কয়েকটি ইঁদুরের গল্প

ইঁদুরদের রাজত্বে একদল বাদামী ইঁদুর একদল ছাইরঙা ইঁদুরকে জাঁতাকলে বন্দী করে রেখেছিল। বহু বছর ধরে ছাইরঙা ইঁদুররা মুক্তির জন্য, জাঁতাকল থেকে বেরোনোর জন্য ছটফট করছিল, কিন্তু পারছিল না। বহু বছরের অক্লান্ত প্রয়াসে একদল প্রাজ্ঞ ছাইরঙা ইঁদুরের সহায়তায় একজন বিশিষ্ট ছাইরঙা ইঁদুরকে নেতা নির্বাচন করে ছাইরঙা ইঁদুররা একদিন জাঁতাকল থেকে বেরোনোর পথ বের করল। নির্বাচিত নেতা ছাইরঙা ইঁদুরদের জাঁতাকল থেকে বের করল ঠিকই, কিন্তু সে এবং প্রাজ্ঞ ছাইরঙা ইঁদুররা জানত যে বাদামী ইঁদুররা ছলে বলে কৌশলে ছাইরঙাদের আবার জাঁতাকলে পুরতে চাইবে। তাই জাঁতাকল থেকে বেরোলেই যে তাদের মুক্তি নিশ্চিত, তা নয়। নিশ্চিত মুক্তির জন্য বাদামী ইঁদুরদের যে পুরোপুরি পরাস্ত করতে হবে, ছাইরঙা প্রাজ্ঞরা তা বুঝত।

জাঁতাকল থেকে বেরোনোর পর ছাইরঙাদের আনন্দ আর ধরে না। এত বছর পর তারা মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। নেতাকে কাঁধে নিয়ে তারা অনেক নাচানাচি করল। জাঁতাকলের বাইরে তারা যেখানে খুশি খোলা ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করতে পারল। বাদামীদের এলাকাতেও এখন তারা বিনা বাধায় বিচরণ করতে পারে, যেখানে ইচ্ছা যেতেও পারে।

ওদিকে বাদামী ইঁদুররা তাকে তাকে রয়েছে কবে, কোন্ দিন, কোন্ ছুতোয় ছাইরঙাদের তারা আবার জাঁতাকলে পুরে ফেলবে! বাদামীরা দিকে দিকে তাদের বন্ধুদের খবর দিল। কালো ইঁদুররা বাদামীদের হাতে হাত মেলালো। সাদা ইঁদুরদের এক বিরাট অংশও ছিল বাদামীদের বন্ধু। তারাও বাদামীদের পাশেই থাকতে চাইল। ছাইরঙারা যেহেতু এতদিন ছিল জাঁতাকলে বন্দী, তাই ইঁদুর সমাজে তাদের পরিচিতি, গুডউইল তেমন নেই। তাদের জনবলও কম, বন্ধুসাহচর্য্যও তেমন নয়। ফলে ছাইরঙাদের নেতা এবং প্রাজ্ঞ ছাইরঙারা বুঝতে পেরেছিল যে বাদামীদের হাত থেকে চিরতরে বাঁচতে চাইলে তাদের হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে। এবং তা অতি সহজে হবে না, কারণ বাদামীদের হারাতে গেলে কালোরা, সাদারা, ফ্যাকাশেরা, পাঁশুটেরা অনেকেই বাদামীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছাইরঙাদের পুনরায় বন্দী করতে চাইবে। কারণ ছাইরঙারা তাদের কাছে অপরিচিত আর বাদামীরা বহুদিনের পরিচিত।

