মহার্ঘ্যভাতা বিতর্ক: গণতান্ত্রিক পরিসরের সদ্ব্যবহার
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারীদের ডিএ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের পরিসরে মতামত শুনতে পাওয়া যাচ্ছে বিদগ্ধ মানুষজনের যা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য কারণ ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স কি সে সম্বন্ধে সম্যক জানার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে এ হেন বিতর্ক। এতদযাবৎকালব্যপী জনসাধারণের সাধারণ ধারণা ছিল যে ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স যেন সরকারি কর্মচারীদের মাইনে সময়ে সময়ে বাড়িয়ে দেওয়ার একখানি ‘কল’। এই কারণে তাঁদের উপর সাধারণ মানুষের রাগও যে নেই সে কথা বললেও সত্যের অপলাপ হয়। কিন্তু ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স বা মহার্ঘ্যভাতা যে বেতনবৃদ্ধি নয় বরং বেতনহ্রাস ঠেকানো এবং তা যে খেয়ালখুশি মত দেওয়ার বিষয় নয় বরং দেয় একখানি নির্দিষ্ট গাণিতিক সূত্র অনুসারে, বর্তমান বিতর্ক এখনও পর্যন্ত সেই বিষয়গুলি স্পষ্ট করে তোলে নি। তবে আশা আছে যে সাম্প্রতিক অতীতকাল থেকে অদ্যাবধি চলতে থাকা বিতর্কপ্রবাহটি সে স্পষ্টীকরণও দিয়েই ফেলবে।
একথা সত্য যে মহার্ঘ্যভাতা দিতেই হবে এমন কথা কর্মচারীদের নিয়োগপত্রে লিখিত থাকে না কারণ মহার্ঘ্যভাতা দেওয়ার লিখিত প্রতিশ্রুতির অর্থ দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধিরও অবশ্যম্ভাবিতার লিখিত ঘোষণা, যা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মূল্যবৃদ্ধি হবেই এমন কথা বলা যেহেতু সরকারের পক্ষে অসম্ভব, কর্মচারীদের মহার্ঘ্যভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়োগপত্রে লিখে দেওয়াও সেই কারণেই সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ এ হেন অনুল্লেখিত, অলিখিত ভাতাও যে অদ্যাবধি অন্য সকল রাজ্য এবং কেন্দ্রের সরকার তাদের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের দিয়ে আসছে, তার প্রত্যক্ষ অর্থ বোধ করি এই যে নিয়োগপত্রে লিখিত না থাকা সত্ত্বেও মহার্ঘ্যভাতা দেওয়ার একখানি বাধ্যতা সরকারের আছে। জীবনধারণের স্বার্থে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার বাধ্যতামূলক আবশ্যকতার কথাও কোথাও লেখা থাকে না।
টাকা বা মুদ্রা যেহেতু জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবা ক্রয়ের নিগোশিয়েবল্ ইনস্ট্রুমেন্ট (NI) মাত্র, সরকার তাই যে অর্থমূল্য বা টাকা কর্মচারীদের বেতন হিসেবে দিয়ে থাকে তা আদতে দেওয়া হয় সেই টাকার সমমূল্যের জিনিসপত্র কিনবার উপায় হিসেবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে কি কি অ্যাসেট এক বছরে কর্মচারীরা ক্রয় করেছেন তার একখানি তালিকা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে প্রতি বছর জমা করতে হয় সরকারি কর্মচারীদের। সরকার যে বেতন হিসেবে টাকা নয় বরং টাকার বিনিময়ে সমমূল্যের পণ্যাদিই আদতে কর্মচারীদের দিয়ে থাকে, বাৎসরিক অ্যাসেটের তালিকা জমা দেওয়ার এ হেন বাধ্যবাধকতাটি তার পরোক্ষ নির্দেশক। আবার বাজারের নিয়মে পণ্য ও পরিষেবা যেহেতু কালক্রমে মহার্ঘ্য হয়, মহার্ঘ্যভাতাও তাই আবশ্যক হয়ে পড়ে। কোনো এক বছর সরকারের সকল শর্ত মেনে নিয়ে সরকারের তরফ থেকে যে পরিমাণ টাকা বেতন হিসেবে পাওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে চাকরিতে যোগ দান করেছিলেন কোনো এক ব্যক্তি, ধরা যাক সেই টাকার পূর্ণ অর্থমূল্যে সেই বছর কিনতে পারা যেত মাসে একশ' কেজি চাল। এমতাবস্থায়, ঐ ব্যক্তির চাকরি জীবনের পূর্ণ সময়কালযাবৎ ঐ একশ’ কেজি চালের মূল্য (মূল্যবৃদ্ধির ফলে একশ’ কেজি চালের মূল্য যখন যেমন তখন তেমন হিসেবে) তাঁকে বেতন হিসেবে দেওয়া সরকারের কর্তব্য এবং উক্ত কর্মচারীর তা অধিকার বলে বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। যদি তা না হয়,তবে বাজারের নিয়মে পণ্যের মহার্ঘ্যতার কারণে কর্মচারীর মূল বেতনের ক্রয়মূল্য ক্রমশঃ হ্রাস পাওয়ার কথা যার ফলে বেতনের ধারণাটিই আদতে হয়ে পড়ে তাৎপর্যহীন। অপরপক্ষে, বেতনের গুরুত্ব বজায় রাখার মধ্যেই নিহিত থাকে শ্রমের উপযুক্ত মূল্যায়ণ তথা শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজের চাবিকাঠি।
বাৎসরিক ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে মহার্ঘ্যভাতার তুলনা চলে না কারণ সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্টটি হল কেবলমাত্র এক বছরের অভিজ্ঞতার মূল্য এবং তা দেওয়া হয় ন্যূনতম হারে। কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্টের মধ্যেই ঢুকে থাকে অভিজ্ঞতার মূল্য, মহার্ঘ্যভাতা এবং পারফরম্যান্স ইনসেনটিভ। ফলে বেসরকারি ক্ষেত্রের বাৎসরিক ইনক্রিমেন্টমূল্য সচরাচর সরকারি ক্ষেত্রের চাইতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশি হয়ে থাকে। অর্থাৎ বেসরকারি কর্মীরাও মহার্ঘ্যভাতা পান কিন্তু যেহেতু সেই অর্থমূল্য নিয়মিতভাবে জুড়ে যেতে থাকে মূল বেতনের সঙ্গে এবং তাকে আলাদা করে রেখে আলাদা নামে ডাকা হয় না, তাই মনে হতে পারে যে তাঁরা যেন মহার্ঘ্যভাতা পান না। মহার্ঘ্যভাতা নামে চিহ্নিত না করেও মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিজেদের পারিশ্রমিক বাড়িয়ে নেওয়ার কাজটি নিয়মিত করতে থাকেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী মানুষেরাও। পেট্রলের দাম বাড়লে দাম বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের, বৃদ্ধি পায় অটো, রিক্সা, ট্যাক্সি আদি যানবাহনের ভাড়াও। অটো, ট্যাক্সির ভাড়া বৃদ্ধি পায় এমনকি সময়বিশেষেও। বৃষ্টি পড়লে অথবা রাত বাড়লে ভাড়া হয় ‘হঠাৎ মহার্ঘ্য'। চাহিদার নিরিখে কোনো নির্দিষ্ট দ্রব্যের উৎপাদন কমলেও মহার্ঘ্য হয় সেই দ্রব্য। বিক্রেতা দাম বাড়িয়ে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়াস করেন। অর্থাৎ মহার্ঘ্যভাতা একটি গতানুগতিক বিষয়। চাকুরি কিংবা ব্যবসা, পণ্য অথবা পরিষেবা যে কোনো ক্ষেত্রেই কর্মীমানুষেরা তা কোনো না কোনো ভাবে পেয়ে থাকেন। তা যদি না হত তাহলে ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে জীবনধারণ করতে পারা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
