শাস্তির সমানাধিকার

এই জাগছে আমার ভারতবর্ষ। একটু একটু করে সরে যাচ্ছে কুয়াশার আড়াল। আমার স্বপ্নের দেশ। পথ যদিও অনেক বাকি সেই সোনার ভারতবর্ষে পৌঁছতে। তবু। এগোচ্ছে তো! ধীর পায়েও যদি হয়। এই ভারতবর্ষ আমার নারী-পুরুষ সমানাধিকারের ভারতবর্ষ, আমার প্রকৃতই Equality of all এর ভারতবর্ষ।

স্বপ্ন দেখতে, প্রগলভ হতে বড় ইচ্ছা করছে যে আজ! এমনভাবেই ভারতবর্ষ একদিন গড়ে তুলবে তার সংবিধানের ১৫ নং ধারায় উল্লেখিত প্রকৃত discrimination-free society!

সুপ্রিমকোর্ট প্রশ্ন তুলেছেন, কোনো বিবাহিতা নারী যদি স্বামী ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তবে ব্যাভিচারের অভিযোগ শুধু পুরুষটির বিরুদ্ধে উঠবে কেন? শাস্তিই বা শুধু পুরুষটি একা পাবে কেন? সংশ্লিষ্ট আইনটি হল, IPC497.

IPC497 সম্বন্ধে SC র এই সমালোচনা ও প্রশ্ন যে existing ভারতীয় মানসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে আসলে বৈপ্লবিক, তা বুঝতে গেলে আমাদের জানতে হবে, আজ পর্যন্ত এই আইনটি কি বা কেমন?

IPC 497 অনুযায়ী বিবাহিতা নারী অন্য কোনো পুরুষের সাথে ব্যাভিচারিনী হলেও আইনের বিচারে সেই নারীকে ব্যাভিচারিনী আখ্যা দিয়ে তার সাজা হওয়ার কোনো ব্যবস্থা এই আইনে নেই। আইনটি অনুযায়ী ব্যাভিচারের অভিযোগে সাজা হয় সেই নারীর সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত পুরুষটির। অর্থাৎ? এক যাত্রায় পৃথক ফল! অপরাধ এক, অথচ আইনের চোখে মহিলাটি নিরপরাধ আর পুরুষ সকল দোষের দোষী।

আরও আছে। যদি দেখা যায় যে সেই অবৈধ সম্পর্কটিতে মহিলার স্বামীর সম্মতি আছে, তাহলে ব্যাভিচারের অভিযোগ এমনকি অন্য পুরুষটির বিরুদ্ধেও দাঁড়ায়ই না। ভেবে দেখুন এর তাৎপর্য। অর্থাৎ আমার জিনিস আমি অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দিয়েছি। এতে কারুর দিক থেকেই কোনো অন্যায় নেই। আর জিনিসটি তো পণ্যমাত্র, তাই তার perspective থেকে তো ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্নই নেই!

মহিলাদের পক্ষে চরম অপমানজনক এই আইনের অপব্যবহারও কম হয় না। মহিলারা ব্যাভিচারিনী হন, স্বামী বেচারা জানতে পারলেও চেপে যান, কারণ অসম্মান তাঁর আর শাস্তি অন্য পুরুষটির। অথচ প্রবৃত্তি প্রায়শঃই মহিলাটিরও কোনো অংশে কম থাকে না। অথচ আইনের দৃষ্টিতে তিনি immaterial.

এ-ই পুরুষতন্ত্র। নারীকে দোষের ভাগী করা মানেও নারীকে recognize করা, তার অন্যায় করার ক্ষমতাকে অন্ততঃ স্বীকৃতি দেওয়া। অর্থাৎ এর দ্বারা নারীর মনুষ্যসত্তাকে, তার পৃথক ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পুরুষতন্ত্র তা করতেও রাজি ছিল না এতকাল। নারী বাঁচবে পুরুষের ব'কলমে, এই ছিল স্বাভাবিক।

অথচ, on the other hand, কোনো বিবাহিত পুরুষ যদি নিজের স্ত্রী এর বিশ্বাসভঙ্গ করে অন্য কোনো অবিবাহিত মহিলার সঙ্গেও অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হন, সেক্ষেত্রেও ব্যাভিচারের অভিযোগ উঠবে কেবলমাত্র পুরুষটির বিরুদ্ধে। একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া অবৈধ, তা সত্ত্বেও সেই অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার অপরাধে IPC497 এখনও পর্যন্ত মহিলাটির কোনো শাস্তিবিধান করে না।

মহিলা ব্যাভিচারিনী হলেও দোষ পুরুষের, পুরুষ ব্যাভিচারী হলেও দোষ পুরুষের। অর্থাৎ মহিলাদের কোনো অন্যায় হয় না। তাঁরা পণ্যমাত্র। তাঁরা যা-ই করুন, দোষ হবে পুরুষের। ধরে নেওয়া হবে যে অবলা, অবোধ নারী না বুঝে কেবলমাত্র একটি object এর মত পুরুষের দ্বারা অত্যাচারিত ও ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র।

গত মাত্র পরশুদিন, সুপ্রিমকোর্ট ধাক্কা দিয়েছেন নারীকে object ভাবার এই  মরচে ধরে যাওয়া জগদ্দল অচলায়তনে। মহামান্য আদালত তুলেছেন প্রশ্ন; কেন নারীরও হবে না শাস্তি?