ছাইরঙাদের নেতা ও প্রাজ্ঞরা বুঝল যে এতদিন বন্দী থেকে যে অমূল্য সময় তারা হারিয়েছে, সেই সময়ে বাদামীরা অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। অতএব বাদামীদের পরাস্ত করতে হলে আগে তাদের বাদামীদের সমান জনবল জোগাড় করতে হবে। ছাইরঙাদের নেতা ও প্রাজ্ঞরা তাই একটু একটু করে, ধাপে ধাপে তাদের বন্ধুবৃত্ত তৈরি করতে থাকল। ছাইরঙাদের নেতা দিকে দিকে কালোদের সঙ্গে, সাদাদের সঙ্গে, পাঁশুটেদের সঙ্গে, ফ্যাকাশেদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করার জন্য ঘুরে বেড়াতে লাগল। বাদামীরা ছাইরঙা-নেতার এই ঘুরে বেড়ানোতে প্রবল আপত্তি তুলল। স্বাভাবিক। এতদিন যে ছাইরঙাদের তারা জাঁতাকলে বন্দী রেখেছিল, তাদের নেতা এখন মুক্ত হয়ে গোটা ইঁদুর সমাজে সখ্যপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, এ জিনিস বাদামীদের পছন্দ হল না। ওদিকে অন্য ইঁদুরদের প্রয়োজনে ছাইরঙারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। ছাইরঙা নেতা বলল, কারুর অমঙ্গল নয়, পুরো ইঁদুর সমাজের মঙ্গলের জন্যই তারা একে অপরকে সাহায্য করতে চায় এবং তা করতে তারা সদা প্রস্তুত। আস্তে আস্তে ছাইরঙাদের নেতার গ্রহনযোগ্যতা ইঁদুর সমাজে বাড়তে থাকল। কালো, সাদা, পাঁশুটে, ফ্যাকাশে, এমনকি বাদামীদেরও অনেকে ছাইরঙা-নেতার গুণমুগ্ধ হয়ে উঠল। তারা ধীরে ধীরে বাদামীদের সঙ্গে সঙ্গে ছাইরঙাদেরও বন্ধু হয়ে উঠতে থাকল।

মুশকিল হল অন্যত্র। ছাইরঙা ইঁদুরদের অনেকেই ইতিমধ্যে তাদের জাঁতাকলে বন্দী জীবনের দুর্দশা ভুলে গিয়েছে। মুক্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। মুক্ত জীবনের সুযোগ সুবিধা, যা কিছু তারা সদ্য লাভ করেছে, সেই সবকিছুকে granted ধরে নিয়ে তারা এবার আর কিছু নয়, একেবারে সত্ত্বর চায় বাদামী ইঁদুরদের সম্পূর্ণ পরাজয়। ছাইরঙাদের নেতা ও প্রাজ্ঞ ছাইরঙারা সাধারণ ছাইরঙাদের অনেককেই বলার ও বোঝানোর সুযোগই পাচ্ছে না যে এত বছর বাদামীদের থেকে পিছিয়ে থাকার পর বাদামীদের পরাস্ত করতে গেলে প্রচুর সলতে পাকাতে হবে। সবটা একবারে হবে না। অনেক এগিয়ে পিছিয়ে গোটা ইঁদুর সমাজের নির্বিকল্প আস্থা অর্জন করে তবেই বাদামীদের সঙ্গে যুদ্ধ চিরতরে জেতা সম্ভব হবে। কিন্তু ছাইরঙা ইঁদুররা তা বুঝলে তো!

