পশ্চিমবঙ্গে ভোট প্রহসন: পশ্চিমা ডিপ স্টেটের থাবা

পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচনের ফলাফল নিয়ে এ রাজ্যের তথা ভারতবর্ষের অন্যত্রও বহু মানুষ চূড়ান্ত হতাশ। গোটা ভারতবর্ষ যদি পারে তাহলে এ রাজ্য পারবে না কেন, এই প্রশ্নই হয়ত তাড়িয়ে ফিরছে সকলকে। অথচ 2021'এর নির্বাচনের পরে একটি ভিডিওর মাধ্যমে ফেসবুকে বলেছিলাম যে অন্য সব কিছু একই ভাবে চললে (i.e. every other factor remaining constant) বর্তমান শাসক দলকে ভোটে হারাতে বিজেপি কোনোদিনই পারবে না। বিজেপি এক্ষেত্রে বহু সহস্রাব্দ প্রাচীন বৈদিক তথা সনাতন ভারত সভ্যতার গরিমা উপলব্ধি করা তথা ভারতবোধ সম্পন্ন একখানি রাজনৈতিক দলের প্রতীক মাত্র। দলটি বিজেপি না হয়ে অন্য কোনো দলও হতে পারে যদি ভারতবোধ সম্পন্ন এ হেন নতুন কোনো দলের নব উত্থান হয়।


অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের নকশালপন্থী শাসক দলটিকে ভোটে হারিয়ে ভারতপন্থী কোনো দল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতালাভ করতে ততদিন পারবে না যতদিন পর্যন্ত ১) নির্বাচনী পদ্ধতি ২) গণনা পদ্ধতি ও ৩) রাজ্য প্রশাসন, এই তিন-ই অপরিবর্তিত থেকে যায়। অনেকে ভাবছেন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে ক্রিমিনালদের জেলে পুরে কেন্দ্রীয় বাহিনী অথবা আর্মি দিয়ে ভোট হলেই বুঝি বা ফলাফল বদলাবে। বাস্তব হল, যদি রাজ্য প্রশাসন অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে সেরকমভাবে ভোট হলেও পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ফল বদলানো অতি দুরূহ তথা প্রায় অসম্ভব।


এসব কথা বলার উদ্দেশ্য পাঠককে হতাশ করা নয়। বরং বলা হচ্ছে যে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখতে হবে যে এ রাজ্যে কলকাঠি নাড়ছে বহির্শত্রু ডিপ স্টেট। তারা কবজা করেছে এ রাজ্যের প্রশাসনকে যারা এ রাজ্যের ভোটার তালিকা অনুযায়ী ভোটের ফলাফলের একখানি ফর্ম্যাট রেডি করে ফেলেছে যে তালিকা এক্সিস্টিং ভোটার মারা গেলেও তারা বদলাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে না সেই তালিকা অনুযায়ী ভোটের পূর্ব নির্ধারিত ফলাফলও। ফলে বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে আদত ভোটার কারা, তারা কিভাবে ভোট দিচ্ছে, কাকে দিচ্ছে সে সব কোনো ফ্যাক্টর হচ্ছে না। চাকরির পরীক্ষা তথা ইন্টারভিউ হওয়ার আগেই যদি কাকে সিলেক্ট করা হবে তা ঠিক করা থাকে তাহলে যেমন হয় আর কি! 


এবং এ হেন তৈরি করা ফলাফলের সঙ্গে মানুষের বাস্তব প্রতিক্রিয়া যাতে খুব বেশি বেমানান না হয়, সেই জন্যই ভয় দেখানো হচ্ছে মানুষকে যাতে অতিরিক্ত দুঃসাহসী হয়ে নিজেদের পছন্দে ভোট দেওয়ার জন্য উতলা তারা হয়ে না ওঠে। অন্যদিকে, গত বিধানসভা ভোটে মানুষ নিজেদের পছন্দে ভোট দেওয়ার জন্য সেই প্রকার উতলা হয়ে উঠেছিল বলেই রাজ্য জুড়ে চালানো হয়েছিল ভয়াবহ, অবর্ণনীয় হিংসা যে হিংসা নিয়ে এক লাইনও লেখে নি NYT, WAPO'র মত পশ্চিমী মিডিয়া। ব্যাপারটা সিরিয়াস। অর্থাৎ 2021'এর ভোট পরবর্তী হিংসা আদতে হয়ত ছিল এ রাজ্যে ডিপ স্টেটের নখের আঁচড় এবং এ বিষয়ে যে ছোট বইখানি তাড়াহুড়ো করে লিখে ফেলেছিলাম, তার নামও দিয়েছিলাম অনুরূপ। "বঙ্গে নির্বাচনোত্তর হিংসা: একুশ শতকে ভারত আক্রমণ"— যত সময় যাবে মানুষ হয়ত এমন নামকরণের সারবত্তা ক্রমশঃ উপলব্ধি করতে পারবেন। 


