চেতনাচ্ছন্ন বাঙালী: চিরান্ধকার নাকি পুনর্জাগরণের পথে?

দেখছিলাম অক্ষয়কুমার অভিনীত 'কেশরি' মুভিটি। আগেও একবার দেখেছি যদিও। সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি একটা আগাগোড়া কমার্শিয়াল ফিল্ম। সারাগড়ির দূর্গ রক্ষার্থে ১০,০০০ পাঠানের বিরুদ্ধে ২১ শিখের প্রাণান্তক যুদ্ধ যাতে পাঠানদের মিশনকে ব্যর্থ করেছিল ঐ ২১ জন। ঐতিহাসিক সত্য। যাই হোক্, এই সামান্য মুভিটি থেকে একটা উপলব্ধি হঠাৎই এল যেটা বর্ণনা করতে চাই। সামান্যই সে উপলব্ধি, কিন্তু নিতান্ত অগভীর নয়। সিনেমাটিতে একটি ডায়লগ আছে—'মেরে শর কাট লে, লেকিন পাগ কো হাথ মত লগানা'—নিতান্তই sentiment-filled একটা স্টেটমেন্ট যা দর্শকের আবেগকে স্পর্শ করে যায়। সেই একই আবেগ যা রবীন্দ্রনাথ portray করেছিলেন তাঁর 'প্রার্থনাতীত দান' কবিতায়। বন্দী শিখ তরুসিংকে অপমান করার জন্য নবাব তাকে বলেছিলেন যে তরুসিং যদি তার বেণীটি কেটে দিয়ে যেতে রাজী হয়, তবে নবাব তাকে প্রাণ ভিক্ষা দেবেন। জবাবে—

তরুসিং কহে, "করুণা তোমার
হৃদয়ে রহিল গাঁথা—
যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব,
বেণীর সঙ্গে মাথা।"

অর্থাৎ 'বেণীটি আমার দেব না। প্রাণ দিতে রাজি'। শিখের বেণী বা কেশ, তার পাগড়ি, তার ধর্মের প্রতীক, তার সমষ্টিগত অস্তিত্ব ওর মধ্যে সমাহিত। প্রাণ তার চেয়ে তুচ্ছ একটি বস্তু, তেমন পরিস্থিতিতে পড়লে যা অনায়াসে ত্যাগ করা যায় কিন্তু ধর্ম বা মান ত্যাগ করা যায় না। স্বধর্মে নিধনও শ্রেয়। 'কর্ণকুন্তীসংবাদ' কবিতায়ও রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন মহাকাব্যের উপেক্ষিত নায়ক কর্ণের বাণী, মাতা কুন্তীর উদ্দেশ্যে—

'আপন পৌরুষ ছাড়া, ধর্ম ছাড়া, আর
যাহা আজ্ঞা কর দিব চরণে তোমার।'

আবার এই কবিতারই শেষ পংক্তিতে কর্ণ বলেন—

'শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে,
জয়লোভে যশলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।।'

ঠিক এমনভাবেই প্রতিটি মানুষের, প্রতিটি জাতিরই এমন কিছু থাকা উচিত যা তার মনুষ্যত্ব, পৌরুষ ও ধর্মবোধের প্রতীক, এমন কিছু যার মধ্যে তার আত্মগরিমা, মান, তার সামগ্রিক অস্তিত্ব একাত্মীভূত হয়ে থাকে।

বাঙালীরও ছিল। তার মাতৃসাধনায়। 'মা' শব্দের মূর্চ্ছনায় আচ্ছন্ন বাঙালী ছিল সর্ব অর্থেই Mama's boy. তার ভালোবাসার, তার গর্বের, তার সাধনার, তার বীরত্বের, তার প্রকৃতি বন্দনার, তার জাতীয়তাবোধের আধার ছিল মাতৃবন্দনায়। বাঙালীর মাতৃচেতনাই তার ধর্ম, তার জাতীয়তাবোধের রূপ নিয়ে হয়ে উঠেছিল তার অহংকার, তার মান। একটি শব্দবন্ধের মধ্যে বাঙালীর সেই অগ্নিশীতল অনুভূতিকে ধরেছিলেন বঙ্কিম। 'বন্দেমাতরম'। এই ছিল বাঙালীর সেই সামগ্রিক অস্তিত্বমন্ত্র। এর জন্যই যতীন দাস ৬৩ দিন অনশনের পর প্রাণত্যাগ করতে পেরেছিলেন হাসতে হাসতে। তাঁকে খাওয়ানোর কোনো চেষ্টাই যে কারণে সফল হয় নি, সে ছিল এই 'বন্দেমাতরম' মন্ত্র। এ মন্ত্রের জোরেই অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা মরণকামড় দেওয়ার পর হেলায় করেছিলেন জীবনবলিদান। 'বন্দেমাতরম'—মায়ের বন্দনা করি। আপন প্রাণ তো সে পূজার উপচার বিশেষ। দিতে হবে বৈকি! বঙ্কিমই দেখিয়েছেন, এ ভূমি সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ভূমি। সব ছেড়েও দেশমাতৃকাকে ছাড়া যায় না—সে-ই ধর্ম, সে-ই সামগ্রিক অস্তিত্ব।

