স্বদেশী আন্দোলন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ইফতার, উমর খালিদ ও রামনবমী
ভারী উৎসাহিত হয়ে ছেলেগুলো ভেবেছিল সত্যিই বুঝি বা অনুমতি মিলল রামনবমী পালনের। মানে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ভিতরে আর কি! সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল সৌরভ বোসের লেখা আবেদনপত্রে গত 12ই এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রাপ্তিস্বীকারের সিলমোহর। রেজিস্ট্রার ম্যাডাম 12 তারিখেই আবেদনপত্রে নোট দিয়েছিলেন প্রো ভাইস চ্যান্সেলরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, অতঃপর 15 তারিখের মিটিং’এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের 3 নং গেটের কাছে রামনবমী উদযাপনের মৌখিক অনুমতি ছেলেগুলোকে দিয়েছিলেন প্রো ভিসি। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হওয়া আবেদনপত্রের ছবির উপরে দৃশ্যমান ছিল প্রো ভিসির নোট— “রেজিস্ট্রার ম্যাডাম, প্লিজ ডু দ্য নিডফুল অ্যাজ ডিসকাসড্ ইন দ্য মিটিং”। এ হেন নোটে রামনবমী উদযাপনের অনুমতি যে দেওয়া হয়েছে তার ইঙ্গিত থাকলেও লিখিত উল্লেখ ছিল না। কিন্তু অনুমোদন-প্রার্থী ছাত্ররা সেই গ্লিচটিকে হয়ত গুরুত্ব দেয় নি, তারা প্রো ভিসির মৌখিক সম্মতিকেই গ্রহন করেছিল এবং তাদের দিক থেকে চিন্তা করলে সে-ই ছিল তাদের পক্ষে উচিত কাজ। ফলে গতপরশুদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক অংশ যখন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল, তখন তাদেরকে দমিয়ে দেওয়ার মত কোনো কথা বলতে চাইনি।
অতঃপর গতকাল সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হওয়ার মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন অন্যান্য ছাত্রদের ওজর, আপত্তি, অভিযোগ ও সাম্প্রদায়িক হুমকিকে কারণ হিসেবে দর্শিয়ে রামনবমী উদযাপনের নো অবজেকশন প্রত্যাহার করে নিল, তখনই স্পষ্ট হল যে, যে মৌখিক অনুমতিকে প্রবঞ্চনা বলে সন্দেহ হয়েছিল, তা আদতেই হয়ত প্রবঞ্চনাই ছিল, প্রকৃত অনুমোদন নয়।
গত কয়েক বছর যাবৎ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন এয়ার থিয়েটারে আয়োজিত হচ্ছে ইফতার পার্টি, বসছে নমাজ পাঠেরও আসর। কিন্তু সেসবের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হুমকি আজ পর্যন্ত কেউ দিয়েছে বলে জানা যায় নি। [ইফতার বা নমাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে হত না, শুরু হয়েছে অতি সাম্প্রতিক কালে গত মাত্র বছর কয়েক হল।] কিন্তু রামনবমী উদযাপনের বিরুদ্ধে এল সাম্প্রদায়িক হুমকি এবং সে হুমকির সামনে নতিস্বীকার করতে হল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও। কিন্তু প্রশ্ন — সাম্প্রদায়িক হুমকি দিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেরুয়া ইতিহাসকে মুছে ফেলা কি যাবে? স্বদেশী আন্দোলনের ইতিহাস এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনের উৎপত্তির ইতিহাস সম্পূর্ণ গেরুয়া যাতে রক্তবর্ণের ছিটেফোঁটা মাত্রও নেই। রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক, ব্রজেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী, রাসবিহারী ঘোষ, সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষদের উদ্যোগ ও আদর্শে 1905-1906 সালে গড়ে তোলা এ হেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার পালন করলে আর রামনবমী উদযাপনের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হুমকি দিলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গেরুয়া অন্তঃকরণটিকে চিরস্থায়ীভাবে বদলে দেওয়া কি যাবে? দখলদারদের দখলদারির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বোধের আভাস বুঝি বা!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার আয়োজনের হোতা বোধ করি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ডিপার্টমেন্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাতাসে কান পাতলে এই ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে শোনা যায় নানাপ্রকার অভিযোগ এবং নজিরবিহীন নিয়োগ দুর্নীতির রাজ্যে গত বেশ কয়েক বছরে এই বিভাগে এবং অন্যান্য নানা বিভাগে সংখ্যালঘু ছাত্রদের সবিশেষ উপস্থিতি সেই সব অভিযোগের ও সন্দেহের ভিতকে মজবুত করে। এঁদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের মধ্যে অন্যতম প্রধান অভিযোগটি হল পিছনের দরজা দিয়ে ছাত্র ভর্তির সূত্রে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসকদের হাতে কালো টাকার ঢালাও জোগান এবং NGO-প্রফেসর-প্রশাসক নেক্সাসের মাধ্যমে সে টাকার তছরূপের অভিযোগ। বলাই বাহুল্য যে এমন সমস্ত অভিযোগ যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকার সম্ভাবনাই অধিক। সেক্ষেত্রে এ হেন ইফতার পার্টি আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার কাজটি হয়ত সারছে কোনো না কোনো NGO'ই এবং তার দ্বারা কোনো বিশেষ রিলিজিয়নের প্রচার-প্রসারের কাজ যদি হতে থাকে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, তাহলে এহেন NGO'গুলির অ্যাকাউন্টে ফাণ্ডের অভাব হবার কথা নয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে এমন সমস্ত অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন রয়েছে। মানি লন্ডারিং’এর অভিযোগের তদন্ত আবশ্যক, বিশেষতঃ রাজ্যটি যেখানে পর্বত প্রমাণ আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।
