শ্রদ্ধা-হত্যা ও জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের পর্যবেক্ষণ: প্রশ্ন অনেক

প্রশ্ন ১:


শ্রদ্ধা ওয়ালকারের হত্যার পর ভারতীয় মানুষের এক অংশ রিলিজিয়াস অ্যালার্জিতে আক্রান্ত, অথচ নয়না সাহনীর দেহ যখন তন্দুরে পুড়িয়ে তন্দুরী নয়না বানিয়ে দিয়েছিল স্বামী সুশীল শর্মা, তখন সে নৃশংসতার দায় সুশীলের রিলিজিয়নের ওপর চাপানো হয় নি। নভেম্বরের ৮ তারিখ উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে প্রেমিকা আরাধনা প্রজাপতিকে মেরে যখন ছ'টুকরো করল প্রিন্স যাদব, তখন প্রিন্সকে নিয়েও চোখে পড়ে নি রিলিজিয়াস অ্যালার্জি। অ্যালার্জির রিপোর্ট নেই শিল্পা ঝরিয়ার হত্যাকারীকে নিয়েও। ১০ই নভেম্বর মধ্যপ্রদেশের জবলপুরে শিল্পাকে খুন করেছিল অভিজিৎ পাতিদার ওরফে হেমন্ত ভাদোড়ে। সে রাজ্যের শাহদোলে স্ত্রী সরস্বতীকে মেরে দু’টুকরো করল স্বামী রামকিশোর প্যাটেল, পুণায় প্রিয়ঙ্কাকে বিষ ইঞ্জেকশন দিয়ে মারল স্বামী স্বপ্নিল সাওন্ত, দিল্লিতে সৎ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে স্বামী দীপকের দেহ টুকরো টুকরো করল পুনম, কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এসবে ভাববৈকল্য নেই। অথচ শ্রদ্ধা ওয়ালকারের হত্যাকারী আফতাব আমিন পুণাওয়ালাকে নিয়ে জনরোষ তুঙ্গে, রিলিজিয়াস অ্যালার্জিতে আক্রান্ত বহু লোক। বেখাপ্পা বৈষম্যের এই সমাজে ২৯শে নভেম্বর প্রকাশিত হয়েছে আফতাবের নার্কো পলিগ্রাফ পরীক্ষার রিপোর্ট। “ফাঁসির সাজা হলেও আপত্তি নেই, জন্নতে মিলবে হুর”— পলিগ্রাফ পরীক্ষায় বলেছে আফতাব আমিন পুণাওয়ালা।


