ও'গো' রাজনীতি
হঠাৎ গোরু কেন? ভারতবর্ষে তো অনেক সমস্যা। দারিদ্র, অনাহার, গৃহহীনতা, বেকারি ইত্যাদি! এই এত কিছু ছেড়ে হঠাৎ ভারতসরকার গোরু নিয়ে পড়ল কেন? গো মুখ্যু নাকি? আরে ছোঃ! ওই হিঁদুয়ানী দেখায় আর কি! গোরু খাওয়া বারণ করে দেবে। মুসলমানদের ভাতে মারবে। ওদের তো গোরু ছাড়া চলে না, ভারতবর্ষে থাকতে গেলে গোরু গিললে চলবে না। গোরুকে হিঁদুরা 'মা' বলে, পুজো পার্বনে পঞ্চগব্য খেয়ে শুদ্ধ হয়। সেই 'মা' কে কি কেটে খাওয়া চলে? তাই এই রাম বিজেপি হিঁদুয়ানী সরকার ভারতবর্ষে গোরু খাওয়া বারণ করে দিয়েছে।
না গো-রাজনীতির রিয়েলপলিটিকো কারণ এতটা সহজ সরল নয়। এবং এ ও নয়, যে ভারতসরকার গোমাংস কেনা, বেচা এবং খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। না, মোটেই তা করেনি। কেরালা হাইকোর্ট যথার্থ বলেছেন, কোন বারণ নেই। তাহলে ব্যাপারটা কি? এত 'গবেষণা', গবাবেগ কিসের? দুঃখের কথা হল, গো-রাজনীতির আসল কারণ এই পোড়া পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করতে চাইছে না। এমনকি শ্রী সুকান্ত চৌধুরী স্যারও যখন ৩রা জুন, ২০১৭'র আনন্দবাজার পত্রিকায় 'গরুর উপর রচনা' শীর্ষক লেখাটি লিখলেন, তখন তিনিও আসল কারণ খোলসা করলেন না। বোঝাতে চাইলেন যে এই গো সচেতনতা আসলে ধর্মান্ধত্ব। বাঙালীদের মধ্যে এমন প্রচার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে বলে ওঁদের ধারনা এবং ভুল নয়। বাঙালীদের উত্তরভারতীয় গো-বলয় সংস্কৃতির প্রতি উন্নাসিকতা সর্বজনবিদিত। আমার মতে উন্নাসিকতা থাকুক বা না থাকুক, তথ্যগতভাবে এবং উপলব্ধি ও অনুধাবনের দিক থেকে বাঙালী যাতে পিছিয়ে না থাকে।
আমার মতে রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতির ময়ূরকে ব্রহ্মচারী বলে দাবী করা এবং ময়ূরী কোন যৌনসঙ্গম ছাড়া ময়ূরের অশ্রুজল পান করে গর্ভবতী হয় বলা আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীর ভারতবর্ষের বর্তমান 'গো রাজনীতি'কে 'রামেদের অসার ধর্মান্ধতার প্রকাশ' বলে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা আসলে একই মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ। যদিও এইরকম একটি বিশ্বাস বাঙালীদের মনে গেঁথে দেওয়ার একটি পূর্ণ 'মমতাময়' প্রয়াস সরকার, এবং সংবাদমাধ্যম, দুই দিক থেকেই রয়েছে। কেন রয়েছে, সে আলোচনায় পরে আসব।
মনে রাখতে হবে গবাদি পশু হল, গো-ধন অর্থাৎ তারা অর্থকরী প্রাণী। চলুন দেখা যাক, যে গো-রাজনীতির আসল কারণ ধর্মান্ধতা নয়, বরং কেবলই এবং দৃঢ়মূলভাবে অর্থনৈতিক। গোরুর রূপ ধরে ভারতবর্ষের অনেক 'সাদা টাকা' বেআইনি পথে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পাচার হয় এবং মাংসে পরিণত হয়। সেই মাংস বাংলাদেশে বিক্রি হয় এবং বেআইনি ভাবে অতি সস্তাদামে এ রাজ্যেও বিক্রি হয়। বাংলাদেশে পশু ও মাংস বিক্রি করে পাচারকারীরা যে টাকা পায়, সেই টাকা 'কালো টাকা' হিসাবে আবার ভারতবর্ষে ঢোকে এবং ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিতর কালো নগদের জোগান ক্রমশঃ বাড়িয়ে দিতে থাকে, এবং তার দ্বারা ঘটায় মুদ্রাস্ফীতি এবং কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি।
