সাম্প্রদায়িকতা: প্রকৃতপক্ষে কি? (শেষ পর্ব)


সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে লিখতে লিখতে, তিনটি পর্ব লিখবার পর এই বিষয়টিতে ছেদ পড়ে। অন্য নানা বিষয় অত্যন্ত বেশী করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ফলে এই বিষয়টা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টি আসলে আমাদের বর্তমান সময়ের একটি highly palpable issue. একে এড়িয়ে যাওয়া চলবে না!সাম্প্রদায়িকতা যে মানবতা-বিরোধী কোন ধারণা নয়, তা প্রদর্শন ও প্রমাণ করার সময় এসেছে! এখনই সেই সময় যখন নিজেদের সাম্প্রদায়িকতাকে রক্ষা করার জন্যই আমাদেরকে অন্য সকল সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতাকে মেনেও নিতে হবে, অথচ সাম্প্রদায়িকতার অপব্যবহারের দ্বারা নিজের পছন্দ অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে যাওয়ার অসভ্যতাটি করলে চলবে না। আবার অন্য কোন সম্প্রদায় যদি এই একই ভুল করতে যায়, তবে তাদেরকেও থামাতে হবে। এখনই সেই সময় যখন সভ্যতা আমাদের কাছ থেকে আমাদের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তা, শ্রেষ্ঠ মানবিকতা, পূর্ণ পুরুষকার ও পূর্ণ যৌক্তিক আচরন দাবী করছে।


আগেই লিখেছিলাম, সাম্প্রদায়িকতা সভ্যতারই অনিবার্য পরিণাম। সাম্প্রদায়িকতা is nothing other than categorization of human beings based on different parameters. সেই parameter গুলি আলাদা আলাদা হতে পারে, কিন্তু categorization অবশ্যম্ভাবী। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা একটি অপরিহার্য বিষয়।


এমনকি বন্ধুত্বও এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতাই। তা যদি না হত, তাহলে best friend বলে কিছু থাকত না। সবাই সবার একই রকম বন্ধু হত।


কিংবা ধরুন একদম সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রধানতঃ গোর্খা অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ী অঞ্চলে বাংলাভাষাশিক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে চালু করার জিগির তুলতেই প্রায় সব বাংলাভাষাপ্রেমী বাঙালীরা যেভাবে এককাট্টা হয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে সমর্থন করলেন, তা-ও কিন্তু সাম্প্রদায়িকতারই প্রদর্শন। ভাষা সাম্প্রদায়িকতা। আবার উল্টোদিকে পাহাড়ীরাও একই ভাষা সাম্প্রদায়িকতা প্রদর্শন করলেন বাংলাভাষার বিপক্ষে ও নেপালীভাষার স্বপক্ষে। আমার বক্তব্য হল, এই সাম্প্রদায়িক অনুভূতিটি অতি স্বাভাবিক এবং অতি মানবিক। কিন্তু যা অনুচিত, তা হল, যৌক্তিকতার বাইরে বেরিয়ে সাম্প্রদায়িক অনুভূতির প্রয়োগ-আগ্রাসন। অর্থাৎ আমি বাংলাভাষার স্বপক্ষে সাম্প্রদায়িক অনুভূতি পোষণ করি বলেই পাহাড়ীদের ভাষা-সাম্প্রদায়িকতাকে আমিই প্রথম সহানুভূতি জানাবো এবং এমন কোন 'মজ্ঝিম পন্থা' অবলম্বন করব যাতে উভয় জাতিরই সাম্প্রদায়িক অনুভূতির সংরক্ষন সম্ভব হয়। অর্থাৎ একটা win-win পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, যাতে পশ্চিমবঙ্গে থেকে সকলে বাংলাও শেখে, আবার নিজের মাতৃভাষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যকরী ভাষাও।


আমার উপলব্ধি হল, সাম্প্রদায়িকতার মানবিক অনুভূতি ভিন্ন, মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষই হয়ে উঠতে পারে না।




