পশ্চিমবঙ্গের বিক্রয়যোগ্য বামতৃণপন্থী বিদ্বজ্জন

এখানে যা লিখতে চলেছি, তার মধ্যে কেউ রাজনীতি বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য খুঁজবেন না, প্লিজ। এই কথাগুলো অনেকটা প্রলাপের মত, যা মাথা ও মন ছাপিয়ে গলগল করে এমন গতিতে বেরিয়ে আসছে যে সেই প্রলাপের কণ্ঠরোধ করে তার টুঁটি টিপে ধরতে আমি পারছি না।

গত দু'দিনে মৃত্যু হয়েছে পশ্চিমবাংলার সঙ্গীত ও সংস্কৃতি জগতের দুই বিশিষ্ট মানুষের।

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

যে আবেগ উথলে ওঠার কথা ছিল, কই, তেমন তো উঠল না! এমন তো নয় যে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের ভক্ত আমি ছিলাম না! ওঁর ওই ভরাট, দরাজ কণ্ঠের অনায়াস, সুললিত স্বরক্ষেপনে মনের শান্তির গভীরে ডুব দিতে পারি নি, এমন অভাগা তো আমি নই। ওঁর কণ্ঠে "জাগো দুর্গা"র সুর ও বাণীতেই প্রতি বছর জেগে ওঠেন দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা, এ বিশ্বাস আমার এবং আমার মত আরও অসংখ্য মানুষের। অথচ তা সত্ত্বেও ওঁর মৃত্যু সংবাদ মনের মধ্যে আবেগের সেই ঢেউ তুলতে পারল না কেন?

কিংবা নীরেন চক্রবর্তী? কবির সহজ কথার কাব্য মনের মধ্যে তুলির হালকা আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছে অদ্ভুত সব ছবি। সে সব কি ভুলবার! কবিরা তো জীবন্ত মানুষকেও হাজার বার নতুন জীবন দেন। নীরেন চক্রবর্তীর কলমও ছুঁইয়েছে হাজার জীয়নকাঠির ছোঁয়া। কিন্তু কই? মরণের যাত্রাপথে পা বাড়িয়ে সেই কবির আত্মা আমার মনে দোলা দিয়ে বলে তো গেল না যে, যাচ্ছি না কোথাও, দেখা হবে আবার অনন্তের পথে?

কেন এল না আবেগ? মৃত্যুসংবাদ কেন বের করে নিয়ে এল মনের ভিতরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও হতাশা? কবির কবিত্ব বা শিল্পীর  প্রতিভার প্রতি পরম আসক্তি কেন প্রকাশিত হল চরম অবজ্ঞারূপে?

দু'দিন বাদে নিজেই পেয়েছি তার উত্তর।

এই কবি বা এই শিল্পী বার বার উঠেছেন মঞ্চে। তাঁর পাশে। গ্রহন করেছেন তাঁর প্রসাদ, নানা পদ, পুরষ্কারমূল্য ও উপহারস্বরূপ। কবি বা শিল্পী একথা ভাবেনই নি যে, যে মঞ্চে তাঁরা আরোহণ করেছেন, সে মঞ্চ বাঁধা হয়েছে লক্ষ গরীব মানুষের লুণ্ঠিত সম্পদে। ক্ষমতার ধ্বজার বেদী প্রস্তুত হয়েছে গরীব মানুষকে প্রবঞ্চনা করে, আগুনে মেয়ের প্রতি গরীবের সরল বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসাকে বধ করে। মানুষের বাড়িতে বাসন মাজা স্বর্ণ'র বিয়ের জন্য স্বর্ণ'র মায়ের জমানো নব্বই হাজার টাকা গায়েব হওয়ার পর তিনি যখন গায়ে আগুন দিলেন, তখন তাঁর শরীরের সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে মরল অগ্নিকন্যার উপর তাঁর অটুট বিশ্বাসও।

এমন বহু প্রাণ, বহু বিশ্বাস, বহু রক্ত, ঘাম ও সরলতার ধ্বংসস্তূপের ওপর স্থাপিত হয়েছিল সম্রাজ্ঞীর সাম্রাজ্য ও সিংহাসন। গরীব মানুষের রক্ত, ঘাম লেগে থাকা অর্থ স্পর্শ করতে, তাদের বিশ্বাসকে বধ করতে আগুনে-মেয়ে দ্বিধা করে নি কারণ সে হতে চেয়েছিল উচ্চাভিলাষী সম্রাজ্ঞী।