মুসলমানের জেহাদ কর্তব্যই তাদের সব অপরাধকৃত্যের মুখ্য চালিকাশক্তি— এমন মনে করেন বহু মানুষ। অমুসলমান সমাজের লোকক্ষয়, অমুসলমানের প্রাণ, ধর্ম ও সম্পদনাশের মত অপরাধকৃত্য নাকি ব্যক্তি মুসলমানের স্বর্গলাভের ও হুরপরীর যৌনকৌমার্যসম্ভোগের পুণ্যপথ নির্মাণ করে। অখণ্ড সুখময় পরলোক লাভের ব্যক্তিগত লোভেই নাকি অমুসলমানের বিরুদ্ধে অপরাধকর্ম করে মুসলমান। সেই কারণে হত্যাকারী আফতাব হলে রিলিজিয়াস অ্যালার্জি আছে, অভিজিৎ হলে নেই। অভিজিৎ, প্রিন্স, সুশান্ত, রামকিশোর, স্বপ্নিল, পুনমরা জানে অপরাধকৃত্যের পরিণামে সঞ্চিত পাপের ভার তাদের বইতে হবে, প্রায়শ্চিত্তের পথ দুরূহ, কষ্টসাধ্য। আফতাবরা ভাবে শ্রদ্ধাদের মারলে শাস্তি যা-ই হোক, পরলোক অখণ্ড সুখময়। “প্রেম নেই” উপন্যাসে এ সমাজের এক হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন গৌরকিশোর ঘোষ। একজন অপরাধ করে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে, অন্যজনের অপরাধের পশ্চাতে পুণ্যসঞ্চয়ের লোভ। একই অপরাধকৃত্য একজনের পাপ, অন্যজনের পুণ্য। উপলব্ধির জগতটি পৃথক। এমন হলে উভয়ের শাস্তি এক আইনে এক বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে হওয়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়। ইন্টার-কম্যুনিটি অর্থাৎ আন্তঃসম্প্রদায় অপরাধের বিচারে পৃথক ফৌজদারি আইন ও পৃথক বিচার বিধি থাকা আবশ্যক? নাকি উভয় সম্প্রদায়ের দেওয়ানি আইন এক (ইউনিফর্ম সিভিল কোড) হলেই মুসলমান অপরাধী সম্পর্কে ভারতীয় মানুষের রিলিজিয়াস অ্যালার্জির সমস্যা মিটবে? জেহাদ রিলিজিয়াস প্রেসক্রিপশন হলে ইউনিফর্ম সিভিল কোড কি জেহাদের মানসিকতা দূর করতে পারবে? নাকি আন্তঃসম্প্রদায় অপরাধগুলির ক্ষেত্রে ন্যায়ের স্বার্থে পৃথক ফৌজদারি আইন ও পৃথক বিচারবিধি অনিবার্য? কেবলমাত্র ইউনিফর্ম সিভিল কোড, নাকি ইউনিফর্ম সিভিল কোডের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টার-কম্যুনিটি অপরাধের বিচারে ডিফারেন্সিয়াল ক্রিমিনাল কোডও?


প্রশ্ন ২:


কংগ্রেস কর্মী নয়না সাহনী ও যুব কংগ্রেস নেতা ও বিধায়ক সুশীল শর্মা। সুশীলের আপত্তি ছিল স্ত্রী নয়নার সঙ্গে মাতলুব করিমের ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্বে। সন্দেহ করছিল সুশীল যে মাতলুবের সঙ্গে নয়নার সম্পর্ক অনৈতিক। অতঃপর ১৯৯৫ সালের ২রা জুলাই রাত্রে বাড়ি ফিরে সুশীল দেখে মদ্যপানরত নয়না টেলিফোনে বাক্যালাপরত এবং সুশীলকে ঢুকতে দেখে কেটে দেয় ফোন। সন্দেহপ্রবণ সুশীল অতঃপর রিডায়াল করে সেই নম্বর এবং শুনতে পায় মাতলুবের গলা। দেহেমনে আগুন নিয়ে প্রবল আঘাত করে নয়নাকে এবং তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয় নয়না সাহনীর। ভয় পেয়ে স্ত্রীর মৃতদেহ নিকটবর্তী এক রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায় সুশীল এবং সেখানকার ম্যানেজার কেশব কুমারের সহায়তায় তা ঢুকিয়ে দেয় রেস্তোরাঁর তন্দুরে। কেশব কুমার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, পালিয়ে যায় সুশীল শর্মা। অতঃপর ৮ দিনের মাথায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে সুশীল। সুশীলের সন্দেহ রোগ ও যৌনঈর্ষা কেড়ে নিয়েছিল মাতলুবের বান্ধবীর প্রাণ। নয়নার প্রতি মনের টান যৌক্তিকতার দিক থেকে কার বেশি হওয়ার কথা ছিল? সুশীল শর্মার নাকি মাতলুব করিমের?