এবার আসি এই লেখার শেষ এবং আসল ভাগে। সাম্প্রদায়িকতা যদি খারাপ না-ই হবে, তাহলে সাম্প্রদায়িকতা শব্দটিকে এত সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয় কেন? বিশেষতঃ হিন্দুধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে? এর কারণ অতি গূঢ়, মনস্তাত্ত্বিক। অনেক তলিয়ে দেখলে দেখবেন, সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির সঙ্গে আমরা অভেদার্থকভাবে সংযুক্ত করি মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক চেতনাজনিত আগ্রাসন ও সন্ত্রাসকে। সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি শোনামাত্র আমাদের অবচেতনে ভেসে ওঠে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের কথা। এবং তাতেই তীব্র ঘৃণায় কেঁপে ওঠে আমাদের অন্তর্মন। সাম্প্রদায়িকতা তাই এত ন্যক্কারজনক আমাদের কাছে। সাম্প্রদায়িকতা ও ইসলাম আমাদের অবচেতনে সমার্থক।




আমাদের conscious mind কিন্তু সবসময় তা মনে করে না। বরং যারা তথাকথিত লিবারেল বা মুক্তমনা, তারা সাম্প্রদায়িক বলতে RSS, BJP কে বোঝে। তারা বরং ইসলামি সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনকে 'স্বাভাবিক' বলে মেনে নিয়েছে। তাঁদের ভাবধারায়, তাঁদের মনের ভিতরকার অনুচ্চারিত (কখনও বা সোচ্চার) কথাগুলি হল, 'মুসলমানরা তো অমনই, তা বলে আমরাও 'সাম্প্রদায়িক' হব?' খেয়াল করুন এখানে 'সাম্প্রদায়িক' বলতে 'সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন'কে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। অর্থাৎ আমরা হিন্দুরা আমাদের অবচেতনে নিজেদেরকে মুসলমানদের থেকে পৃথক ও উৎকৃষ্ট মানুষ বলে দৃঢ়মূলভাবে বিশ্বাস করি। এবং সেই জন্যই নিজেদের সাম্প্রদায়িক অস্তিত্ব জানান দিতে লজ্জা বোধ করি। কারণ আমাদের মনে সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ করার মত নিম্নমানের কাজ করে মুসলমানরা। আমাদের কি তা সাজে? "কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়। তা বলে কুকুরে কামড়ানো কি রে মানুষেরে শোভা পায়?" সেই কারণেই কোন রাজনৈতিক দল যখন হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার কথা উচ্চারন করে, তখন মুক্তমনা হিন্দুরাই সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। তাঁদের নিজেদের দৃষ্টিতে নিজেরাই ছোট হয়ে যান তখন। অবচেতনে ধাক্কা লাগে, 'আমরা কি মুসলমান যে সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের উগ্র প্রকাশ করতে যাব?'




ভেবে দেখুন, আসলে এ হল নিজেদের অবচেতনে মুসলমানদের প্রতি তীব্র অনীহা ও frustration. সেই কারণে, নিজেদের সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের কোন আচরনের সঙ্গে যদি মুসলমানদের কোন আচরনের বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য তাঁরা শনাক্ত করতে পারেন, তাহলেই তীব্র ঘৃণায় কুঁকড়ে যান তাঁরা। কোনমতেই মুসলমানদের মত হতে চান না। তাহলে ভেবে দেখুন, এই মুক্তমনারা কি নিজেদের অজান্তেই নিজেদের অবচেতনে মুসলমানদের অপাংক্তেয় করে রাখেন নি? রেখেছেন বলেই তাঁরা মুসলমান-পন্থ অবলম্বন করতে চান না। তাঁরা 'সাম্প্রদায়িকতা'কেই ঘৃণা করেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা সাম্প্রদায়িক-অনুভূতির প্রয়োগকে ঘৃণা করেন কারণ তাঁদের অবচেতনে সাম্প্রদায়িকতা=সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন = মুসলমান। অথচ মুসলমানদের তাঁরা এতটাই খরচের খাতায় রেখেছেন যে তাদের কোনপ্রকার সংশোধন সম্ভব বলে লিবারেলরা বিশ্বাস করেন না।
কিন্তু অমুসলমানদের উপর তাঁদের ভরসা আছে। অমুসলমানদেরকে তাঁরা মানুষ বলে মনে করেন। সেইজন্যই তাঁরাও যদি কখনও নিজেদের সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের প্রদর্শন বা প্রকাশ করতে যান, তখনই লিবারেলরা নানা বক্রোক্তি, ব্যঙ্গোক্তি, সমালোচনা, শ্লেষ ইত্যাদির দ্বারা তাঁদেরকে বিদ্ধ করতে ও থামাতে চান। অনুচ্চারিত ভাবখানা হল, "তোমরা তো মুসলমান নও, তবে এমন মুসলমানী চাল কেন?"