বটেই তো! কেন ব্যাভিচারিনী নারীরও হবে না ব্যাভিচারী পুরুষের সমান শাস্তি? আর স্ত্রী অন্য কারুর সঙ্গে conjugal সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারবে কি না, সে সম্মতি দেওয়ার স্বামী কে? স্ত্রী তো তার সম্পত্তি নয়! অর্থাৎ? সমাজকে মিথ্যে চক্ষুলজ্জার ঘোমটা সরিয়ে খোলাখুলি দাঁড়াতে হবে সূর্যের মত উজ্জ্বল সত্যের সামনে। বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী সারাজীবন পরস্পরের প্রতি একনিষ্ঠভাবে conjugal সম্পর্কে আবদ্ধ থাকার শপথ নেয়। সেই শপথ যে-ই ভাঙ্গুক, সে-ই শপথভঙ্গের অপরাধে সমান অপরাধী। পড়ুক খ'সে ভণ্ডামির মুখোশ সমাজের মুখ থেকে। মুক্ত হোক নারী পুরুষের পরিচয়ের আড়ালে বাঁচার দুর্ভাগ্য থেকে। নাকি বলব বঞ্চিত হোক নারী পুরুষের আড়ালে বাঁচবার অবাঞ্ছিত ও সুবিধাবাদী সৌভাগ্য থেকে? নারী ভোগ করুক তাঁর নিজ কৃতকর্মের সুফল এবং অবশ্যই কুফলও। যেদিন থেকে মেয়েরা তাদের কৃতকর্মের জন্য আইনতঃ নিজেরাই দায়ী হবে, সেদিন থেকেই কমতে শুরু করবে তাদের ভুল করার হার, কমতে শুরু করবে নারীসুলভ vulnerability.

তথাকথিত নারীবাদীদের আমি বড় ভয় পাই, কারণ আমি চাই লিঙ্গহীন সমাজ, I look forward to having a genderless society. নারীর অধিকার বা পুরুষের অধিকার নয়, চাই মানুষের অধিকার। সমান; সব্বার জন্য। নারী, পুরুষ, বৃহন্নলা, রূপান্তরকামী নির্বিশেষে। আবার চাই দায়িত্বও সমান হোক সব্বার জন্য। আমি জানি প্রতিটি জীবন্ত শরীরের ভিতরের মানুষটা বাস করে তার মস্তিষ্কে, লিঙ্গে নয়। আমি এ-ও জানি যে অধিকারহীন দায়িত্ব অথবা দায়িত্বহীন অধিকার, দুই-ই সমান অর্থহীন!

অথচ আমাদের মহিলা সংরক্ষণ আইনগুলি সবই একপেশে রকমের পুরুষবিরোধী। আইনের দৃষ্টিতে নারী বেশ খানিকটা শিশুর মত, পণ্যের মতো। নারী অপরাধ করলেও ধরে নেওয়া হয় যে কোনো পুরুষ তাকে দিয়ে তা করিয়েছে। অর্থাৎ অপরাধের দায় নারীর নয়। নারী দেবী, নারী বস্তুমাত্র, সে কোনো অপরাধ করতেই পারে না। তার মস্তিষ্কের জ্যামিতিতে তৈরি হতে পারেই না অপরাধের কোনো জটিল নক্সা।

