DA: চটিচাটারা টানছে বৃটিশ আমলের কেসের 1954তে বেরোনো রায়, মমতা কি বৃটেনের রাণী? নাকি পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক মুখ্যমন্ত্রী?
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্সের পরিপ্রেক্ষিতে উঠছে একটি অতি প্রাচীন কেস রেফারেন্স। আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীদের ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স কেসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডিএ না দেওয়ার অসম্ভব অবস্থানটিকে সমর্থন করতে গিয়ে উত্থাপন করে বসেছেন The case of State of Madhyapradesh vs. G. C. Mandawar on 13 May, 1954. এই কেসে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল সমস্ত বেতনক্রমের সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের সমহারে ডিএ বা মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এই কেসের এই রায় যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারীদের বর্তমান ডিএ কেসটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, তা বুঝতে হলে কেসটি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বিশদে জানা প্রয়োজন।
প্রথমে দেখা দরকার কেসটি কোন্ সময়ের। এর ঘটনাক্রম শুরু হচ্ছে 1940 সাল থেকে, পৃথিবীতে যখন চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অর্থাৎ বাজার যুদ্ধের এবং স্থান বৃটিশ ভারতবর্ষ, স্বাধীন ভারতবর্ষ নয়। তৎকালীন সরকারি কর্মচারীরাও (অর্থাৎ বৃটিশ সরকারি কর্মচারীরা) ছিলেন সমাজের সবচেয়ে উচ্চ বেতনশালী মানুষ। তৎপূর্বে, সাধারণ নিয়মে মূল্যবৃদ্ধি নামক কোনো কিছু ছিল বলে জানা যায় না। অর্থাৎ আজকের দিনে মূল্যবৃদ্ধি যেমন একটি দৈনন্দিন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটছে প্রতিদিন, সেই সময় তেমন ছিল না। মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা যে ছিল না সেকথা আমাদের ছেলেবেলায় বয়োঃজ্যেষ্ঠদের মুখেও নানাভাবে শুনেছি। তাই যুদ্ধের বাজারে যখন হঠাৎ করে ঘটল অবিশ্বাস্য মূল্যবৃদ্ধি, কেন্দ্র সরকার অর্থাৎ বৃটিশ সরকার তখন মনে করেছিল যে এর দ্বারা সবচাইতে খারাপ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সরকারি কর্মচারীরা। সরকার তাই সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকারি কর্মচারীদের দেওয়া হবে একটি গ্রেইন অ্যালাওয়েন্স বা শস্য ভাতা। এই শস্য ভাতার সঙ্গে কিছুটা তুলনীয় সাম্প্রতিক অতীতে কোভিড মহামারী কালে ভারতবর্ষের আশি কোটি সাধারণ মানুষকে ভারত সরকারের দেওয়া গরীব কল্যাণ অন্ন যোজনার প্রকল্পটি। 1940’এ বৃটিশ সরকারের তরফ থেকে সরকারি কর্মচারীদের দেওয়া শস্য ভাতা এবং বর্তমান ভারতে প্রধানমন্ত্রী গরীব কল্যাণ অন্ন যোজনা — দুইটিই দয়ার দান যার কোনো আইনগত বাধ্যতা ছিল না বা নেই। যেহেতু সাধারণ ভারতীয় মানুষের জীবন নিয়ে তৎকালীন বৃটিশ সরকারের কোনো মাথাব্যথা ছিল না, তাই তাদের দয়ার দান তারা সীমাবদ্ধ রেখেছিল শুধুমাত্র তাদের কর্মচারীদের জন্যই এবং সেই দয়ার দানকে তারা নাম দিয়েছিল 'ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স'। ডিএ’র উৎপত্তি সেই সময়। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নাম যদিও সেই একই রয়েছে, তবু সেদিনকার বৃটিশ সরকারের দেওয়া সেই DA আর বর্তমানে বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া DA এক জিনিস নয়। মূলগত অর্থেই তারা আলাদা। তখনকার ডিএ ছিল বিষম পরিস্থিতির কারণে উদ্ভুত মূল্যবৃদ্ধি সমস্যার সমাধানকল্পে নেওয়া একটি অ্যাক্ট অফ গ্রেস বা দয়ার দান। অপরপক্ষে, বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বলে যা দেওয়া হয় তা হল— নিয়মিত তথা প্রায় নিত্যনৈমিত্তিকভাবে ঘটে চলা মূল্যবৃদ্ধির ফলস্বরূপ তাদের মাইনে ক্রমশঃ কমে যাওয়া আটকানোর উদ্দেশ্যে নিতে হওয়া একটি বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নাম। নাম এক থাকলেও বিষয় দুইটি পৃথক এবং দুটিকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। 1954’র যে কেসের কথা বলা হয়েছে সেই কেসটির রায় 1954 সালের হলেও কেসটির বিষয়বস্তু সেই 1940 থেকে 1948’এর মধ্যে ঘটে যাওয়া পরস্পরসংযুক্ত ঘটনাবলীর উপরেই আধারিত। তখন ডিএ 'দয়ার দান' কারণ তখন মূল্যবৃদ্ধি কোনো প্রত্যাশিত তথা স্বাভাবিক অর্থনৈতিক ঘটনা নয়।
1954’য় মধ্যপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে জি সি মণ্ডওয়ারের কেসকে রেফারেন্স হিসেবে ধরে অরুণাভ ঘোষের মত আইনজীবীর তরফ থেকে যে দুইটি বিষয়কে আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ বলে তুলে ধরা হচ্ছে তা হল—
1. ডিএ কোনো দাবী নয়, দয়ার দান
2. রাজ্য তার নিজের ইচ্ছে মত কর্মচারীদের ডিএর হার নির্ণয় করতে পারে কেন্দ্র সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে তা সমান হতেই হবে এমন কোনো বাধ্যতামূলক নিয়ম নেই।
দেখা যাক দ্বিতীয় বিষয়টির দিকে। প্রথমেই বলে রাখা উচিত যে রাজ্যের হার কেন্দ্রীয় হারের সঙ্গে সমান হতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা সত্যিই নেই। রাজ্য সরকারকে ডিএ যে কেন্দ্রীয় হারেই দিতে হবে তা নয়। রাজ্য সরকার যদি প্রমাণ করতে পারে যে তাদের রাজ্যে মূল্যবৃদ্ধির হার কেন্দ্রীয় গড় মূল্যবৃদ্ধির হার অপেক্ষা আলাদা, তবে তারা নিজেদের রাজ্যের গড় মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে ডিএ'র হার আলাদা করে নির্দিষ্ট করতেই পারে। এই বিষয়ে আর একটি ব্লগে বিস্তারিত লিখেছি যে রাজ্যের ডিএ’র হার কেন্দ্রীয় হার থেকে পৃথক হতে গেলে রাজ্যের তরফে কি কি করণীয় ছিল যা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকে করা হয় নি। স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি এ রাজ্যের মূল্য সূচক আলাদাভাবে নিয়মিত হিসাব ও প্রকাশ করত ঠিক যেমন করে AICPIN প্রতি মাসে নিয়মিত প্রকাশ করে চলেছে লেবার ব্যুরো অব ইন্ডিয়া, সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের কর্মচারীদের ডিএ পশ্চিমবঙ্গের মূল্য সূচক (WBCPIN) হিসেবে দিতে পারত, কেন্দ্রীয় হারে দিতে হত না। এই বিষয়ক বিস্তারিত ব্লগের (ইংরেজিতে) লিঙ্ক এইখানে।👇 https://dbsdesk.blogspot.com/2022/11/dangling-da-in-west-bengal-denial-of.html
ঠিক তেমনভাবেই যদি দেখা যায় যে কোনো বিশেষ শ্রেণীর কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান অন্যদের তুলনায় আলাদাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে, তবে সরকার ইচ্ছে করলে, যুক্তিসঙ্গত কারণে একশ্রেণীর কর্মচারীকে দেয় ডিএ’র হার অন্য আর এক শ্রেণীর কর্মচারীকে দেয় হারের চেয়ে আলাদা রাখতেই পারে। তবে তা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত কারণে হতে হবে, কারও খেয়ালখুশি মত নয় এবং অবশ্যই হতে হবে নির্দিষ্ট গাণিতিক ফর্মুলা মেনে। এখানেই দেখে নেওয়া যাক 1954 সালের রায়ে ঠিক কি বলা হয়েছিল এবং মনে করে নেওয়া যাক কোন্ পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছিল কোন্ সিদ্ধান্ত।
