পশ্চিমবঙ্গ জিততে বিজেপিও কি শরণাপন্ন হবে রাজ্যের কৌশলী মুসলমান নেতৃত্বের?

রাজ্যের বিপন্ন গণতন্ত্র রক্ষার্থে ওঁরা করতে চলেছেন 'গণতন্ত্র বাঁচাও’ যাত্রা, commonly called ‘রথযাত্রা’। আর সাথে সাথে তার জবাবে এঁরা ঘোষণা করলেন ‘পবিত্র যাত্রা'। ওঁরা অর্থাৎ বিজেপি আর এঁরা অর্থাৎ তৃণমূল।

অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ‘পবিত্র’ শব্দটা type করার সঙ্গে সঙ্গে পরের শব্দের option এসে গেল কুরআন। Btw, এঁরা কি এই জন‌্যই ওঁদের রথযাত্রার জবাবী যাত্রার নাম ‘পবিত্র যাত্রা' দিয়েছেন? এঁরা কি রথযাত্রাকে একটা হিন্দু মিছিল বলে দাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এবং সেই জন্যই নিজেদের যাত্রার নাম পবিত্র কুরআন বা পবিত্র ঈদুল ফিতর বা ইত্যাদির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ‘পবিত্র যাত্রা' দিলেন?

কেন এই বিভেদ?

বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে নানা ভাবে। এরাজ্যের কট্টর হিন্দুত্বপন্থীদের একটা অংশ বলছেন যে বিজেপিও এ রাজ্যে কংগ্রেসের সেক্যুলার পন্থাই নিচ্ছে।(এখানে 'সেকুলার' বলতে ছদ্ম-সেকুলারিজম বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে।) এই কট্টর হিন্দুত্ববাদী বাঙালীদের অনেকেই কোনো এক কালে বামপন্থী ছিলেন। কিন্তু বামপন্থার ভণ্ডামি ও অন্তঃসারশূন্যতা অনুভব করে  বামপন্থাবিমুখ হয়েছেন বলেই হিন্দুত্বের বিষয়ে বর্তমানে বেশি কট্টর এবং বিজেপির থেকে সেই কারণে এঁদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এঁদের মধ্যে অনেকে আবার বাস্তবে তৃণমূলপন্থী কিন্তু মমতার মুসলমান তোষণে বিরক্ত। এঁরা যেহেতু মমতাকে পছন্দ করেন, তাই নিজেদের অবচেতনে হয়ত নিজেদের সঙ্গেই argue করেন যে বিজেপি যদি সম্পূর্ণভাবে হিন্দুত্ববাদী না হয়, বিজেপি যদি মুসলমানদের সামান্য পাত্তাও দেয়, তাহলে আর বিজেপি ও মমতার মধ্যে তফাৎ কি হল? এঁদের মতে, গত ৪০ বছরে এ রাজ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম যা কিছু হয়েছে, তার প্রায় সবই হয়েছে মুসলমান ভোটের কথা ভেবে। এই প্রথম বোধ করি, 'রথযাত্রা’ একটা হিন্দুত্বপন্থী activity হতে যাচ্ছিল। কিন্তু তারও অফিসিয়ালি একটা সেক্যুলার নামকরণ করতে হল? সে-ও কি সেই মুসলমান ভোটের কথা বিবেচনা করেই? তবে কি বিজেপিও মুসলমান ভোটের কথাই ভাববে? শুধু একটু ঘুরিয়ে ভাববে, এই মাত্র? সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপির একটি পার্টি মিটিং এর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যাতে বিজেপির কিছু সদস্য 'জয় শ্রী রাম' স্লোগান করার পর সংখ্যালঘু সদস্যরা ‘আল্লাহ হু আকবর' ধ্বনিও দিয়েছেন। বাঙালী কট্টর হিন্দুত্বপন্থীদের এটা ভালো লাগে নি। তাছাড়াও অনেকে আছেন, যাঁরা মুখে কিছু না বললেও বিষয়টা  তাঁদেরও আদৌ ভালো লাগে নি।

বাঙালী হিন্দুত্বপন্থীদের এই hypersensitivity অস্বাভাবিক নয়। কারণ এ রাজ্যে মুসলমান ভোট দখল করার জন্য যে পরিমাণ ভোট-ব্যবসা চলেছে এতকাল, এবং তার ফলে ইসলাম-আশ্রিত অপরাধ এ রাজ্যে যেভাবে বেড়েছে, তাতে হিন্দুত্বপন্থীরা শঙ্কিত ও ক্রুদ্ধ। দেশভাগের ক্ষত তাদের মনে দগদগে।

এ বিষয়ে আমার নিজস্ব, humble মতামত কিছু আছে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার কমবেশি ৩০%. এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নাম করে সিপিএম, তৃণমূল ভোট ব্যবসা চালিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার ফল সাধারণ মুসলমান বোধ হয় তেমন কিছু পায় নি। বরং পেয়েছে কৌশলী মুসলমান নেতৃত্ব এবং তাদের মাধ্যমে রাজ্যে ক্ষমতা ও স্বাধীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে জেহাদিদের।