কিন্তু কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সঙ্গীত বিশারদরা? তাঁরা পারলেন কি করে সম্রাজ্ঞীর সেই পাপ-রাজসভার সভাসদ হতে? তাঁদের তো থাকার কথা এক প্রবল সংবেদনশীল মন ও উচ্ছ্বসিত আবেগ! তাঁরা বুঝতে পারলেন না কেন যে, সম্রাজ্ঞীর দেওয়া যে উপহারে তাঁরা লাভ করছেন প্রাচুর্য, সেই উপহারের অর্থ হয়ত বা ছিল কারুর জীবনের শেষ সম্বল; তার গায়ে হয়ত বা লেগে ছিল বহু মানুষের হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস, রক্ত, ঘাম? কেন‌ ভাবলেন না সংবেদনশীল বিদ্বজ্জনেরা এমন করে? নাকি ভাবতে চাইলেন না?

যাঁরা সরকারি পুরষ্কার নিলেন, তাঁরাই বা কেন ভাবলেন না যে যাঁর সিদ্ধান্তে সরকারি পুরষ্কার তাঁরা পাচ্ছেন, তাঁর পুরষ্কার দেওয়ার ক্ষমতা তিনি চুরির ধনে কিনে নিয়েছেন? এমন ক্ষ্যাপা একজন বিদ্বজ্জনও কি থাকতে পারতেন না, যিনি সম্রাজ্ঞীর চৌর্য-সাম্রাজ্যের অন্নজীবী হতে রাজি হতেন না?

কেন পশ্চিমবাংলার সমস্ত তথাকথিত বিদ্বজ্জনকে গরীব মানুষকে লুঠ করা টাকার প্রসাদভোগী হতে হল? কেন একবাক্যে সব তথাকথিত বিদ্বজ্জন ও বুদ্ধিজীবী এমন‌ মঞ্চে একযোগে অবতীর্ণ হলেন যে মঞ্চ অন্যায়, তঞ্চকতা ও প্রবঞ্চনার সারাংশ দিয়ে তৈরি? তা-ও সেই পশ্চিমবঙ্গে যে পশ্চিমবঙ্গের নিরানব্বই শতাংশ লোক নাকি বামপন্থী? তাঁরা নাকি শ্রেণীসংগ্রামের গল্প করেন? সেই সব বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা সত্যিকারের 'have nots' দের ঠকানো পয়সায় নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে লজ্জা পেলেন না? গরীব মানুষকে পণ্য করতে তাঁদের ঘৃণা হল না নিজেদের ওপর? তাঁরা কি আজও আয়নার সামনে দাঁড়ান?

নাকি রবীন্দ্রনাথই ঠিক? "রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি"? কারণ "এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি"?

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বা নীরেন চক্রবর্তী ছিলেন এমনই দুই বিদ্বজ্জন, যাঁরা তাঁদের বিদ্যা বা দক্ষতার চেয়ে টাকাপয়সা ইত্যাদি বস্তুগত ভোগ্যসামগ্রীর লোভের নিরসনের ওপর জোর দিয়েছেন বেশি। এতই বেশি জোর দিয়েছিলেন যে দিনের পর দিন চুরি-ডাকাতি, হুলিগানিজম্ কে মঞ্চে দাঁড়িয়ে পরোক্ষে ক্রমাগত সমর্থন করে যেতে দ্বিধা করেন নি। বিদ্দ্বজ্জন হিসেবে মঞ্চে সম্রাজ্ঞীর পাশে তাঁদের উপস্থিতিই যে তাঁদের সমর্থন বলে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতীয়মান হতে পারে, এটুকু দূরদৃষ্টি ও চিন্তাশক্তি তাঁদের ছিল না বলে বিশ্বাস করতে হবে?

অর্থাৎ এঁরা বিদ্বজ্জন কম, মূল্যবোধ হীন, রাজ-অনুগ্রহপ্রত্যাশী বেশি। এমন মানুষের মৃত্যুতে শোক হতে পারে কিন্তু আবেগ আসতে পারে না। তাই দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মৃত্যুতে মোটের ওপর আমি ভাবলেশহীন।

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

এত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-খরা: কেন?

West Bengal: A Security Threat to India