গোরুপাচার এবং গোমাংসের বেআইনি উৎপাদন দিনের পর দিন ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দিচ্ছে এবং দিয়েই চলেছে। আর এই পাচারদ্বারের নাম হল পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তই সেই এক বিরাট খোলা দরজা যা দিয়ে আমাদেরই দেশের কিছু অবিমৃশ্যকারী, বিশ্বাসঘাতক লোক দেশের গো-ধন বিদেশীদের হাতে তুলে দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়ে নিজেদের পকেট ভরছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশীদের জন্য জুগিয়ে যাচ্ছে গোমাংসের জোগান। চোরাই গোরু, মোষের মাংস, ফলে বাংলাদেশীরাও তা পাচ্ছে সস্তায়। অর্থাৎ প্রতিবেশীর অর্থনীতিকেও আমাদের দেশের বিশ্বাসঘাতকরা পরোক্ষভাবে চাঙ্গা করছে।
কখনও আবার গোরু ও গোমাংস বিক্রির টাকা, 'কালো নগদ' হিসেবে ভারতবর্ষে না ঢুকে, 'বেআইনি অস্ত্র' হিসেবে এদেশে ঢুকছে। চলে যাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে, ব্যবহৃত হচ্ছে আমাদেরই দেশের, অথবা অন্য কোন দেশের নিরীহ মানুষদের মারতে! অর্থাৎ গোরু শুধু গোরু নয়, বিপদ নিশ্চয়।
সেই কারণে ভারতসরকার প্রথমে চালু করেছে গোরুর আধার কার্ড অর্থাৎ পরিচয়পত্র। যাতে দেশের গো-ধন চিহ্নিত থাকে, যাতে কেউ কোন স্বেচ্ছাকৃত বিশৃঙ্খলা তৈরী করতে না পারে। অর্থাৎ কোন গোরু, কার গোরু, কোথাকার গোরু এইসব নিয়ে যাতে কোন ধন্ধ না থাকে। এইবার সরকার নোটিফিকেশন দিয়েছে যে আন্তঃরাজ্য সীমান্তের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে কোন গবাদি পশুর হাট বসতে পারবে না এবং খাটাল মালিকরা এইরকম খোলা হাটে বা বাজারে যদি নিজেদের গবাদি পশু বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসেন, তবে তাঁদেরকে পশুর এবং নিজের, এমনকি ক্রেতারও আধারকার্ড বা পরিচয়পত্রসহ এই স্বীকারোক্তি সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে দিতে হবে যে সে ওই গবাদি পশু বিক্রি করছে কেবলমাত্র কৃষিক্ষেত্রে কাজে লাগানোর জন্য, মেরে মাংস করার জন্য নয়।
অর্থাৎ যদি গবাদি পশুর মালিক তার গো-ধনকে মেরে মাংসে পরিণত করতেই চায়, তবে তাকে নিয়ে যেতে হবে দেশেরই, সরকার নির্দিষ্ট বৈধ কসাইখানায়। এবং সেখানে উৎপাদিত মাংস দেশের মাটিতে করসহ সঠিক দামে বিক্রি হবে অথবা রপ্তানী হবে এবং ভারতসরকার মাংসরপ্তানীর দ্বারা প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারবে। অর্থাৎ মাংস বিক্রি করা বারণ নয়। বৈধ দামে সরকারকে কর ফাঁকি না দিয়ে, দেশকে না ঠকিয়ে মাংসের ব্যবসা করায় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। এই হল সরকারী উদ্দেশ্য।
এই উদ্দেশ্য মন্দ কিসে? দেশ যে তার অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রতিরোধ করতে চাইবে, এই কি স্বাভাবিক নয়? অর্থাৎ ভারতসরকার নিষেধাজ্ঞা নয় কিছু নিয়মানুবর্তিতা চালু করতে চাইছে যা কিনা দেশেরই অর্থনীতির অনুকূল। একবার ভেবে দেখুন দেশের মাটিতে জন্ম নিয়ে দেশের টাকায় লালন পালন করে যে গবাদি পশুকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা হল, তার অর্থকরী মূল্যের একটা বিরাট অংশ কেবল বিনামূল্যে বা নামমাত্রমূল্যে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে! দেশ তার অর্থকরী মূল্যের সম্পূর্ণটা পাচ্ছে না অথচ প্রাণীটির জীবনের পিছনে যা অর্থ ব্যয় হয়েছে, তা এ দেশেরই টাকা। এই চূড়ান্ত আর্থিক ক্ষতি কি কোন রাষ্ট্র মেনে নেয়, না নেওয়া উচিত?