ছাইরঙা ইঁদুরদের এক অংশ কথায় কথায় তাদের নিজেদের নির্বাচিত নেতার ওপরেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। তাদের মনে হচ্ছে যে তাদের নেতাও যেন বাদামী ইঁদুরদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ছাইরঙাদের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইছে। ছাইরঙাদের নেতাকে তাই লড়তে হচ্ছে শুধু বাইরে নয়, ঘরেও। বাইরে তাকে নিরলস পরিশ্রম করতে হচ্ছে গোটা ইঁদুর সমাজের সঙ্গে সর্বোত্তম লাভদায়ী বোঝাপড়াটি ওয়ার্ক আউট করার উদ্দেশ্যে, আর ঘরে তার নিজের পরিবারের ইঁদুররাই তাকে প্রশ্নে ও অবিশ্বাসের বাণে জর্জরিত করে তুলছে যে জাঁতাকল থেকে মুক্ত হওয়ার পর এতদিন কেটে গেল, অথচ বাদামীদের দাপট আজও শেষ করা গেল না? কালো ইঁদুরদের যতখানি জায়গা বাদামীরা ছেড়ে রেখেছিল, ছাইরঙাদের নেতাও কি ছাইরঙাদের পক্ষে ক্ষতিকারক সেই একই বোঝাপড়া কালোদের সঙ্গে বজায় রেখে চলতে চাইছে? এইসব প্রশ্ন, এই ধরণের আভ্যন্তরীণ অবিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়েই নিরলস লড়তে হচ্ছে ছাইরঙা নেতাকে। ছাইরঙা-নেতা ই‌ঁদুর জানে, বাদামী, কালো, সাদা, ফ্যাকাশে, পাঁশুটে ইত্যাদি সব ধরনের ইঁদুরদের পারস্পরিক সম্পর্কের ডেলিকেট ব্যালেন্স বজায় রেখেই ছাইরঙাদের নিজেদের জায়গাটা স্থায়ীভাবে তৈরি করতে হবে তাকে। একমাত্র তাহলেই বাদামীদের পূর্ণতঃ ও চিরস্থায়ীভাবে পরাস্ত করতে পারবে ছাইরঙারা। এই কাজে বাদামী ইঁদুররা ছাইরঙা-নেতার সামনে যত বড় চ্যালেঞ্জ, সাধারণ ছাইরঙা ইঁদুররাও তার কাছে কম বড় চ্যালেঞ্জ নয়।

এইসব নিয়েই কাটছে দিন। ঘরে বাইরে কাঁটা বিছানো পথের ওপর দিয়ে প্রতি মুহূর্তে ব্যালান্স করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে ছাইরঙা-নেতা ইঁদুর। কখনও কখনও সময় এমনও আসছে যে ছাইরঙা নেতার অতি বিশ্বস্ত ইঁদুরও তার সিদ্ধান্ত বুঝতে পারছে না। ছাইরঙাদের অনেকেই নেতার প্রতি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠছে। তাদের সব কিছু এক্ষুনি চাই, চাই অবিলম্বে।

ছাইরঙা নেতা চেষ্টা করছে। পথ তার সামনে এখনও অনেক বাকি। আরও অনেক ভয়াবহ অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে তাকে ফেলবে বাদামী ইঁদুররা ও তাদের বন্ধুবর্গ। ছাইরঙাদের নেতা তা জানে। কিন্তু জানে না শুধু ছাইরঙা ইঁদুরদের সেই বড় অংশ, যারা জাঁতাকল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই নিজেদের নেতার কাছ থেকে আশা করছে যে এক ফুঁয়ে নেতা উড়িয়ে দেবে গোটা বাদামী সমাজকে। ছাইরঙানেতার ধাপে ধাপে এগোনো তারা বোঝেও না, বুঝতে চায়ও না। তারা বলছে, "তাহলে জাঁতাকল থেকে বেরোনোর জন্য আমরা আমাদের নেতার পাশে দাঁড়িয়েছিলামই বা কেন?" এইসব ইঁদুরদের ভাবখানা এমন যে নেতার সাথে সহযোগিতা না করে আজও জাঁতাকলে বন্দী থাকাই যেন তাদের পক্ষে ভালো ও শ্রেয় ছিল। এতদিন কিছুই যারা পায় নি, ছাড়া পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই তারা সবটুকু পেতে চায় একবারে। না পেয়ে রাগ করছে সেই নেতার ওপরেই, যে দিনরাত এক করে ছাইরঙাদের যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠাপ্রদানের প্রয়াস করে চলেছে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.

আজ্ঞে ঠিকই ধরেছেন। ছাইরঙা ইঁদুররা হল ভারতীয় হিন্দু সমাজ।

Comments

  1. 👌👌, এখন আমাদের পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে ৫০ বছর পূর্ণ সমর্থন করতে হবে ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

Karnataka Election Result 2023: Observations

Decoding BJP’s Bengal Debacle: Part 2