মুক্তমনা হিন্দুরা এই কারণেই সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী। তাঁদের নিজেদের কোন আচরন যদি তাঁদের মনের অতি গভীরে 'মুসলমানসুলভ' বলে প্রতিভাত হয়, তবে তাঁরা লজ্জায় সংকুচিত হয়ে পড়েন, নিজেদের সাথেই নিজেরা চোখ মেলাতে পারেন না। কোন মতেই তাঁরা মুসলমানের সঙ্গে তুলনীয় হতে চান না। না নীতিগতভাবে, না আচরনগতভাবে।




এ হল মুসলমানবিদ্বেষের তীব্রতম মনস্তাত্ত্বিক manifestation. মুক্তমনা হিন্দুরা, যাঁরা আপাতদৃষ্টিতে কট্টর হিন্দুত্ববিরোধী, তাঁদের প্রকৃত বিরোধ হিন্দুত্বের সঙ্গে নয় বরং কট্টরতার সঙ্গে কারণ কট্টর ধর্মীয় পন্থাটির উপর এই পৃথিবীতে মুসলমানরাই patent নিয়ে বসে আছে। সেই কারণেই উগ্র হিন্দুদের প্রতি মুক্তমনা হিন্দুদের এত রাগ। এ এক গভীর গোপন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। মুক্তমনা হিন্দুরাই মুসলমানদের প্রতি প্রকৃত অর্থে অসহিষ্ণু।




হয়ত বলবেন, তা কি করে হয়? লিবারেলরা তো মুসলমানদের বন্ধু, ওঁরা সব একসাথে মিলে গোমাংসও খান। মুসলমানদের প্রতি অসহিষ্ণুই যদি হবেন, তবে লিবারেলরা তাদের সাথে ওঠাবসা, খাওয়া দাওয়া করেন কি ভাবে? সাধু সাবধান! এ বিদ্বেষ সে বিদ্বেষ নয়। যে বিদ্বেষ উপর থেকে দেখেই বিদ্বেষ বলে চেনা যায়, তা সহজ বস্তু, সে বিদ্বেষভাব নাশ করাও তেমন দুরূহ নয়। কিন্তু যে বিদ্বেষের মূল গভীর অবচেতন মনে প্রোথিত, তাকে কি চিনতে পারা অত সহজ? প্রায়শঃ তেমন বিদ্বেষকে অভিন্নহৃদয়তা বলেও মনে হতে পারে! আমি একটি জটিল মনস্তত্ত্বের কথা বলছি। বর্তমানে লিবারেলরা আপাতদৃষ্টিতে মুসলমানদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন কারণ শত্রুতা করার মত আরও বহু ধরনের মানুষ ও ভাবধারাকে বর্তমান পৃথিবীতে খুঁজে পান লিবারেলরা। তাছাড়া মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ মনোভাবকে তাঁরা হয়ত মনে মনে ভয়ও পান। তাই তাঁরা মুসলমানদের চটাতে চান না।




কিন্তু মনে করুন যদি কোনদিন এমন এক পৃথিবী সৃষ্টি হয় যেখানে বাস করে শুধু দুই ধরনের মানুষ, কম্যুনিস্ট ও মুসলমান। কি হবে তখন? তারা কি পরস্পরকে সহ্য করতে পারবে না কি দুই সম্পূর্ণ সমমনস্ক আগ্রাসী শক্তি পরস্পরকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়ে উভয়েই বিনষ্ট হবে? যাক্ গে সেই ভয়াবহ পৃথিবীর কথা না ভাবলেও চলবে!




বরং কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে মুসলমানের প্রতি শত্রুভাব যতটা, বিদ্বেষ তেমন নেই। কট্টর হিন্দুরাই বরং মুসলমানী আগ্রাসী নীতিকে সরাসরি পাল্টা আগ্রাসী নীতি দিয়ে টক্কর দিতে চায়। অর্থাৎ মুসলমানদেরকে তাঁরা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মানটুকু দেন। কিন্তু মুক্তমনা হিন্দুরা মুসলমানদের উপেক্ষা করতে চান, সর্বদা তাদেরকে প্রীতি বিতরণ করার মাধ্যমে মুসলমানদের তাঁরা প্রকৃতপক্ষে এড়িয়ে চলতে চান। মুসলমানদের তাঁরা নিজেদের অবচেতনে মানুষ বলেই মনে করেন না। তাই মুসলমানরা যত অন্যায়ই করুক, লিবারেল হিন্দুরা সাধারনতঃ তার প্রতিবাদ করেন না।  কিন্তু হিন্দুরা তাঁদের সাম্প্রদায়িকতার কথা বললেই লিবারেলদের মুখে ব্যঙ্গোক্তির ছুরি! হিন্দুরা সাম্প্রদায়িকতার কথা বললেই লিবারেলদের কাছে তা হল 'পেছন দিকে হাঁটা'!




