ধর্মনিরপেক্ষতার ধৈর্য্যের পরীক্ষায় কালোত্তীর্ণ হতে কি পারবে ফুরফুরা শরীফ?
শিক্ষক পদ্মশ্রী কাজী মাসুম আখতার, আরামবাগ টিভির শফিকুল ইসলামরা আশায় বুক বাঁধতে চাইছেন। চাইছেন মুসলিম সমাজের সাধারণ মানুষ ধর্ম সচেতন নয় আত্মসচেতন হয়ে উঠুন, রাজনীতি ক্ষেত্রে ধর্মীয় স্লোগান নয় ধর্মনিরপেক্ষ স্লোগান দিন, ভারতের মঙ্গলের কথা বলুন। তাঁদের এমন আশা ফলবতী হওয়ার যদি বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও থাকে, তাহলে তা হতে পারবে এই ভারতবর্ষের মাটিতেই। ধর্মের উপর মনুষ্যত্বকে স্থান দিতে মুসলমান সমাজ যদি আদৌ কোথাও পেরে ওঠে, তবে সে স্থান এই ভারত দেশই হবে। এ মাটির সেই শক্তি। ইস দেশ কে কঙ্কর কঙ্কর মে শঙ্কর হ্যায়।
কোনো এককালে মুসলমান শাসকের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন যাঁরা তাঁরাই আজকের মুসলমান সমাজ, যাঁদের প্রতিটি দেহকোষের মধ্যে হিন্দুত্বের অগুনতি অণু পরমাণু। উপমহাদেশের মুসলিম মানুষেরা আদতে হিন্দু বলেই (সুন্নত করে penile skin কেটে ফেলা গেলেও জেনেটিক বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থেকে যায় সুদীর্ঘকাল) তাঁদের চিত্ত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাঁদের মস্তিষ্কের ভিতর মুসলমানের মন বুনতে এযাবৎকাল পর্যন্ত অতি বিশেষ উদ্যোগ নিতে হয়েছে ফুরফুরা শরীফের ধর্মগুরুদের। পাছে হিন্দু সমাজের সঙ্গে পুর্নমিলনের বিন্দুমাত্র প্রবণতা দেখা যায় আতরাফ, আজলাফ শ্রেণীভুক্ত এই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে, সেই আশঙ্কায় অতি উচ্চ গ্রামে হিন্দু সমাজের উদ্দেশ্যে গালিও পাড়তে হয়েছে তাঁদের। সিপিএমের রাজনৈতিক জোটসঙ্গী আব্বাস সিদ্দিকী যেমন আচমকাই কামনা করে বসেছিলেন এমন একখানি ভাইরাসের আগমন যা কিনা একলপ্তে প্রাণনাশ করে ছাড়বে 50 কোটি ভারতীয়ের। আবার গত জুন মাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জোট শরিক ত্বহা সিদ্দিকীও বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়েছিলেন জ্ঞানবাপীর আদি বিশ্বেশ্বরলিঙ্গকে যদিও কিছুকাল আগে পর্যন্তও ত্বহার পূর্বপুরুষরাও হয়ত শিবপূজাই করতেন, কিংবা করতেন বিষ্ণু পূজা অথবা শক্তি পূজা। সেকালের 'বালিয়া বাসন্তী' তখনও আজকের 'ফুরফুরা শরীফ'এ পরিবর্তিত হয় নি। সে সত্য ভুলতে ও ভোলাতেই বোধ করি ধর্মীয় স্লোগানে ভরসা রাখতে হয় ত্বহা, সানাউল্লাহ, নাজমুস, আব্বাসদের। ধর্ম বাদ দিয়ে মনুষ্যত্বের কথা বলতে নিজ মনুষ্যত্বের প্রতি যে সম্মানবোধ থাকা প্রয়োজন, নিজেদের প্রতি ত্বহাদের নিজেদের অন্তরেই বোধ করি তার অভাব রয়েছে। হয়ত তাঁরা ভাবেন যে পরাজিত মানুষের কি আত্মসম্মান থাকতে আছে? বৈদেশিক শাসকের অত্যাচার সহ্য করে নিজ পূর্বপুরুষের সনাতন সংস্কৃতি রক্ষা করতে যাঁরা পারেন নি