একটু আগেই উল্লেখ করেছি যে ঘটনাক্রমের শুরু 1940 সালে কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারের আপৎকালীন পরিস্থিতিতে নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত থেকে। (গ্রেইন অ্যালাওয়েন্স বা শস্য ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত যার নাম অতঃপর বৃটিশ সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হয়েছিল ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স বা মহার্ঘ্য ভাতা) প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যেসমস্ত কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারি কর্মচারীরা বিভিন্ন অঞ্চলে বা প্রভিন্সে পোস্টেড ছিলেন, তাঁরা এই ডিএ’র সুবিধা সেই সেই অঞ্চলের বৃটিশ সরকারি কর্মচারীদের সমান হারে পাবেন। ফলে অঞ্চল থেকে অঞ্চল ভেদে তা আলাদা হয়ে যাবে। এই কারণেই অর্থাৎ এই প্রভিন্স ভেদে আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণেই কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারি কর্মচারীদের অসুবিধা হচ্ছিল। কারণ সেই সময়ে যে কোনো কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারি কর্মচারী যে কোনো সময়ে সারা ভারতবর্ষের যে কোনো প্রভিন্সে পোস্টেড হতে পারতেন। আজকের দিনে যেমন আইএএস, আইপিএস আদি অল ইন্ডিয়া সার্ভিসগুলির স্টেট ক্যাডার সিস্টেম আছে যে সিস্টেমের বলে আইএএস আইপিএসরা অল ইন্ডিয়া সার্ভিসে থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট স্টেটের অধীনেই কাজ করেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেও তাঁদের অন্যত্র ডেপুটেশনে পাঠাতে হলে ক্যাডার স্টেটের অনুমতি ভিন্ন পাঠাতে পারে না, সেরকম কোনো নিয়ম সেই সময় ছিল না।
সেই কারণে 10ই মে 1946’এ কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকার একটি সেন্ট্রাল পে কমিশন গঠন করে যাদের কাজ ছিল এই বিষয়ে কোনো সুষম সমাধানে উপনীত হওয়ার পথ বাতলানো। স্যর এস. বরদাচারিয়ার'এর নেতৃত্বাধীন এই কমিশন 3 মে 1947 সালে যে রিপোর্ট জমা দেয় তাতেই প্রথমবার একটি নির্দিষ্ট হারে সমস্ত কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারি কর্মচারীদের জন্য ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স দেওয়ার কথা বলা হয়। সেই নিরিখেই 27 মে 1947’এ সেন্ট্রাল প্রভিন্সেস অ্যাণ্ড বেরারের (বর্তমান মধ্যপ্রদেশ) প্রভিন্সিয়াল বৃটিশ সরকার একটি কমিটি গঠন করে যাদের কাজ ছিল ঐ সেন্ট্রাল পে কমিশনের সুপারিশগুলি বিচার বিবেচনা করা এবং সেই প্রভিন্সের বৃটিশ সরকারি কর্মচারীদের জন্য তার কতটা গ্রহন করা যায় এবং কি কি পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় সে ব্যাপারে আলাদাভাবে সুপারিশ করা। সেই কমিটি 22শে জুন 1948 সালে তাদের রিপোর্ট জমা দেয় যেখানে বলা হয়, যেসমস্ত প্রভিন্সিয়াল সরকারি কর্মচারী (সদ্য স্বাধীন হওয়ার পর ভারতবর্ষ তখনও বৃটিশ ডমিনিয়ন) মাসে 400 টাকার বেশি বেতন পান তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারি হারেই ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স পাবেন আর যাঁরা মাসে 400 টাকা বা তার কম বেতন পান তাদেরকে প্রভিন্সিয়াল সরকার কম হারে ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স দিতে পারবে। এই সুপারিশ গৃহীত হয় 16ই সেপ্টেম্বর 1948’এ। এই সুপারিশ অনুসারে বেশি মাইনের এবং কম মাইনের সরকারি চাকুরেদের জন্য যে আলাদা হারে ডিএ দেওয়া হয় সেই আপাত-বৈষম্যের বিরুদ্ধেই শ্রী জি সি মণ্ডওয়ার যে মামলা করেন সেই মামলাটিই এই আর্টিকলে বিচার্য যার রায় বেরোয় 1954 সালে।