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। আমাদের দেশে গবাদি পশুর ব্যবহার মূলতঃ তিন প্রকার। কৃষিক্ষেত্রে, দুধের ব্যবসায় এবং মাংস উৎপাদনে। খাটালগুলি দুধের ব্যবসায় গবাদিপশুগুলিকে ব্যবহার করে। যখন কোন গোরু বা মোষ তার প্রজনন ক্ষমতার শেষভাগে পৌঁছয় এবং আর তত দুধ দিতে পারে না, তখন খাটালমালিকের পক্ষে সেই পশুটির পালন ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে এবং সেই তুলনায় পশুটি দুধের ব্যবসায় আর তত অর্থকরী থাকে না। তখন সে ওই গবাদিগুলিকে কিছু দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। ভারতবর্ষে গবাদি ব্যবসার প্রায় ৪০% আসে অদোহনযোগ্য গবাদিপশুর বিক্রয় থেকে। এই সব দালালেরা খুব চটপট গবাদিগুলিকে কিনে নেয়, খাটালমালিককে চটপট দাম দিয়ে দেয় এবং গবাদিগুলিকে তুলে দেয় বেআইনি চোরাপাচারকারীদের হাতে। খাটালমালিকের টাকা আটকে থাকে না, চটপট তারা তাদের অদোহনযোগ্য গবাদির বিক্রয়মূল্য আবার বাজারে বিনিয়োগ করে। তাদের টাকা বাজারে ক্রমাগত roll করতে থাকে!
সারা ভারতবর্ষের এই পাচারকারীরা এই গবাদিগুলিকে পাচার করে দেয় পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে।
সবচেয়ে ভয়ানক এবং ঘৃণ্য ব্যাপার হল, কেনা এবং পাচারের পর বিক্রি এবং হত্যার এই মধ্যবর্তী সময়টুকুতে পাচারকারীরা পশুগুলিকে নরক যন্ত্রণার মধ্যে রাখে। যেহেতু গবাদিগুলিকে মেরে মাংস করা হবে, ফলে যতক্ষণ তারা জীবিত থাকে ততক্ষণও তাদেরকে মৃত বলেই ধরে নেয় তারা এবং তাদের জন্য কোন অর্থব্যয় করতে চায় না। পশুগুলিকে না খাইয়ে, অল্প জায়গায় অকথ্যভাবে গাদাগাদি করে, অভুক্ত, যন্ত্রণাক্লিষ্টভাবে রাখে এবং সময় বুঝে একদিন পাচার করে দেয় ও কেটেও ফেলে। এই অমানবিক আচরন শুধু গবাদি নয়, কোন প্রাণীর প্রতিই করা যায় কি? জীবিত প্রাণীগুলিকে ভক্ষ্য মাংস বলে ভাবা এবং তাদের প্রতি সামান্য যত্নও না নেওয়া, খাদ্য পর্যন্ত না দেওয়া, এ কি সহনীয়? না কি সহ্য করা উচিত? যে কারণে, সার্কাসে বন্য প্রাণীর ব্যবহার ও চোরাশিকার নিষিদ্ধ হয়েছে, সেই একই কারণে গবাদি পশুর পরিচালনও কি সঠিক ও মানবিক পদ্ধতিতে হওয়া উচিত নয়?
