শে বামপন্থী নন, মনের গভীরে, নিজেদের হয়ত অজান্তেই, তাঁদের অনেকেও বামপন্থীই। বিশেষতঃ উচ্চকোটির বাঙালী তো বামপন্থী বটেই। এই উচ্চকোটির বামপন্থীমনোভাবাপন্ন সাধারণ বাঙালী যাঁরা সাধারণভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁদের মধ্যে একটা significant percentage মানুষ পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের মধ্যে আছেন যাঁরা উপরোক্ত ক্যাটিগরির।

এবার হয়ত খানিক স্পষ্ট হল বাংলাপক্ষের গুরুত্ব। একটি বিশেষ segment of WB population is the target audience of this man.

ভুললে চলবে না, ভোটের রাজনীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোঝেন। (ক্রমশঃ)

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?