প্রশ্ন ৩:


সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট জাস্টিস ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের পর্যবেক্ষণ ছিল— বিবাহিত নারীর যৌনতার একচ্ছত্র অধিকার তার স্বামীর নয় কারণ বিবাহের মাধ্যমে স্বামীর প্রতি পূর্ণ যৌন আনুগত্যের শপথ স্ত্রী নেয় না। অর্থাৎ পূর্ণ যৌনস্বেচ্ছাধীনতা স্ত্রীর ব্যক্তিপরিসরের অধিকার। ১৯৯৫’এ মাতলুব করিমের সঙ্গে বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়ার সময় এমনই ভেবেছিল নয়না সাহনীও? কিন্তু সুশীল মানতে পারে নি নয়নার যৌনস্বকীয়তার ব্যক্তিপরিসরটিকে। মানতে না পারার অধিকার কি সুশীলের ছিল? পারস্পরিক সম্পর্কে পার্টনারের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত স্বীকার করার পরিপূরক হিসেবে স্বীকার না করার অধিকার, ক্রুদ্ধ হওয়ার অধিকারও ব্যক্তিপরিসরের অধিকারের মধ্যে পড়া উচিত কারণ ক্রোধ, যৌনঈর্ষা স্বাভাবিক অভিব্যক্তি এবং অনৈচ্ছিক। স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকার কি ব্যক্তিপরিসরের অধিকার (right to privacy) নয়?


প্রশ্ন ৪:


শ্রদ্ধা ওয়ালকারেরও ছিল নয়না সাহনীর স্বামী সুশীলের মত সন্দেহ রোগ। সেও উদ্দাম অশান্তি করত আফতাবের ফোনালাপে, বহুনারীগমনে। বেঁচে থাকলে শ্রদ্ধাও কি যৌন ঈর্ষার তাড়নায় হত্যা করত আফতাবকে? যৌনঈর্ষা— সে কি অপরাধ, নাকি অসুখ, নাকি নেতিবাচক এক সাধারণ মানবঅভিব্যক্তি? কিন্তু শ্রদ্ধার যৌনঈর্ষা আফতাবের প্রাণনাশের কারণ হওয়ার আগেই শ্রদ্ধার দেহ কারি কাটের সাইজের টুকরোয় কাটা পড়েছে আফতাবের হাতে। স্ত্রী অবিশ্বাসিনী এমন ভাবনা সুশীল হজম করতে পারে নি, আর আফতাব সহ্য করে নি বান্ধবীর সন্দেহ রোগ ও অশান্তিপ্রবণতা। উভয়েই সমদোষে দুষ্ট? স্ত্রী’র পলিঅ্যান্ড্রি ও বান্ধবীর সন্দেহরোগ— পুরুষের মনে দুইয়ের অভিঘাত একই হওয়ার কথা? নাকি আফতাবের সহিষ্ণুতা সুশীলের চেয়ে কম, প্রতিক্রিয়াশীলতা ঢের বেশি?


প্রশ্ন ৫:


সন্দেহ দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধি যাতে আক্রান্ত সমাজের বহু নারীপুরুষ যদিও রোগের প্রাদুর্ভাব নারীর মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি। সন্দেহের বশে স্বামী তথা প্রেমিকের জীবনে অশান্তির বিষ ঢালেন অনেক মেয়ে। তৎসত্ত্বেও এমন মহিলারা সন্দেহ রোগের কারণে স্বামী কিংবা প্রেমিকের হাতে খুন সাধারণতঃ হন না। এমন স্ত্রীদের স্বামীরা স্ত্রীর সন্দেহবাতিককে তার ভালোবাসাজনিত অধিকারবোধের বিকৃত প্রকাশ বলে মনে করে অশান্তির যন্ত্রণা ভোগ করতে করতেই মিশ্ররস দাম্পত্য যাপন করেন। পারস্পরিক সম্পর্কে ক্রুদ্ধ হওয়ার অধিকার যদি ব্যক্তিপরিসরের অধিকার বলে স্বীকৃত হয়, তবে তেমন অধিকার প্রয়োগ করে এমন স্ত্রীদের হত্যা করতে পুরুষরা পারেন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত সচরাচর তেমন করেন না। আফতাব কি কোনো নতুন ট্রেণ্ড সেট করবে ভারতীয় সমাজে? আফতাব-শ্রদ্ধার কাহিনী শুনে উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের রশিদ খান বলেছেন দোষ উভয়েরই। রাগ হয়ে গিয়েছিল— শ্রদ্ধার দেহ ৩৫ টুকরোর বদলে ৩৬ টুকরোতেও নাকি কাটতে পারত আফতাব। ক্রুদ্ধ হওয়ার অধিকারকে যদি ব্যক্তিপরিসরের অধিকার বলে স্বীকৃতি দিতে হয়, তবে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হত্যা করার অধিকারকেও কি মৌলিক অধিকার বলে স্বীকার করে নেওয়া উচিত? রশিদ খান যা বললেন তা ভুল না ঠিক? ক্রমশঃ “আত্মরক্ষার অধিকার ও তজ্জনিত কারণে হত্যা করার অধিকার”-এর মতো “যৌন ঈর্ষায় অথবা সন্দেহে ক্রুদ্ধ হওয়ার অধিকার ও তজ্জনিত কারণে হত্যা করার অধিকার”-কেও কি আইনি স্বীকৃতি দেবে এই সমাজ?