সেই কারণেই ভারতসরকার খোলা বাজারে জবাইয়ের জন্য গবাদি বিক্রয় বন্ধ করার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। কিন্তু সঠিক পদ্ধতিতে, দেশকে না ঠকিয়ে মাংস উৎপাদনে কোন নিষেধ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হল এই বিধি রাজ্যসরকারগুলি নিজেদের সুবিধানুযায়ী প্রয়োগ করতে পারবে, কেন্দ্র কোন চাপাচাপি এই বিষয়ে রাজ্যের উপর করবে না। ফলে এতে ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের নিয়ম লঙ্ঘিত তো হচ্ছেই না, বরং তা আরও বেশি করে মান্যতাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
আর একটি বিষয় হল স্বাস্থ্যসংক্রান্ত। বেআইনি ব্যবসায়ীরা গবাদিগুলিকে পাচারের বা জবাইয়ের আগে এমন নির্মম, বুভুক্ষু ও অস্বাস্থ্যকরভাবে রাখে, গবাদিগুলি এত অসুস্থ হয়ে পড়ে, যে সেই প্রাণীর মাংসও হয় অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর এবং ক্ষতিকর। সেই মাংস স্বাভাবিকভাবে খুব সস্তাও হয়, ফলে দেশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষ সেই মাংস খায় এবং নানা রোগেও আক্রান্ত হয় এবং সেই সব রোগ বহনও করে। সরকারি গবাদিবিধি যদি রাজ্যসরকারগুলি মান্য করে, তবে এই সস্তার অস্বাস্থ্যকর গোমাংস অচিরেই দেশে সহজে পাওয়া যাবে না। এখন প্রশ্ন হল, এই গরিবলোকগুলি তাহলে খাবে কি? তাঁদেরকে বিকল্প খাদ্য বেছে নিতে হবে বইকি! অনেকেই একে গরিবমানুষের পেটে টান দেওয়া ও খাদ্যের অধিকার হরণ করা হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা করছেন। কিন্তু তাই কি? সস্তায় রসনাতৃপ্তির জন্য দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের সঙ্গে আপোষ করা চলে কি? যাঁরা রোগাক্রান্ত হন, তাঁরা কিন্তু না চাইতেও সমাজে অন্যান্য মানুষের মধ্যেও রোগ বিস্তার করেন। সেটি কি প্রতিরোধ করা উচিত নয়? কাঁচা খাদ্যসামগ্রীর মাননির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করা, বিশেষতঃ আমিষ খাদ্যের, অত্যন্ত উপযোগী সরকারি পদক্ষেপ কারণ সঠিকমানের খাদ্যসামগ্রীই পারে মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষা করতে এবং স্বাস্থ্য যেকোন দেশের মানুষের প্রধান সম্পদ। স্বাস্থ্যের জন্য রসনার সাথে প্রয়োজনে আপোষ করতে হয় বৈ কি!
আর একটি কথা বলি। যে গবাদিগুলি অবৈধভাবে মাংসে পরিণত হচ্ছিল, সেগুলিকে যদি সঠিক ভাবে সংরক্ষন করে দেশের বৈধ কসাইখানাগুলিতে সঠিক উপায়ে এবং সঠিক সময়ে মাংস করা হয়, তবে বৈধ ও স্বাস্থ্যকর মাংসের জোগান দেশের বাজারে ধীরে ধীরে বাড়বে, ফলে উৎকৃষ্ট মাংসের দাম, যা এখন বেশী এবং গরিব মানুষের নাগালের বাইরে, তা ধীরে ধীরে কমবে এবং তাদের নাগালের মধ্যেও আসবে। আর সরকারও খানিক নিশ্চিন্ত হতে পারবে যে যতটুকু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তা উৎকৃষ্ট মানের।