এ রাজ্যের সমাধান আসতে হবে বৈশ্বিক স্তরের রাজনীতির পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট থেকে। একখানি বিশ্বযুদ্ধ থেকে এ রাজ্যের পতনের শুরু। আর একখানি যুদ্ধ পরিস্থিতির উদ্ভব না হওয়া পর্যন্ত এ রাজ্যের দুর্গতির অবসান হবে বলে মনে হয় না।


তবে এ লেখা এতদূর পর্যন্ত পড়ে যদি মনে হয় যে যুদ্ধ পরিস্থিতির উদ্ভব না হওয়া পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সমস্যার সমাধানের কোনো পথই নেই, তাহলে তা সর্বৈব ভুল। আগেই বলেছি যে মানুষকে হতাশ করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং পশ্চিমবঙ্গ সমস্যার সমাধানের সুস্পষ্ট পথনির্দেশ রয়েছে ভারতের সংবিধানের মধ্যেই এবং তা প্রয়োগের ক্ষমতাও রয়েছে ভারতীয় সংসদেরই হাতে যে পথ গ্রহন করলে তাতে নাক গলানোর এক্তিয়ার ভারতের সুপ্রিম কোর্টেরও নেই। এমন দাবী অবিশ্বাস্য মনে হলেও এ দাবীর ভিত্তি সম্পূর্ণ সাংবিধানিক। কি সেই পদ্ধতি তা নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল কোথাও না কোথাও। 


কিন্তু সে হেন সমাধান প্রয়োগের কথা ভাবতে কেন্দ্রীয় বিজেপি যে চাইছে না তার কারণ হয়ত এই যে, যে অপরাজনীতির সুবিধা এ রাজ্যে নিয়েছে বামফ্রন্ট এবং তৎপরবর্তীকালে নিয়ে চলেছে মমতার আড়াল থেকে নকশালপন্থীরা, সেই একই সুবিধা ক্ষমতার হস্তান্তরের পর হয়ত নিতে চায় বিজেপিও। পশ্চিমবঙ্গ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করে বিজেপির নেতাদের ব্যক্তিগত লাভ তথা পার্টিগত লাভের সম্ভাব্য সেই সুযোগকে হুগলী নদীতে বিসর্জন দিতে হয়ত না চায় পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির নেতারা, না চায় তাদের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। যত যা-ই হোক্, শেষ পর্যন্ত বিজেপিও একটি রাজনৈতিক দল বৈ তো নয়! রাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করার পাশাপাশি নিজেরা লাভের গুড় খাওয়ার জন্য দু'একটি রাজ্যের মানুষের স্বার্থ বিসর্জন দিতে পিছপা তারা হবেই বা কেন? বরং তারাও ধৈর্য্য ধরে না হয় অপেক্ষাই করবে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য! 


কিন্তু যে বিষয়টি আন্দাজ করতে বিজেপির নেতারা হয়ত পারছেন না (আবার হয়ত বা পারছেন) তা হল এই যে, বাংলাদেশ, মায়ানমার আদি দেশের উপর থেকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ডিপ স্টেটের থাবা আলগা না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ বা ভারতীয় জাতীয়তাবোধের কথা মুখে বলা কোনো দলের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে পারাই সম্ভব বলে প্রতীত হয় না। ফলে যে বিজেপি নেতারা গোঁফে তেল মেখে বসে আছেন (if any, যদি এমন নেতা পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিতে কেউ থেকে থাকেন) যে পাকা কাঁঠাল যখন তাঁদের হাতে আসবে তখন বামফ্রন্ট ও নকশালিদের কায়দায় তাঁরাও সে কাঁঠাল পশ্চিমবঙ্গের পাবলিকের মাথায় ভেঙ্গেই তারিয়ে তারিয়ে খাবেন, তাঁদের বোঝা প্রয়োজন যে কাঁঠাল খাওয়ার বাসনা ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গকে বহির্শত্রুর থাবা মুক্ত করার নিঃস্বার্থ ও ঐকান্তিক প্রয়াসে না ঝাঁপালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতা লাভ করার আশা মরীচিকা হয়েই রয়ে যাবে চিরকাল এবং বিজেপি নেতাদের কাঁঠাল খাওয়ার আশাও আদতে পূর্ণ হবে না কোনোদিনই। 


শেষ করার আগে আরও একবার পুনরাবৃত্তি করা প্রয়োজন যে বর্তমান নির্বাচনী পদ্ধতিতে এবং বর্তমান রাজ্য প্রশাসনের সাহায্যে নির্বাচন করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দলকে সরানোর কোনো সম্ভাবনাই যে নেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেন তা উপলব্ধি করার প্রয়াসটুকু অন্ততঃ করেন। তাহলেই রাজ্যের এক একটি নির্বাচনী ফলাফল দেখে অপ্রত্যাশিতভাবে হতাশ হওয়ার ভার বহন করতে তাদের আর হবে না।

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?