এই আপাত-বৈষম্যটিকে 1954 সালের রায়ে স্বাধীন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বৈষম্য বলে মেনে না নিয়ে তাকে আইনগত বৈধতা দেয়। দেখে নেওয়া যাক তার প্রকৃত কারণ কি হতে পারে। মনে রাখতে হবে, সময়টা 1948. তখন সরকারি চাকরিতে মাসে 400 টাকার বেশি বেতন যাঁরা পেতেন নিঃসন্দেহে তাঁরা ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাই। আরও মনে রাখতে হবে যে রিপোর্টটি 1948 সালের হলেও তার বিচার্য বিষয় ছিল প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের কেন্দ্রীয় এবং প্রভিন্সিয়াল সরকারি কর্মচারীদের বিষয়ে যাঁরা সকলেই ছিলেন একই বৃটিশ সরকারের কর্মচারী। তখনও ভারতের সংবিধান আসে নি (ভারতের সংবিধান কার্যকর হয় 1950 সালের 26শে জানুয়ারি), কেন্দ্রে, রাজ্যে আলাদা আলাদা সরকারও গঠিত হয় নি এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা দপ্তর নির্বিশেষে অধিকাংশই ছিলেন কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। অপরপক্ষে, সমস্ত নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারীই তখন ছিলেন আলাদা আলাদা প্রভিন্সিয়াল বৃটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। সুতরাং ধরে নেওয়া অযৌক্তিক হবে না যে তখন মাসে 400 টাকা বেতনের অধিক যাঁরা পেতেন তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারের কর্মচারী। মুষ্টিমেয় যে ক'জন উচ্চপদস্থ কর্মচারী প্রভিন্সিয়াল বৃটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলেন তাঁদের জন্য সেই কারণেই কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। সমাজের বিভাজন তখন সম্ভবতঃ এমনই ছিল যে 400 টাকার কম বেতন পাওয়া কোনো কর্মচারী কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল না। তাই সমাজ-অর্থনৈতিক স্তরভেদে বিভিন্ন হারে ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স দেওয়ার সিদ্ধান্তের দ্বারা কোনো সামাজিক বৈষম্য ঘটার সম্ভাবনা সেই সময় ছিল ন্যূনতম। এমন কোনো প্রভিন্সিয়াল বৃটিশ সরকারি কর্মচারী সম্ভবতঃ তখন ছিলেন না যিনি নিজে মাসিক 400 টাকার কম বেতন পেতেন এবং যাঁর কোনো প্রতিবেশী তাঁর সমান বেতন ক্রমে একই পদে সমান কাজ করেও কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মচারী হওয়ার কারণে অধিক ডিএ পাচ্ছিলেন যা তাঁদের পরস্পরের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি করছিল। সুতরাং, এই রকম আলাদা স্কেলের জন্য আলাদা হারে ডিএ দেওয়ার মাধ্যমে কোনো প্রত্যক্ষ সামাজিক অসাম্য নতুন করে সৃষ্টি করা হয় নি। যারা এমনিতেই সমাজের উচ্চস্তরে ছিলেন, উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাঁরাই উচ্চ হারে ডিএ পাচ্ছিলেন আর নিম্নস্তরের কর্মচারীরা ডিএ পাচ্ছিলেন কম হারে। এতে সামাজিক নানা স্তরের মধ্যে প্রিএক্সিস্টিং বৈষম্য বৃদ্ধি পেলেও, একই স্তরের ভিতরে সমপদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে কেবলমাত্র কে কোন্ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মচারী, কেন্দ্রীয় নাকি প্রভিন্সিয়াল, সেই কারণে কোনো বৈষম্য সৃষ্ট হয় নি। কারুরই এ কথা মনে হয় নি যে 'আজ যদি আমি প্রভিন্সিয়াল সরকারের কর্মচারী না হয়ে শুধুমাত্র সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী হতাম তাহলে সম পদে সমান কাজ করে আমি অধিক বেতন পেতে পারতাম'। তখন কারও পক্ষেই বলা সম্ভব ছিল না ‘না পোষালে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করুন’।