অথচ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন নিজেদের প্রাণ, এ দেশে মুসলমান হয়েছেন তাঁরাই আর সেই পরাজয়ের গ্লানিই বুঝি বা উগ্র ধর্মীয় স্লোগানের রূপ নিয়েছে বারংবার। রাসায়নিক বিশ্লেষণ করলে বুড়িগঙ্গা, ভৈরব, পদ্মা, মেঘনার জলে এখনও কি পাওয়া যাবে হিন্দুর রক্তের নোনতা স্বাদ? নাকি বহতা নদীর উজান বেয়ে মহাসমুদ্রে চিরবিলীন হয়েছে হিন্দু বাঙালীর রক্তকোষগুলি? আর 2021'এর ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনায় এ রাজ্যের প্রায় 7000 নারীর ওপর নৃশংস যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল যারা, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় তৃণমূলী হলেও ধর্মীয় পরিচয়ে সিংহভাগই ছিল মুসলিম। নির্যাতন বন্ধ করার প্রয়াসার্থে ধর্মনিরপেক্ষ নওশাদ সিদ্দিকী তখন এসে দাঁড়িয়েছিলেন কি? বাস্তব ঘটনা পরম্পরা থেকে এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে নওশাদ ধর্মনিরপেক্ষ হয়েছেন অতি সম্প্রতি এবং ভোট পরবর্তী হিংসার কাল পর্যন্ত তেমনটি তিনি ছিলেন না।
উপরোক্ত সর্বপ্রকারের হিন্দুঘাতী অবস্থানই বোধ করি পূর্বপুরুষের ধর্ম রক্ষা করতে না পারা পরাজিত এক সমাজের হতাশাজনিত আক্রোশের পরিণাম। কিন্তু তৎসত্ত্বেও, প্রকৃতই যদি ফুরফুরা শরীফের ধর্মগুরুরা নওশাদ সিদ্দিকীর মাধ্যমে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার বার্তাই দিতে আজ প্রবৃত্ত হয়ে থাকেন, তাহলেও হিন্দুর বিশ্বাস অর্জন করতে সে প্রয়াস আরও বহু শতাব্দী যাবৎ চালিয়ে যেতে হবে তাঁদেরকে। এতকাল যাবৎ যে অপরিণামদর্শী পরধর্মঅসহিষ্ণু হিংসায় লিপ্ত হয়েছেন তাঁরা, তার দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটতে লেগে যাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। ততকাল যাবৎ ধর্মের উপরে মনুষ্যত্বকে স্থান দিয়ে পরধর্মসহিষ্ণুতার দীপটি জ্বালিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে হবে নওশাদদের। তৎপূর্বকাল যাবৎ, নওশাদ সিদ্দিকীদের যে কোনো পদক্ষেপকেই সুচতুর, সঙ্ঘবদ্ধ, হিসেবী ও কৌশলী রাজনৈতিক পদক্ষেপ বলে মনে হবে এবং পশ্চিমবঙ্গের না হোক, ভারতের হিন্দু সমাজ সেই চালগুলির প্রত্যুত্তরে পাল্টা রাজনৈতিক পদক্ষেপই তুলবে। "জব জব ইস দেশ মে অওরঙ্গজেব আয়া হ্যায়, তব এক শিবাজী ভি উঠ খড়া হুয়া"— আর একবার স্মরণ করার সময় এসেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই কথা যা কালজয়ী বলে প্রতীত হতে চলেছে অনতিদূর ভাবীকালের প্রেক্ষাপটে।