মহার্ঘ্যভাতার দাবীটি গাণিতিকভাবেই যুক্তিগ্রাহ্য হওয়ার পাশাপাশি সরকার-স্বীকৃতও বটে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ বেতন কমিশনের রিপোর্টেও মহার্ঘ্যভাতার অনিবার্যতার উল্লেখ আছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৯৮ সালে চতুর্থ বেতন কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর করার পূর্বেও উক্ত রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারীদের ‘বর্তমান বেতন’ বলতে বেতনের যে অংশগুলিকে ধরা হয়েছিল মহার্ঘ্যভাতা ছিল তার অন্যতম এবং সেখানেও মহার্ঘ্যভাতার হার ধরা হয়েছিল সর্ব ভারতীয় কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স(AICPI)’এর ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ ১৯৯৮ পূর্ব কালেও মহার্ঘ্যভাতা বেতনের অঙ্গ ছিল বলে চিহ্নিত হয়েছিল এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই চিহ্নিতকরণকে মান্যতা দিয়েছিল। পঞ্চম বেতন কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর করতে গিয়ে যে মেমোরাণ্ডাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে প্রকাশ করা হয় তাতেও বলা হয় যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে পঞ্চম বেতন কমিশন গঠনই করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারি বেতন কাঠামোর সাথে রাজ্য সরকারি বেতন কাঠামোর সাযুজ্য বজায় রাখার দায়িত্ব দিয়ে।অনুরূপভাবে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মেমোরাণ্ডাম অনুযায়ী, ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠনেরও প্রথম উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রীয় সরকার, সরকার অধিগৃহীত সংস্থা এবং অন্যান্য রাজ্য সরকারের বেতন কাঠামোর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারীদের বেতন কাঠামোর সাযুজ্য ঘটানো। অর্থাৎ একবার যখন (চতুর্থ বেতন কমিশনের রিপোর্ট দ্রষ্টব্য) পশ্চিমবঙ্গ সরকার মহার্ঘ্যভাতাকে কর্মচারীদের বেতনের অঙ্গীভূত বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, তখন তা থেকে সরে আসতে সরকার পারে না এবং অনুরূপ স্বীকৃতির পর মহার্ঘ্যভাতাকে আর ‘দয়ার দান’ বলে ব্যাখ্যা করাও চলে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের মূল বেতনক্রম বা পে স্কেল যেখানে প্রায় সকল পদমর্যাদার কর্মচারীদের ক্ষেত্রেই এক, সেখানে মহার্ঘ্যভাতার সমহার বজায় রাখা ভিন্ন উভয় সরকারের কর্মচারীদের মধ্যে বেতন সাযুজ্য স্থাপন করা আর কিভাবেই বা সম্ভব? যদিও নৈতিকতা ও আইন প্রায়শঃই হাত ধরাধরি করে চলে না, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একাধিক পে কমিশন রিপোর্টের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে মহার্ঘ্যভাতার মত বিষয়ের ক্ষেত্রে এই দুইয়ের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব কাগজে কলমে নেই।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার উভয়েরই সর্বনিম্নস্তরের এন্ট্রি লেভেল একজন কর্মচারীর মূল বেতন, দেখা যাচ্ছে, ১৭০০০.