উক্ত পরিস্থিতিতে যখন ডিএ’র অর্থ ছিল আলাদা, সরকারে সরকারে বৈষম্য ছিল না কারণ সমস্ত সরকারই ছিল একই বৃটিশ সরকার, তখন সামাজিক স্তরগুলি ছিল অন্যরকম এবং সময় ও পরিস্থিতিও ছিল আজকের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তখনকার ঘটনার ভিত্তিতে নেওয়া কোনো রায় আজকের পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করতে যাওয়া শুধু মূর্খামি নয় চরম অন্যায় ও শয়তানি। আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ এর মধ্যে ঠিক কোন্ পর্যায়ে পড়বেন সে বিচারের ভার যাঁরা এই ব্লগ পড়ছেন তাঁদের।
বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে করণিক পদে সম বেতনক্রমে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীও আছেন, তেমনি আছেন রাজ্য সরকারি কর্মচারীরাও। একই সমাজে পাশাপাশি বাড়িতে বাস করা, সমযোগ্যতাসম্পন্ন, সমপদস্থ, সমান বেতন ক্রমে কর্মরত প্রতিবেশীরা যাঁরা একই বাজার থেকে একই ধরনের পণ্য ক্রয় করে অভ্যস্ত তাঁদের ভিতরে দৈনন্দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে ডিএ বৈষম্য অর্থাৎ বেতন বৈষম্য। 1954 সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সমপদস্থদের মধ্যে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি হয় নি, ফলে ভারতের সংবিধানের 14 নম্বর ধারা অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সকল মানুষের সমানাধিকারের বিষয়টিও লঙ্ঘিত হয় নি। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের আর্টিকল 14 লঙ্ঘিত হচ্ছে কারণ একই পদে চাকুরিরত, একই বেসিক পে সম্পন্ন রাজ্য সরকারি ও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে দুস্তর বেতন বৈষম্য। 1954 সালের কেসটিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় যা হয়েছিল তাতে বেতন বৈষম্য আরও অধিক বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল উচ্চপদস্থ ও অপেক্ষাকৃত নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে। কিন্তু সমপদস্থদের মধ্যে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি হয় নি। কিন্তু বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব মূল্য সূচক WBCPIN'এর অস্তিত্ব নেই বলেই যা আছে তার নিরিখে অর্থাৎ AICPIN'এর নিরিখে কর্মচারীদের ডিএ দেওয়ার সুপারিশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারীদের জন্য গঠিত পঞ্চম ও ষষ্ঠ বেতন কমিশন এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা মেনেও নিয়েছে। বেতন কমিশনের এ হেন সুপারিশ মেনে ইতিপূর্বে সেই হারেই ডিএ দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, অথচ গোল বেঁধেছে বর্তমানে। সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বাদ দিয়ে সেই অর্থে পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ব্যয় অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়িয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যার ফলে পরোক্ষে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারীদের বাঁচার অধিকার (Right to Life & Personal Liberty Article 21)