তোষণ হয়েছে, পোষণ হয় নি।

বিজেপিকে যদি পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করতে হয়, তবে এটা ভাবা কি উচিত বা সঙ্গত হবে যে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন, অপ্রয়োজন, ভালো, মন্দ ইত্যাদির বিলকুল পরোয়া না করেই তাঁরা সরকার গড়বেন এবং চালাবেন? গণতন্ত্রের স্বার্থে সেটা অসম্ভব। 'সব কা সাথ, সব কা বিকাশ' করতে গেলে কোনো জনগোষ্ঠীকে বাদ দেওয়া চলে না। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও সত্য যে, যে প্রবল মুসলমান-তোষণ এ রাজ্যে এতকাল চলেছে এবং তার ফলে যেভাবে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ, ইসলাম-ধর্মীয় আগ্রাসন, জেহাদ ইত্যাদি, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে, তাতে সাধারণ মুসলমানের অবস্থার উন্নতি ঘটানোর নাম করে বিজেপিও যেন রাজ্যের সেই কৌশলী সংখ্যালঘু নেতৃত্বের খপ্পরেই পড়ে না যায় যারা কলকাতায় অসাংবিধানিক ও বেআইনি সভা করে মুসলমান পুলিশ কমিশনার দাবী করেছিল। মুসলমানরা যেহেতু রেজিমেন্টেড সম্প্রদায় এবং তাদের রেজিমেন্টেশনের ভিত্তি যেহেতু ধর্মীয়, ফলে তাদের ভালো করা আর ভালো করার নাম করে তাদের ধর্মগুরু বা মৌলবীদের তোষণ করতে শুরু করার মধ্যবর্তী line of demarcation টা খুব সূক্ষ্ম, কারণ মৌলবীরা এবং তাদের পেটুয়া কৌশলী নেতৃত্বও মুসলমান সমাজের অভিভাবকত্ব ছাড়তে চাইবে না, আর সাধারণ মুসলমানও এমন জীবনের কথা ভাবতেই পারবে না যে জীবনে এই 'অভিভাবক' দের  interference নেই।

এই নেতৃত্বই 'আশরাফাইজেশন' এর নামে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ বাঙালী মুসলমানদেরকেও আরবী রীতি রেওয়াজ, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে গণতন্ত্র ও ভারতীয়ত্বের স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রথম কাজ হওয়া উচিত পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের ভারতীয় সংস্কৃতিতে আত্তীকরণ। তাঁদের উপাস্য ঈশ্বরের নাম ‘আল্লা’ হোক্, তাঁরা উপাসনা 'আল্লা'রই করুন, কিন্তু মন, সংস্কৃতি, পোশাক, ভাষা ভারতীয় হোক্। ভারতবর্ষ বহুত্বের দেশ। মুসলমানদেরকেও সেই বহুত্ববাদকে সম্মান করতে হবে। সেই অর্থে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রায় সম্মিলিত হতে তাঁরা না-ই চাইতে পারেন, কারণ সে রথ হিন্দুর ধর্মীয় উৎসবের রথ। কিন্তু ‘গণতন্ত্র বাঁচাও’ যাত্রার রথে তাদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। বিজেপি যদি পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষের মন জয় করতে চায়, তবে তাকে সাধারণ মুসলমানের মধ্যে এই সচেতনতাই তৈরি করতে হবে যে তার ধর্ম যা-ই হোক, তার অন্তরাত্মা, তার সংস্কৃতি ভারতীয়। ভারতীয়ত্বের সঙ্গে তার সংস্কৃতির কোনো বিরোধ নেই।

তা না করে বিজেপি যদি এ রাজ্যে তার পূর্ববর্তী রাজনৈতিক দলগুলির মত সংখ্যালঘু নেতৃত্বের সাথে PACT করে মুসলমান ভোট আদায় করে ভোটে জেতার খেলায় মাতে, তাহলে বিজেপির লাভ হলেও পশ্চিমবঙ্গের কোনো লাভ হবে না। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মুসলমানের তাতে কোনো লাভ হবে না আর বাঙালী হিন্দুর সঙ্কটও মিটবে না। গফুর মিঁঞা আর রামা কৈবর্ত যে তিমিরে সে তিমিরেই থেকে যাবে। জল্পনা উসকে দিয়েছে একটি সংবাদ যাতে উত্তর দিনাজপুরের ইমামরা জানিয়েছেন যে মমতা দেবীকে তাঁরা আর সমর্থন করবেন না। এ সম্ভবতঃ তাঁদের দিক থেকে নতুন negotiation এ ঢুকতে চাওয়ার একটি সিগন্যাল। অবশ্য ইমামদের চাপে মমতা দেবী আরও বেশি কিছু ও আরো ভয়ঙ্কর কিছু পাইয়ে দেবেন ওঁদের, এমন হওয়াও খুবই সম্ভব। সেক্ষেত্রে ভোটের মেরুকরণ আরও বেশি হবে এবং অমুসলমান ভোটের বেশিরভাগই বিজেপির ঝুলিতে যাওয়ার সম্ভাবনা।

বিজেপির জন্ম এই পশ্চিমবঙ্গে। তাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ভারতীয় জনসংঘের স্থাপনাকালে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মূল agendaই ছিল nation-building অর্থাৎ জাতির গঠন এবং সমস্ত অহিন্দুদের ভারতীয়করণ, অর্থাৎ ভারতীয় ভাব ও সংস্কৃতিতে তাদের সম্পৃক্ত করা।

এ হেন এক রাষ্ট্রপুরুষের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠতে হবে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিকে। অতএব শুরু হোক্ যাত্রা। এক জেহাদ মুক্ত, উন্নত, কর্মব্যস্ত, গণতান্ত্রিক পশ্চিমবঙ্গের দিকে, যে পশ্চিমবঙ্গ সকল ধর্মাবলম্বীর, কিন্তু কেবলমাত্র তাদের জন্যই যারা মনে, প্রাণে, চিন্তায়, পরিচয়ে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে, ভাবধারায় খাঁটি ভারতীয়।

ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর nation-building এর এই স্বপ্নটিকে সাকার করে দেখাতে হবে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিকে।



Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কোভিশিল্ড কাহিনী

নব্য কথামালা: শেয়াল ও সারসের গল্প

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?