০০ টাকা কারণ তাঁদের বেতনক্রম ও পদমর্যাদা একই। এই সময়কালে ভারত সরকারের ডিএ’র পরিমাণ ৩৮% হারে ৬৪৬০.০০ টাকা এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডিএ’র পরিমাণ ৩% হারে ৫১০ টাকা হওয়ায় সমপদস্থ, সমমর্যাদাসম্পন্ন ও সমবেতনক্রমের এ হেন উভয় ব্যক্তির মধ্যে বেতনের পাটিগাণিতিক পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ২৩৪৬০.০০ – ১৭৫১০.০০ = ৫৯৫০.০০ টাকার। একই স্থানে কর্মরত, একই বাজার থেকে পণ্য ও পরিষেবা গ্রহনকারী সমপদস্থ, সমবেতনক্রমের কর্মচারীদের মধ্যে এমন বেতনবৈষম্য ভারতবর্ষে নজিরবিহীন। গাণিতিক উদাহরণ সহযোগে প্রমাণ করা সম্ভব যে এমন বৈষম্যের প্রকৃত তাৎপর্য— একই বাজারে একই মুহূর্তে একই পণ্য ক্রয়রত সমপদস্থ দুই ব্যক্তির জন্য উক্ত পণ্যের প্রকৃত মূল্য এক হলেও আপেক্ষিক মূল্য ভিন্ন। কিন্তু বৈষম্য কেবলমাত্র মহার্ঘ্যভাতার অর্থমূল্যের এ হেন পার্থক্যটির কারণেই নয়। বৈষম্যের আদত অস্তিত্ব বরং মহার্ঘ্যভাতার অভাবে মূল বেতনের ক্রয়ক্ষমতার হ্রাসের মধ্যে। ২০১৬ সালে সর্বভারতীয় কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স নাম্বার (AICPIN)’র বেস পরিবর্তিত হওয়ার বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে ঐকিক পাটিগণিতের নিয়মে অঙ্ক কষে দেখানো সম্ভব যে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বনিম্নস্তরের এন্ট্রি লেভেল একজন কর্মচারীর ১৭৫১০.০০ টাকা বেতনের ক্রয়ক্ষমতা আদতে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসের মূল্যসূচকের নিরিখে সেই মাসের ৫৩৭১.০০ টাকার সমান। অথচ ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বনিম্নস্তরের এন্ট্রি লেভেল একজন কর্মচারীর আদত বেতন ছিল ৬৬০০ টাকা। অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে যে ব্যক্তি মাসিক ৬৬০০.০০ টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, ২০২২’এর অক্টোবর মাসে ঠিক সেই একই যোগ্যতার আর এক ব্যক্তি একই চাকরিতে একই পদে যোগ দিলে ২০০৮’এর জানুয়ারি মাসের মূল্যসূচকের নিরিখে পাচ্ছেন ৫৩৭১.০০ টাকা যদিও বাস্তবে বেতনের অর্থমূল্য বেড়ে আদতে হয়েছে সর্বমোট ১৭৫১০.০০ টাকা। অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে গণনা করলে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের ১৭৫১০.০০ টাকা = ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসের ৫৩৭১.০০ টাকা যদিও এই টাকা ঐ বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইনতঃ প্রস্তাবিত আদত বেতনের চাইতে ৬৬০০.০০ – ৫৩৭১.০০ = ১২২৯.০০ টাকা কম। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সমপদস্থ, সমমর্যাদাসম্পন্ন ও সমবেতনক্রমের হওয়া সত্ত্বেও মূল্যসূচক অনুসারী মহার্ঘ্যভাতার অভাবে দিনে দিনে হয়ে পড়ছেন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর এবং গাণিতিক নিয়মে এ হেন নীরব বেতনহ্রাস সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে দ্রুততর গতিতে অর্থাৎ এক্সপোনেনশিয়ালি। ভারতবর্ষের অন্য কোনো রাজ্যে এর নজির নেই। এই নজির যদি মান্যতা পায়, বেতন অনুশাসন তবে অচিরেই ভেঙ্গে পড়বে বেসরকারি ক্ষেত্রেও এবং গোটা সমাজের পক্ষে তা বিপজ্জনক।