নওশাদ সিদ্দিকীর আপাত আচরণ ও ভাবভঙ্গিমা থেকে তিনি মুক্তমনের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ বলে প্রতীত হলেও মূল পরিচয়গতভাবে তিনি যে মুসলিম ধর্মগুরু তা ভুলে যাওয়ার বিলাসিতা করার সুযোগ হিন্দু বাঙালীর নেই। ভোলা চলে না যে হিন্দু মানুষকে বিভ্রান্ত করার (আল ত্বাকিয়া) অভিসন্ধি নিয়ে ধর্মগুরু (পীরজাদা) পরিচয়ের আড়াল থেকে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবের ছদ্মরূপও ধারণ করে থাকতে পারেন এবং বাস্তবেও যে এমন হচ্ছে না তারও নিশ্চয়তা নেই। যদি নওশাদ সিদ্দিকী এ বিষয়ে সত্যনিষ্ঠ তথা প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষও হয়ে থাকেন, তথাপি হিন্দুদের বিশ্বাস অর্জন করতে বহু শতাব্দীর তপস্যা তাঁ(দের)কে করতে হবে এ-ই স্বাভাবিক। যে পাপ মুসলিম পরিচয়ধারীরা এযাবৎকাল ভারতবর্ষের বুকে করে এসেছেন তার স্খালনে মানুষের অবিশ্বাসের ভার বহন করার কৃচ্ছ্রসাধনটুকু তাঁদের অনিবার্য কর্তব্য প্রতীত হয়। তাঁদের গ্রহন করার পূর্বে এ হেন কর্তব্যের কষ্টিপাথরে যুগযুগান্তব্যাপী তাঁদের যাচাই করে নেওয়া অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর দূরদর্শিতার পরিচয় হিন্দুদের দিক থেকেও অন্য কিছুই হতে পারে না।
শফিকুল ইসলাম বা কাজী মাসুম আখতারের মত বিচক্ষণ মানুষও যদি নওশাদকে আগামীর নেতা বলে তুলে ধরতে চান, তাঁকে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলের নেতা হিসেবে endorse করতে চান, তাহলেও তাঁদের ব্যক্তিগত ফেসভ্যালুতে মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা গ্রহনযোগ্য হবেন না কারণ তাঁদের ভাবমূর্তিকে এ রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ তাঁদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি বলে বিশ্বাস করেন এবং এ-ও মনে করেন যে ইউটিউবার শফিকুল ইসলাম বা পদ্মশ্রী কাজী মাসুম আখতারের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি তাঁদের সমষ্টিসত্তার প্রতিনিধি নয়। কাজী মাসুম আখতার যতই প্রশ্ন করুন যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুর ওপর অত্যাচার হলে কেন চুপ করে থাকে এ রাজ্যের মুসলমান সমাজ, তাঁর সে প্রশ্ন মুসলমান সমাজের অন্তরের কথা বলে প্রতীয়মান হয় না বরং ব্যক্তি মাসুম আখতারের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে তোলে। অতএব বিশ্বাস অর্জন হেতু সময়ের কষ্টিপাথরের ঘর্ষণে পরীক্ষিত হওয়া মুসলমান সমাজের অনিবার্য ভবিতব্য হওয়া উচিত। they say, there's no shortcut to success.
বিঃদ্রঃ— বাস্তবে নওশাদ সিদ্দিকীর গ্রেফতারের ঘটনাটি সুপরিকল্পিত এবং তৃণমূল সিপিএম, কংগ্রেস ও ফুরফুরা শরীফের একটি সম্মিলিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ বলে অনুমান করা যায়। কিন্তু কেন নওশাদ সিদ্দিকীকে এইপ্রকার রাজনৈতিক ডিসকোর্সের মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন TMC-CPM-CONG-ফুরফুরা জোট সে বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ যথাযথ বিস্তারে লিপিবদ্ধ করব আগামীতে অন্য কোনো সময়।
Comments
Post a Comment