আইনগত সাম্যের অধিকারের (Equality of All Article 14) মত মৌলিক অধিকারগুলিকে পর্যন্ত।
1954 সালের রায়ের কোনো প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান ভারতবর্ষে এই কারণে নেই যে উক্ত কেসটি ছিল বৃটিশ ভারতবর্ষের যখন মূল্যবৃদ্ধি কোনো দৈনন্দিন বিষয় ছিল না। যুদ্ধের বাজারে তা প্রথম ঘটে এবং ঔপনিবেশিক বৃটিশ সরকার তা থেকে তার কর্মচারীদের রিলিফ দেওয়ার জন্য দয়াপরবশ হয়ে দিয়েছিল শস্য ভাতা বা মহার্ঘ্য ভাতা। অতঃপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। স্বাধীন ভারতে নানাবিধ দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে রোজ। আজকের দিনে এসে পেট্রোল ডিজেলের দাম বাজার নির্ভর ফলে অন্যান্য সকল দ্রব্যের দামই সতত পরিবর্তনশীল। লেবার ব্যুরো অব ইন্ডিয়া তাই নিয়মিত কাজ করে চলেছে মূল্য সূচক নির্ধারণের জন্য এবং প্রতি মাসে প্রকাশ করে চলেছে মূল্য সূচক অর্থাৎ অল ইন্ডিয়া প্রাইস ইনডেক্স AICPIN. এই প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ীই প্রতি ছ'মাসে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ্য ভাতা। আজকের মহার্ঘ্য ভাতা আর বৃটিশ সরকারের দ্বারা সেই প্রথম দেওয়া মহার্ঘ্য ভাতা এক বস্তু নয়। সেদিন তা প্রকৃতই ছিল 'দয়ার দান', আর আজ তা মাইনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যা বাদ দিলে বা কম দিলে তা কর্মচারীদের মাস মাইনে কমিয়ে দেওয়ার সমতুল্য যেটি করার এক্তিয়ার সরকারের নেই। মহার্ঘ্য ভাতা না দেওয়ার ফলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারীদের মাইনে দিনে দিনে কেমনভাবে কমে যাচ্ছে তার গাণিতিক ব্যাখ্যা রয়েছে এই ইউটিউব ভিডিওটিতে। অবশ্যই দেখা দরকার।👇
মধ্যপ্রদেশের কেসটির বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যেও বিচারপতিরা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন বৃটিশ আইন। অর্থাৎ স্বাধীনতা পূর্ব, বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের একটি কেসকে আজ রেফার করা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অত্যাচারকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করতে। করছেন অরুণাভ ঘোষের মত আইনজীবীরা এবং তা প্রচার করছে কলকাতা টিভি, দ্য ওয়াল'এর মত নিউজ পোর্টাল যাদেরকে সাধারণ মানুষ আজকাল ডাকেন চটিচাটা মিডিয়া বলে। এই কারণেই ইতিপূর্বে একখানি ইউটিউব ভিডিওতে বলেছি যে পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতার লড়াই আজও শেষ হয় নি, আজও এই রাজ্যে চলছে বৃটিশ শাসন, শুধুমাত্র পরিবর্তিত হয়েছে শাসকের মুখটুকু। তাই জারি রাখতে হবে স্বাধীনতার লড়াই।
আক্রমণ শাণাতে হবে এ রাজ্যের মুখ্য সচিব, অর্থ সচিব আদি প্রশাসনিক অফিসারদের বিরুদ্ধ যাঁরা নিজেরা মাইনে পাচ্ছেন ভারতের লেবার ব্যুরোর হিসেব করা কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ী অথচ রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মাইনে দেওয়ার সময় কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়ার বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বোঝাতে পারছেন না। আর এ হেন অসাংবিধানিক পদক্ষেপের সপক্ষে চটিচাটা মানুষজন রেফারেন্স দিচ্ছেন সংবিধান-পূর্ব কালের, বৃটিশ আইনের প্রেক্ষিতে বিচার পাওয়া একটি মামলার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এ রাজ্যের গণতান্ত্রিক মুখ্যমন্ত্রী? নাকি বৃটেনের রাণী?
Comments
Post a Comment