সরকারি কর্মচারীদের অভিজ্ঞতা সাধারণ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে। এ হেন অভিজ্ঞতার সঙ্গে বেসরকারি নানা ক্ষেত্রের কর্মচারীদের অভিজ্ঞতার কোনো সাদৃশ্য নেই। অর্থাৎ রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা যদি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বেসরকারি চাকরিতে যোগ দিতে যান তাহলে নতুন বেতনের প্যাকেজে পূর্ব অভিজ্ঞতার মূল্য যে তাঁরা পাবেন না সেকথা বলাই যায় কারণ সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতার কোনো প্রয়োজনীয়তা বেসরকারি ক্ষেত্রের কোনো ইণ্ডাস্ট্রিতেই নেই। এক রাজ্য সরকারের চাকরি ছেড়ে অন্য রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে যাওয়ার সম্ভাবনাও তাঁদের প্রায় নেই কারণ বিধি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট বয়সের ঊর্ধ্বে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া যায় না। অর্থাৎ নিজেদের পরিসরে যে কোনো সরকারের কার্যতঃ একখানি একচেটিয়া কাজের বাজার বা মনোপলি থাকে। এই মনোপলির কারণে কোনো সরকার যদি তার কর্মচারীদের বঞ্চিত করার নীতি গ্রহন করতে চায় তবে তা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে পড়ে। সরকারের এইরূপ প্রাইভেটাইজেশন সেক্ষেত্রে বিপজ্জনক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার ইঙ্গিত বহন করে।
মহার্ঘ্যভাতার গণনাটি মূল্যসূচকভিত্তিক এবং প্রতি মাসে মূল্যসূচক গণনা করে প্রকাশ করে লেবার ব্যুরো অব ইন্ডিয়া। উক্ত মূল্যসূচকের নিরিখে অতঃপর কর্মচারীদের দেয় মহার্ঘ্যভাতার হার গণনা করে সরকার। অর্থাৎ মহার্ঘ্যভাতার হার মূল্যসূচকভিত্তিক একটি সুনির্দিষ্ট গাণিতিক সূত্র মেনে নির্ণয় করা হয় যে গাণিতিক ফর্মুলার বাইরে মহার্ঘ্যভাতার অঙ্ক পিছলে বেরিয়ে যেতে পারে না। সরকার যখন মহার্ঘ্যভাতার কোনো এক কিস্তি কোনো একটি নির্দিষ্ট হারে দেয়, তখন যদিও বলা হয় যে ‘সরকার x শতাংশ মহার্ঘ্যভাতা ঘোষণা করল’, কিন্তু বাস্তবে তা যতখানি না ‘ঘোষণা করা' তার চেয়ে বেশি ‘মূল্যসূচকের অনুগামী হওয়া'। মাসিক মূল্যসূচক ক্রমান্বয়ে অনুসরণ করলে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে বলতে পারা সম্ভব যে ভারত সরকারের পরবর্তী কিস্তির মহার্ঘ্যভাতার হার কত হতে চলেছে। তাই ঘোষণার দর্প নয়, মহার্ঘ্যভাতা দেওয়ার মধ্যে আদতে থাকে সরকারের অর্থনৈতিক নিয়মানুবর্তিতা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে মহার্ঘ্যভাতার হার প্রায়শঃই যদৃচ্ছভাবে পিছলে বেরিয়ে গিয়েছে (এরাটিক) সুনির্দিষ্ট গাণিতিক হিসাবের বাইরে। যেমন, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে ১০% মহার্ঘ্যভাতার এক কিস্তি দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যখন মহার্ঘ্যভাতার ক্রমসঞ্চিত (কিউমুলেটিভ)হার দাঁড় করালো ৫১%’য়, রাজ্য সরকার তখন সেই ১০% কিস্তির পরিবর্তে ১১%’র একখানি কিস্তি দেয় তার ২ বছর পর ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ্যভাতার কিউমুলেটিভ হার তার ফলে হয়ে