একথা ঠিক যে আদর্শগতভাবে বিজেপি গোমাংস বিরোধী। কিন্তু দল ও সরকার দুটি আলাদা সত্তা। (পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পক্ষে অবশ্য এটা বুঝতে পারা দুরূহ কারণ গত চল্লিশ বছর ধরে আমরা দেখছি, দলই সরকার) এবং বর্তমান ভারতসরকার এটা জানেন এবং মানেন যে ভারতবর্ষে নানাসংস্কৃতির মানুষ বাস করেন। ভারতের অর্থনীতিও বহুমাত্রিক। অতএব নিজেদের ধর্মীয় আদর্শের খাতিরে দেশের এত অসংখ্য মানুষের প্রয়োজন, পছন্দ এবং জীবিকার উপর হস্তক্ষেপ করবে, দল হিসেবে এত অবিমৃশ্যকারী আমার বিজেপিকে মনে হয় না। গত তিন বছরে বিজেপির ফিসক্যাল নীতি যথেষ্ট সময়োপযোগী ও নির্দিষ্ট দিশা সম্পন্ন, যদিও তাদের সামাজিক বিধি কখনও কখনও বেশ গোলমেলে এবং বাঙালী মননের পরিপন্থী। কিন্তু বর্তমান ভারতবর্ষ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে তার fiscal reforms এর প্রয়োজন সর্বাগ্রে। এবং সেই জন্যই বিজেপির কার্যবিধির দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যায়। তবে একথাও সত্যি ভারতবর্ষে বিরোধী রাজনীতি বর্তমানে কেবলই অন্তঃসারশূন্য, সুবিধাবাদী ও পরিবারবাদী বা ব্যক্তিস্বার্থনির্ভর! এবং সেই বিভীষিকাময় সুবিধাবাদীদের নেতিবাচক রাজনৈতিক চাল ও আক্রমণগুলিকে প্রতিহত করতে গিয়েও বিজেপি'র অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ বাধাপ্রাপ্ত এবং অযথা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যেমন GST ১লা এপ্রিল থেকে চালু করা গেলেই সবচেয়ে ভালো হত ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে। কিন্তু তা সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করা যায় নি। এমন হীন মানের বিরোধী রাজনীতি যে কোন গণতন্ত্রের পক্ষে সমূহ বিপদ।
তবে একথা সত্যি যে ভারতসরকারকে গবাদিপশুগুলির সংরক্ষন ও যথাযথ যত্নের সুবন্দোবস্ত করতে হবে এবং পরিকাঠামো অনেক বাড়াতে হবে যাতে গবাদি ব্যবসায়ীরা যখন সরকারী, বৈধ সূত্রে কোন দালাল ছাড়া সরাসরি স্টেট লাইভস্টক বোর্ড এবং ডেয়ারি কো-অপারেটিভের মাধ্যমে গবাদি কেনাবেচার কাজ করতে যাবে, তখন যাতে তাদের দ্রুত পরিসেবা দেওয়া যায়, যাতে তাদের টাকা অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটকে না থাকে এবং তার ফলে সাধারন ক্রেতার জন্য দুধের যাতে অযাচিত মূল্যবৃদ্ধি না ঘটে! দেশে উপযুক্ত পরিকাঠামোসহ গোশালার সংখ্যাও আরও বেশি বাড়ানো উচিত। উপরন্তু সরকারের পক্ষ থেকে গবাদির জন্মহার, মৃত্যুহার ও গড় আয়ুর তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন যে আমাদের দেশে বছরে ঠিক কত গো-ধনের প্রয়োজন হয়। গবাদির সংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটলেও কিন্তু গবাদিবিধি অর্থহীন হয়ে পড়বে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ খর্ব হবে। অতএব সরকারের কাছে অনুরোধ, নিয়মবিধি চালু করুন, কিন্তু সাথে গবাদি-ব্যবসায়ীদের উন্নততর সুযোগসুবিধাও প্রদান করুন, যাতে গবাদিব্যবসা প্রথম দিকে কিছু অসুবিধার মধ্যে পড়লেও, খুব শিগ্গির তা সামলে নিতে পারে! ততদিন পর্যন্ত না হয় ভারতবর্ষের গবাদি পরিচালন ব্যবস্থা কিছু অসুবিধা নিয়েই কাজ চালিয়ে যাবে।
আর একটি কথা। তথাকথিত গো-রক্ষকদের উপরেও কড়া নজর রাখা উচিত ভারতসরকারের। এরা কারা? গো-রক্ষক না মানব-ভক্ষক, সেটা নিশ্চিত করতে হবে এবং এই ব্যাপারে রাজ্যসরকারগুলির উপর নির্ভর করে লাভ নেই। কারণ রাজ্য সরকারগুলো, বিশেষতঃ অবিজেপিশাসিত রাজ্য সরকারগুলো যে এই বিষয়টির নেতিবাচক রাজনীতিকরণ করবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত বলা যায়!