প্রশ্ন ৬:


যৌনস্বেচ্ছাধীনতার উপযুক্ত প্রয়োগ নিজের জীবনে করেছে আফতাব পুণাওয়ালা, কিন্তু তা মানতে পারে নি শ্রদ্ধা ওয়ালকার। পূর্ণ যৌন স্বেচ্ছাধীনতার অধিকার কেবল নারীর? নাকি পুরুষেরও প্রাপ্য বহুনারীগমনের অধিকার? মাতলুব করিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নয়না সাহনী কি অন্যায় করেছিল? নয়না যা করেছিল তা অন্যায় না হলে আফতাবের যৌনস্বেচ্ছাধীনতাকে কি অন্যায় বলা যাবে?


প্রশ্ন ৭ - ১৩:

যৌনস্বেচ্ছাধীনতার অধিকারকে যদি আইনী স্বীকৃতি দিতে হয়, তবে ভারতের সংবিধানের ১৪নং ধারা (Equality of all before law) বলে তা নারী পুরুষ উভয়ের প্রাপ্য হবে। কিন্তু স্বামীর বহুনারীগমনের অধিকার শ্রদ্ধা ওয়ালকাররা কি মেনে নেবে? পরস্ত্রী’র পলিঅ্যান্ড্রির অধিকার পুরুষকে হৃষ্ট করতে পারে। কিন্তু নিজ স্ত্রী’র পলিঅ্যান্ড্রির অধিকার পুরুষ কি মেনে নেবে? মুসলমান সমাজ পলিগ্যামিকে মান্যতা দেয়, কিন্তু স্বামী, পিতা, পুত্র ভিন্ন অন্য পুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকানো মহিলাদের জন্য নিষিদ্ধ। যৌনতা আইনতঃ বাধাবন্ধহীন হয়ে পড়লে বিবাহ তথা বিবাহবিচ্ছেদের আইনসঙ্গত নবসংজ্ঞা কি হবে? বিবাহিতা মহিলাদের যৌন স্বেচ্ছাধীনতার অধিকারকে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও কি বিবাহবিচ্ছেদ পরবর্তী খোরপোষ পাওয়ার অধিকার মহিলাদের থাকা উচিত? থাকলে তা পুরুষের ওপর আইনসঙ্গত অত্যাচারে পরিণত হবে না কি? এবং বিবাহবিচ্ছেদপরবর্তী খোরপোষের প্রশ্ন যদি না থাকে, তাহলে তা মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য ভালো হবে না মন্দ? মুক্ত যৌনাচারের সমাজে সন্তানাদির ভবিষ্যত কেমন? তাদের যৌক্তিক দায় আইনতঃ কা(দে)র ওপর বর্তাবে?

ব্যক্তিপরিসরের অধিকারের সীমানা কোথায়? শ্রদ্ধা-হত্যার ঘটনা এবং জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের পর্যবেক্ষণ জন্ম দিয়ে ফেলেছে অনেকগুলি প্রশ্নের।


Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?