কিন্তু দানব যথার্থ নির্ণয় করেছিল বাঙালীর সেই সামগ্রিক অস্তিত্বের জীয়নকাঠিটিকে। নৃশংস দাঙ্গায় সে লাঞ্ছিত, অপমানিত করেছিল বাঙালীর মায়েদেরকে। দেশমাতৃকাকে। পাশাপাশি সে সেলুলার জেলে ভরে দিয়েছিল কম্যুনিজম নামক 'অমাবস্যার অন্ধকারে অনুপস্থিত অসিত অশ্বডিম্ব'টিকে যার 'অনুসন্ধানে' ভিড়িয়ে দেওয়ায় বাঙালী খুইয়ে বসল তার আগ্নেয় সেই জাতীয়তাবাদী মাতৃচেতনা, ভুলল তার অগ্নিশুদ্ধিমন্ত্র—'বন্দেমাতরম'! সাম্যের (নাকি অসাম্যের?) গান গেয়ে তাকে ভুলিয়ে দেওয়া হল মাতৃপূজার মহামন্ত্র। শ্রদ্ধা ও সমর্পণ হারিয়ে তার মধ্যে সুকৌশলে জাগিয়ে তোলা হল দায়িত্বজ্ঞানহীন অধিকারবোধ। নিভিয়ে দেওয়া হল বাঙালীর সামগ্রিক অস্তিত্বচেতনার জাতীয়তাবাদী আগুন।

বাকিটা ইতিহাস। আজকের বাঙালী তার ধর্ম, পৌরুষ, পুরুষকার সব খুইয়ে একটি নপুংসক জাতিতে পরিণত। কম্যুনিজমের টক্সিন সন্ন্যাসী বিদ্রোহের দেশের মানুষকে‌ করে তুলেছে আত্মগরিমাহীন। কমিউনিজমের বিষাক্ত, অনুন্নত ভিনদেশী আদর্শে অনুপ্রাণিত (নাকি মোহাচ্ছন্ন?) হয়ে "ধর্ম"-এর প্রকৃত অর্থ ভুলে গিয়ে, সে এগিয়ে গিয়েছে অধর্মের পথে, "ধর্ম আফিমের নেশা মাত্র", এই কথা বলতে বলতে। "মাতৃনেত্রহীন অন্ধ" সে আজ "এই অজ্ঞাত বিশ্বে"। যুগে যুগে বাংলার "নাট্যমঞ্চে" যে দেশাত্মবোধ "অভিনীত হয়েছে" আজ সেই নাট্যমঞ্চের ওপর নেমে এসেছে "মহাকালের কৃষ্ণযবনিকা"। দশকের পর দশক ধরে এই "রঙ্গমঞ্চকে করে রাখা হয়েছে তিমিরাবৃত"। বাঙালী যেন "অন্ধকারে বেঁচে আছে চামচিকের মত"। বোধহীন, চেতনাহীনভাবে অন্ধকারে এলোমেলো গোঁত্তা খেয়ে বেড়াচ্ছে কেবলই।

আজ এতবছর পর, ২০১৯ শে পৌঁছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলী দেখে মনে হচ্ছে, আবার কি "সেই রঙ্গমঞ্চে একটি একটি করে দীপ জ্বলে উঠছে"? ছদ্ম-কম্যুনিজমের "কৃষ্ণযবনিকা কি সত্যিই সরে যাচ্ছে"? বাঙালী কি আবার নতুন করে মাতৃমন্ত্রপূত দেশাত্মবোধের উষ্ণীষ মাথায় জড়িয়ে, অধর্মের পথ ছেড়ে ধর্মের পথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে? আশা-আশঙ্কার দোলায় দুলছে মন।

Comments

  1. bangali hocche bangali ---- ghoti o bangal ---- kintu manush noi ------ oi bangali ra hocche KA-BA-B bangali ----- kaystho , bamun o boddi -



    ReplyDelete
  2. আপনার সুন্দর প্রতিবেদন খুব রিদয়গ্রহি।
    দারুন বিশ্লেষণ করেছেন।

    তবে বলি, বাংলার ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার। এমনকি বাংলা সংস্কৃতি আজকাল হিন্দি আচ্ছন্ন।
    সামান্য জি বাংলা সা রে গা মা reality show two সবাই হিন্দি গান গাইছে বেশিরভাগ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

Karnataka Election Result 2023: Observations

এত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-খরা: কেন?