আমার এই সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ক লেখা পড়ে এক সম্মানীয় বন্ধু আমাকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী প্রশ্ন করেছেন। সাম্প্রদায়িকতা যদি অনস্বীকার্যই হবে, তবে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি যেমন বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, RSS... এরা কি তাহলে ভুল নয়? এরা কি ঠিক? এরা তো কখনও কখনও রীতিমত নীতিপুলিশি করে, নিজেদের ধ্যানধারনা অন্য সবার উপর জোরপূর্বক চাপাতে চায়। গোবর, গোমূত্র, গর্ভসংস্কার, এসব কি অন্যায় নয়? আগ্রাসন নয়? কে কি খাবে, কে কি পরবে, তা বলে দেওয়ার ওঁরা কারা?




এর উত্তরে প্রথমে বলা প্রয়োজন যে RSS একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। দেশের বিপদে আপদে স্বয়ংসেবকরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। উদ্ধার, ত্রাণ, যুদ্ধ, রাষ্ট্রবিপ্লবে RSS হল দেশের সেবায় নিয়োজিত। RSS হিন্দুত্ববাদীও বটে, কিন্তু তা theocratic হিন্দুত্ব নয়। RSS এর হিন্দুত্ব হল ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্কথা। এবার আসি উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কথায়। যেমন বজরং দল। এ বিষয়ে নিউটন সাহেবের তৃতীয় সূত্র বড় প্রাসঙ্গিক। সাম্প্রদায়িকতার নাম করে ইসলামের আগ্রাসন ও সন্ত্রাসবাদই উগ্র ও আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদের উত্থানের কারণ। প্রথমটি ক্রিয়া, দ্বিতীয়টি প্রতিক্রিয়া। অতএব ক্রিয়াটিকে থামাতে না পারলে, প্রতিক্রিয়া থামাবেন কেমন করে, ভাই?
হ্যাঁ একথা ঠিক যে, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাও কখনও কখনও আগ্রাসী। কিন্তু হিন্দুধর্ম বা বৈদিক ধর্ম অতি উদার এবং আগ্রাসী নয়। একমাত্র হিন্দুধর্মই সেই ধর্ম যা সকলের অস্তিত্বকে তার নিজের মত করে স্বীকার করে। আব্রাহামিক ধর্মগুলো যেমন সকলকে নিজের ছাঁচে ফেলতে চায়। কিন্তু সনাতন ধর্মই এই বিশ্বাস বিতরণ করে যে প্রতিটি মানুষ ও প্রতিটি জীবের তার নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ সব  ধর্ম পরখ করে তবেই এই উপলব্ধিতে উপনীত হন যে 'যত মত তত পথ'। এই হল হিন্দুত্বের সার কথা। কিন্তু হিন্দুধর্মের এই সহনশীলতাকে, এই বহুমাত্রিকতাকে যদি কেউ ধর্মটির একটি অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বলে মনে করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ানোর নাম উদারতা নয়, কাপুরুষতা। "ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান, নীরব হয়ে, নম্র হয়ে পণ করিও প্রাণ!" হিন্দুত্বের নাম করে যাঁরা আদৌ আগ্রাসী হচ্ছেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম আগ্রাসনকে প্রতিহত করার জন্য সচেতনভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। অথচ তাঁদের উদ্দেশ্য দেশরক্ষা। পন্থা এক, উদ্দেশ্য ভিন্ন। ফলে হিন্দুত্ববাদীদের পাশে দাঁড়ানোই যায় কেবলমাত্র তাঁদের উদ্দেশ্যকে সমর্থন করি বলে!