আর একটা উদাহরণ দিই! ৪৯৮A. বধূনির্যাতনবিরোধী আইন। বধূ বা বধূর হয়ে অন্য কেউ যদি আইনটির অপব্যবহার করেও স্বামী বা তার পরিবারের কারুর নামে পুলিশে নালিশ দায়ের করে, তাহলে সাম্প্রতিক অতীত কাল পর্যন্ত আইনটি এমন ছিল যে পুলিশের কর্তব্য ছিল বিনা প্রশ্নে, কোনো তদন্ত, কোনো জিজ্ঞাসাবাদ কিছুমাত্র না করে, অর্থাৎ অভিযোগটি সত্যি না মিথ্যা তা বিন্দুমাত্র যাচাই না করে তৎক্ষণাৎ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে লক আপ বন্দী করা। ভেবে দেখুন এই আইনের কি প্রচণ্ড অপপ্রয়োগ সম্ভব। স্বাভাবিকভাবেই বহু প্রকৃত নির্যাতিত বধূ এই আইনের কোনো সুবিধা যেমন পায় নি, তেমনই বহু 'দুষ্টপ্রকৃতি' বধূ স্বামী ও শ্বশুরবাড়ীকে 'বধ করতে' এই আইনের অপব্যবহার করতে পিছপাও হয় নি। অযৌক্তিক একপেশে এই আইনের অপব্যবহার করে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ীকে ঘোল খাওয়ানোর পর যখন প্রমাণিত হয়েছে যে শ্বশুরবাড়ী ও স্বামী নির্দোষ তখন তাঁদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু মিথ্যা অভিযোগ তুলে আইনের অপব্যবহারের দায়ে বধূটির কিন্তু কোনো শাস্তি হয় নি। বধূকে তেমন শাস্তি দেওয়ার কোনো provision ই আইনটিতে নেই।

অর্থাৎ এমন বীভৎস অন্যায় করে স্বামী, শ্বশুরবাড়ীর সম্মানকে জনসমক্ষে ধ্বস্ত করার পরও সংশ্লিষ্ট বধূটি আইনের দৃষ্টিতে দোষী সাব্যস্ত হয় না। কারণ? নারী নাকি অবলা। শরীরে, বুদ্ধিতেও। তারা নিজবুদ্ধিতে কিছু করতে পারে কি? পিছনে নিশ্চয় কোনো পুরুষ মস্তিষ্ক আছে এই হল assumption.

কিন্তু এমন assumption, এমন পক্ষপাতিত্বও যে নারীর মনুষ্যত্বের পক্ষে চরম অপমানজনক, নারীবাদীরা আজ অবধি সেই আওয়াজ তুলেছেন কি?

নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা, প্রকৃত সমান অধিকারের দাবী প্রতিষ্ঠিত হবে কিসে? যদি ভাবেন যে নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও স্বয়ংনির্ভরতার দ্বারা, তাহলে বলব, সে-ও  নয়। আর্থিক স্বাধীনতা অবশ্য প্রয়োজনীয় (necessary condition) ঠিকই কিন্তু যথেষ্ট (sufficient condition) নয়। কারণ আর্থিকভাবে স্বাধীন মেয়েকেও সমাজে সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে গেলে কোনো এক পুরুষের পরিচয়ের আড়াল লাগে। একা রোজগেরে মেয়েকেও বহু মানুষ বাঁকা চোখে দেখে, সুযোগ পেলে তাকে অপমান করতেও ছাড়ে না। যে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন একজন সাধারণ সাদামাটা পুরুষ পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে নিজের আত্মপরিচয়েই পেতে পারে, অনুরূপ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন একটি সাদামাটা মেয়ের পক্ষে পাওয়া দুরূহ। পদে পদে বাধা। অজস্র বাধা।

তাহলে? কি উপায়? আমার একান্ত ব্যক্তিগত ও humble opinion হল, যতদিন একপক্ষে দেশের সমাজ ও আইন মেয়েদের আইনতঃ 'দুধভাত', 'পুতুল', করে রাখবে, অথচ অপরপক্ষে একই সঙ্গে তাদের 'অধিকার' নিয়ে গলা ফাটানোর দ্বিচারিতা করবে, ততদিন আসবে না নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা! ততদিন নারী আসলে হয়ে থাকবে পুরুষের হাতে ক্রীড়নক মাত্র।

আমাদের সমাজ যতদিন পর্যন্ত না মেয়েদের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের দায়িত্ব সম্বন্ধেও সরব হয়ে উঠবে, ততদিন প্রকৃত নারীমুক্তি অধরাই থাকবে। নারীবাদীরা নারীর অধিকার নিয়ে যত কথা বলেন, তার একশ ভাগের এক ভাগ কথাও যদি মেয়েদের দায়িত্ব নিয়ে বলতেন, সমাজ বদলে যেত। কারণ মেয়েদেরকে সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল করে তোলার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত নারীস্বাধীনতা ও মুক্তির হদিশ।

পুরুষতন্ত্রকে আঘাত করতে চান? সামাজিক ও আইনগত স্বীকৃতিসহ পুরুষের দায়িত্ব share করতে চাওয়ার দাবী তুলুন।

সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। সাথে সাথেই পা বাড়িয়েছি আমরা একধাপ। নারীর প্রকৃত সামাজিক সম্মান অর্জনের দিকে। পা বাড়িয়েছি একধাপ উত্তর আধুনিক ভারতবর্ষের দিকে। ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। দেখার চোখ, বোঝার মন কি আমাদের তৈরি?

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

Karnataka Election Result 2023: Observations

এত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-খরা: কেন?