প্রশ্ন রয়েছে আরও কয়েকটি। সম্প্রতি দেখা গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং'এর দেওয়ালে দেওয়াললিখন— We the people of India. মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী উক্ত বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়ী বলেন যে দেশের সংবিধানের প্রিঅ্যাম্বলটিকে
ছাত্রদের মনে গেঁথে দিতেই এমন উদ্যোগ। তাছাড়াও রয়েছে অযোধ্যায় রাম জন্মস্থানে পূর্বে উপস্থিত বিতর্কিত কাঠামোটির সপক্ষে বেশ কিছু দেওয়াল লিখন এবং সেই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি কুৎসিত কিছু গালিগালাজ। যাঁরা ওসব লিখেছেন সাম্প্রদায়িক গালিগালাজকে তাঁরা “ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন” বলে মনে করেন কি না তা অবশ্য বিভাগীয় প্রধানের কাছ থেকে জানা যায় নি।
JU ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ডিপার্টমেন্টের দেওয়ালে এ হেন “We, the people of India” লেখাটির কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল যখন গত সপ্তাহে দিল্লির কারকরডুমা আদালতে শুনানি হচ্ছিল দিল্লি দাঙ্গা কেসের পরিপ্রেক্ষিতে উমর খালিদের জামিনের আবেদনের। শুনানিতে প্রকাশিত হয়েছে যে কিভাবে দিল্লির নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের এবং শাহীনবাগের প্রতিবাদে অংশ নেওয়া লোকেদের ওয়াটস্অ্যাপ চ্যাটের মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল উমর খালিদ এবং ঘটিয়েছিল হিন্দুঘাতী এক ভয়াবহ দাঙ্গা। সেখানেও উমর খালিদের এক ওয়াটস্অ্যাপ গ্রুপের নাম ছিল “হম ভারত কে লোগ”, অর্থাৎ কি না “উই দ্য পিপল্ অফ ইন্ডিয়া”—
সন্ত্রাসবাদী উমর খালিদের ওয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ডিপার্টমেন্টের দেওয়াল কি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে পাঠক? না হওয়াই অস্বাভাবিক। ফেলুদা হলে হয়ত বলত, “খটকা লাগছে রে তোপসে” আর ব্যোমকেশ হলে নিশ্চয়ই ঘরে ঢুকে দোর দিত বেশ অনেক ঘন্টার জন্য।
2020 সালের জানুয়ারি মাসে এই উমর খালিদ এসেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও যার ঠিক পরের মাসেই সংঘটিত হয় দিল্লি দাঙ্গা যাতে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে উমর খালিদ (কোর্ট প্রসিডিং’এর ডকুমেন্টস্ থেকে সেরকমই মনে হয়) আর সে বছর সেপ্টেম্বর মাসেই ইউএপিএ আইনের আওতায় গ্রেফতার হয় সে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্রদের কাছে CAA ও NRC বিরোধী ভাষণ দিয়েছিল উমর খালিদ এবং সেই মিটিং’এ উপস্থিত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত কাশ্মীরী ছাত্ররাও। [আজকাল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে অনেক কাশ্মীরী ছাত্রও। এমনকি স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গেও জড়িয়ে ছিল একজন জম্মুর ছাত্র।]
CAA ও NRC'র বিরোধিতা করার গণতান্ত্রিক অধিকার মানুষের আছে, তা অন্যায় নয়। কিন্তু প্রতিবাদের নামে পাবলিক প্রপার্টি ধ্বংস করে, জনজীবন বিপর্যস্ত করে হিন্দুঘাতী নরসংহারের পরিকল্পনা করার অধিকার? সে কি কারুর আছে? আর সে হেন নরসংহারের ঠিক আগের মাসেই উমর খালিদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার ঘটনাটি? এতকিছু একসঙ্গে কাকতালীয় হওয়া সম্ভাবনা কতখানি? যা বলতে চাইছি তা হল এই যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রামনবমী উদযাপনের বিরুদ্ধে কম্যুনাল থ্রেট দিল যারা, ওপেন এয়ার থিয়েটারে গত বছর তিনেক যাবৎ ইফতার পার্টি ও নমাজের আয়োজন করছে যারা, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ডিপার্টমেন্টের দেওয়ালে “উই দ্য পিপল্ অফ ইন্ডিয়া” এবং কুৎসিত সাম্প্রদায়িক গালিগালাজ লিখল যারা, মন বলছে দিল্লি দাঙ্গার অন্যতম মূল অভিযুক্ত উমর খালিদের সঙ্গে একখানি সংযোগ তাদের আছেই। দিল্লি দাঙ্গার সংঘটনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট NGO'গুলির ভূমিকা কি? দাঙ্গার ঠিক আগের মাসে যোগেন্দ্র যাদবকে সঙ্গে নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এসেছিল উমর খালিদ? দাঙ্গা সংঘটনার্থে অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে কি? এ রাজ্যে কার্যরত কোনো NGO কি অর্থ সাহায্য করেছিল তাদেরকে? প্রশ্ন অনেক। অর্থাৎ রামনবমী উদযাপনের মৌখিক অনুমোদন প্রত্যাহারের ঘটনাটিকে হালকাভাবে নিলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের আপাততঃ চলবে না।
https://www.facebook.com/share/p/6azdwtDgq2sJZ5vo/?mibextid=oFDknk
Comments
Post a Comment