দাঁড়ায় ৫২%, কেন্দ্রীয় সরকারি মহার্ঘ্যভাতার ক্রমসঞ্চিত হার যদিও তদ্দিনে হয়ে গিয়েছিল ৮০. ১০% কে ১১% করে দেওয়ার এ হেন সিদ্ধান্তটি মহার্ঘ্যভাতার মূল্যসূচকনির্ভর গাণিতিক সূত্র অনুসারে না হলেও তার সপক্ষে একথাই বলা যায় যে ১০% কে ১১% করার পরেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে মহার্ঘ্যভাতার ক্রমসঞ্চিত হারের পার্থক্য যেহেতু রয়ে গিয়েছিল ২৮%’র, সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার গাণিতিক নিয়মের বাইরে গিয়ে হলেও ১০% এর স্থানে ১১% দিয়েছিল। এইভাবে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার রাজ্য সরকার মহার্ঘ্যভাতার হার স্থির করেছে অঙ্ক অনুযায়ী নয়, মর্জিমাফিক। সাম্প্রতিক ৩% হারটিও অনুরূপ মর্জিমাফিক যার ফলে ৩% দেওয়ার পরেও পার্থক্যটি রয়ে গিয়েছে ৩৫%’র. এর তাৎপর্য এই যে সরকার যে কর্মচারীদের মহার্ঘ্যভাতা একাদিক্রমে বকেয়া রেখে দিয়েছে, তা কার্যতঃ তারা অস্বীকার করে নি যদিও আদালতে সওয়াল করেছে অন্যপ্রকার।
সরকারের সাধ্য কতখানি তা অনুমানার্থে নানা অর্থবর্ষে সরকারের আর্থিক বাজেটের হিসাবটির দিকে তাকানো ভিন্ন বিশ্বাসযোগ্য উপায়ান্তর নেই। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে পরিকল্পনা বহির্ভূত রেভেনিউ এক্সপেণ্ডিচার (অর্থাৎ দানধ্যান বা রেউড়ি) খাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা। ২১-২২ অর্থবর্ষে একলাফে ২৪ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে তা হয় ৯০ হাজার কোটি টাকা আর ২২-২৩ অর্থবর্ষে আর এক লাফে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে তা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৭ হাজার কোটিতে। ২৩-২৪ অর্থবর্ষের বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ আরও ৫ হাজার তিনশ’ ঊনসত্তর কোটি টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ লক্ষ ১২ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে বেতন ও পেনশন বাবদ ২০-২১ অর্থবর্ষে সরকারের ব্যয় হয়েছিল ৭৮ হাজার কোটি টাকা, ২১-২২ অর্থবর্ষে তা হয় ৮২ হাজার কোটি টাকা আর ২২-২৩ অর্থবর্ষে তা হয়ে দাঁড়ায় ৮৭ হাজার কোটি টাকা। ২৩-২৪ অর্থবর্ষের বাজেটে বেতন পেনশন খাতে সরকার বরাদ্দ বাড়িয়েছে মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা, ফলে মোট বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে দানধ্যানকে। তা থেকে একথা বলাই যায় যে দানধ্যান খাতে সরকার যেহেতু ২৪ হাজার কোটি, ১৭ হাজার কোটির মত বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ বছরে বছরে বৃদ্ধি করতে পেরেছে, তার অর্থ সরকারের সঙ্গতির অভাব নেই। যথেষ্ট সঙ্গতি থাকলে তবেই দানধ্যান করতে পারা বাস্তবপক্ষে সম্ভবপর হয়। এমতাবস্থায় আদত প্রশ্নটি হল— বেতন বকেয়া রেখে (মহার্ঘ্যভাতাকে বেতনের অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকেই) দানধ্যান করা যায় কি না। ধর্মপ্রাণ মানুষ নিজেকে অভুক্ত রেখে দান করতে পারেন, কিন্তু কর্মচারীকে প্রাপ্য না দিয়ে দান করতে পারেন কি না বিচার্য সেইটিও।
Comments
Post a Comment