এবার আসি এই লেখার শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাগে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে দিয়েছেন যে কেন্দ্রের গবাদিবিধি এই রাজ্যে তিনি মানবেন না। যেহেতু এই বিধি মানা বা না মানার সিদ্ধান্তটি কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির শুভবোধের উপরেই ছেড়ে রেখেছে, ফলে মমতা প্রত্যাশামতই সেই সুযোগের পূর্ণ অসদ্ব্যবহার করতে ছাড়বেন না, ঘোষণা করেছেন। স্বাভাবিক। এবার আসুন ভাবা যাক, এই না মানার পরিণতি কি হতে পারে! এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে গোরুমোষ কেনাবেচা যেমন অবৈধ দালালদের মাধ্যমে সরকারকে কর ফাঁকি দিয়ে কিন্তু দলীয় তোলাবাজদের তোলা দিয়ে চলছিল তেমনই চলবে। অর্থাৎ রাজ্যসরকার রাজস্ব হারাবে কিন্তু 'ভাই'দের অবৈধ সম্পদ অর্থাৎ 'কালো টাকা'র জোগান বজায় থাকবে। তৃণমূলের ক্ষতি নেই, রাজ্য-কোষাগারের ক্ষতি। তাছাড়া বেআইনি গবাদি-জবাইও চলবে, ফলে সস্তা, নিম্নমানের গোমাংসের জোগান পশ্চিমবঙ্গের বাজারে যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। ফলে রাজ্যের গরিব মানুষের স্বাস্থ্য-অবস্থারও কোন উন্নতি হবে না!
দ্বিতীয়তঃ পশ্চিমবঙ্গের আন্তর্জাতিক সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে যদি গবাদি হাট বসা এবং গবাদি পাচারে নিয়ন্ত্রণ জারি না করা হয়, তাহলে বাকি ভারতবর্ষে এই নিয়ম মানা বা না মানা সমান কথা। কারণ গোটা দেশেরই গবাদিপাচার হয় পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আন্তর্জাতিক সীমান্ত আছে জম্মুকাশ্মীর, পঞ্জাব, রাজস্থানের ও উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির। এগুলির কোনটি দিয়েই গবাদিপাচার হয় না। ফলে, উত্তরভারতের অন্য রাজ্যগুলি যদি গবাদিপাচার রুখতে চায়, তবে তাদেরকে তাদের রাজ্য ও পশ্চিমবঙ্গ বা পশ্চিমবঙ্গের নিকটতম রাজ্যের যেমন বিহার, ঝাড়খন্ড বা ওড়িশা বর্ডার সীল করে দিতে হবে। কারণ ভারতবর্ষের সব রাজ্যের গবাদিই বাংলাদেশে পাচার হয় পশ্চিমবঙ্গ হয়ে। এ ঘটবেই, কারণ অন্য রাজ্যগুলি যদি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তাদের নিকটতম সংযোগ বন্ধ না করে, তবে, কেন্দ্রসরকারের নতুন গবাদিবিধি বিষয়টাই অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে।
এর ফলে, পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং এ রাজ্যের পাচার-অনাচার-সংস্কৃতি ক্রমশঃ পশ্চিমবঙ্গকে সাংস্কৃতিকভাবে বাকি ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে একাত্ম করে তুলবে। বাংলাদেশী মোল্লারা যে আশায় মমতার উপর রাজনৈতিক বিনিয়োগ করে বসে আছে যে একদিন শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গও তাদের হবে এবং ইসলামিক হবে, সেই আশা, একটু একটু করে পূর্ণতার পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। যে বিষাক্ত বিভাজনের ধারা এতদিন তিরতির করে বইছিল, একদিন তা সমস্ত পশ্চিমবঙ্গকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, যদি না পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ রুখে দাঁড়ায়। এবং সে আশা কম! কারণ বাম-সংস্কৃতি এরাজ্যের মানুষের চিন্তনক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছে। মানুষ আর দূর পর্যন্ত দেখতে পায় না। তাই গো-রাজনীতি তাঁদের উন্নাসিক অথচ অগভীর মনের মধ্যে উত্তরভারতীয়দের নিয়ে ঠাট্টাতামাশার হাল্কা বিষয় হয়েই থেকে যাবে যতদিন না আসে হিন্দু বাঙালীর পূর্ণ ধ্বংস! শেষের সেদিন বড় ভয়ংকর!
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteআপনার সাথে কি কখনো কথা বলা যাবে | বাঙালি হিন্দুদের উন্নতির জন্য কিছু কথা ছিল |
ReplyDeleteআমি একটা সংগঠন বানাতে চাইছি বাঙালি হিন্দুদের উন্নতির জন্যে | ব্যবসা ,
উর্বরতার হার হার সব কিছু নিয়ে বাঙালি হিন্দুদের সাহায্য করা হবে | আপনার সাথে একটু কথা বলতাম | আপনার ফোন নম্বর তা কি পাওয়া যাবে |