আর তথাকথিত লিবারেলদের সমর্থন করিনা কারণ লিবারেলরা উন্নাসিক ও অবিমৃশ্যকারী। বিপদের সময় উন্নাসিকতা বিপদ বাড়াতে বই কমাতে পারে না। ঘোর সাম্রাজ্যবাদী ইসলামিদেরকে কেবল অগ্রাহ্য করে বা উপেক্ষা করে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।




হয়ত বলবেন, তাহলে আর আগ্রাসী ইসলামের সঙ্গে তাদের পার্থক্য হল কিসে? উভয়েই কট্টরবাদী, উভয়েই প্রবল আগ্রাসী! খেয়াল করলে নিশ্চয় বুঝবেন যে, তা সত্ত্বেও পার্থক্য একটা আছে। ইসলাম তার আগ্রাসন ছড়িয়ে দিচ্ছে গোটা বিশ্বে, আর উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা আগ্রাসী হচ্ছে তাদের নিজের মূল ভূখণ্ডটিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে। তফাৎ কি নেই এই দুই মানসিকতার মধ্যে? কখনও কি শুনেছি আমরা যে উগ্র হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা কোন বিদেশের মাটিতে গিয়ে মানব-হত্যা-যজ্ঞ চালিয়েছে অথবা অন্য কোন দেশ (যা তাদের মূল ভূখণ্ড নয়), দখল করার জন্য সন্ত্রাসবাদী গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে?




আগ্রাসী ইসলামের সঙ্গে উগ্র হিন্দুত্বের একটাই মূল ভিন্নতা। ইসলাম স্বতঃ আক্রমণাত্মক এবং উগ্র হিন্দুরা প্রতিক্রয়াশীল রক্ষনাত্মক। দুটোর ভিতর সাত মহাসাগরের ফারাক!




ঠিক যে কারণে ম্যানহাটন প্রজেক্টে নিউক্লিয়ার বম্বের ফর্মূলা আবিস্কৃত হওয়ার পর এক বিচক্ষণ বিজ্ঞানী সমগ্র মানবজাতির রক্ষার্থে সেই ফর্মূলা আমেরিকার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে লুকিয়ে তুলে দিয়েছিলেন রাশিয়ার হাতে, ঠিক সেই একই কারণে উগ্র ও আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদীদেরও প্রয়োজন আছে। সেই বিজ্ঞানী আমেরিকার সাথে 'বিশ্বাসঘাতকতা' করলেও, পূর্ণ মানবজাতির সঙ্গে কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন? তিনি কি আদৌ 'বিশ্বাসঘাতক'?




আমি হিন্দু হিসেবে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা প্রদর্শন করতে চাই নির্দ্বিধায়, কিন্তু নিজের সাম্প্রদায়িকতা অন্য কোন সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চাই না। এবং একইভাবে এ ও চাই না যে মুসলমান বা অন্য কোন সম্প্রদায় তাদের সাম্প্রদায়িকতাকে অজুহাত করে আমাদের বা অন্য কারুর উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করুক বা করার চেষ্টা করুক। সেই জন্যই প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্বের প্রয়োজন।  ইংরিজিতে একটা কথা আছে না? If you want peace, prepare for war!




বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ভারত-ভূখণ্ডে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের অস্তিত্ব অতি প্রয়োজনীয়, এ কথা অনস্বীকার্য। আমি বড় বেশী প্রাচীনপন্থী। অপেক্ষা করে আছি কবে ফিরে যাব সেই অতি অতি প্রাচীন কালে, যখন এই ভারত-ভূখণ্ডে ছিল দ্রাবিড় সংস্কৃতি, অবৈদিক সংস্কৃতি, তার পর উৎপত্তি হল বৈদিক ধর্মের, যখন ইসলাম তো ছেড়েই দিন, ইউরোপীয়ান শাখামৃগরাও সব গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়! সেই প্রাচীন হিন্দুধর্ম যা কিনা 'ধর্ম' কি এবং কি তার প্রয়োজনীয়তা, তাকেই সংজ্ঞায়িত করেছিল। এবং সেই যুগকে আজকের পৃথিবীর উপযুক্ত উপায়ে পুনর্স্থাপিত করতে গেলে আজকের এই হিন্দুত্ববাদীদের হাত ধরতেই হবে। হিন্দুরাই যদি না বাঁচে, তবে প্রাচীন ভারতবর্ষকে ফিরে পাব কিভাবে? আর সেই অতি প্রাচীন ভারতবর্ষের পুনর্স্থাপনা হলে না হয় লিবারেলদের সেখানেও আবার স্বাগত জানাবো।

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?