'পাঠান': মাটিতে ব্যর্থ কাগজে সফল

একে 26 শে জানুয়ারি তায় সরস্বতী পুজো। নিউটাউন অ্যাক্সিস মল 'বায়োস্কোপ'এ গতকাল ছিল প্রচুর ভিড়। যে কেউ যে কোনো সময় সিনেমা হলে এলেই যেন পাঠান দেখতে পারে সে বন্দোবস্ত পাকা করার জন্য 'বায়োস্কোপ'এ চলছে পাঠানের সতেরোটি শো। একটি শো শুরু হচ্ছে সকাল দশটায় তো দ্বিতীয় শো সাড়ে দশটায়, তারপর এগারোটা, বারোটা, বারোটা পঁয়তাল্লিশ, একটা পনেরো, একটা পঁয়তাল্লিশ, সাড়ে তিনটে, চারটে, চারটে পঁয়ত্রিশ, ছ’টা কুড়ি, ছ’টা পঞ্চাশ, সাতটা পঁচিশ, ন’টা দশ, ন’টা চল্লিশ, দশটা, দশটা কুড়ি ইত্যাদি মোট সতেরোটা। এ হেন 'বায়োস্কোপ'এ স্ত্রী’কে নিয়ে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন ‘প্রজাপতি’র টিকিট কাটতে। কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল যে টিকিট কাটবেন চারটে। কিন্তু ‘প্রজাপতি’র শো হাউসফুল, তাই টিকিট কাউন্টার থেকে তাঁদেরকে সাজেস্ট করা হল ‘পাঠান’ দেখতে। অর্থাৎ হল মালিকদেরকেও দেখা গেল ‘পাঠান’ 'পুশ' করতে। সে যাই হোক, সামান্য গাঁইগুঁই করে ভদ্রলোকও রাজী হয়ে গেলেন 'পাঠান' দেখতে। স্ত্রী’কে বললেন “বাড়িতে ফোন করে মা’কে বুঝিয়ে বলো যে 'প্রজাপতি'র নয় পাওয়া গিয়েছে একটা হিন্দি সিনেমার টিকিট, কিন্তু ভালো সিনেমা”। অতঃপর টিকিট কাটতে গিয়ে ভদ্রলোক দেখলেন যে 'পাঠান'এর টিকিট আছে ঠিকই কিন্তু আছে কেবলমাত্র একদম সামনের সারিতে। ভিতরের দিকেও কিছু আছে, কিন্তু একটানা চারটি সিট খালি নেই অন্য কোনো সারিতেই। এইটি শুনেই চমকে উঠলাম।


চমকে ওঠার কারণ ছিল। 25শে জানুয়ারি, বুধবার, ‘পাঠান’ রিলিজের দিন রাত্রিবেলায় “বুক মাই শো”তে ‘পাঠান’এর স্টেটাস চেক করতে গিয়েও সব হলে দেখেছিলাম এই একই চিত্র। এক সঙ্গে শহরের সমস্ত হলে (উইদাউট আ সিঙ্গল এক্সেপশন) 'পাঠান'এর টিকিট অ্যাভেইলেবল কেবলমাত্র সামনের সারিতে? এ কি করে হতে পারে? এমনটা কি কাকতালীয় হওয়া সম্ভব? মন বলছিল এ নিশ্চয়ই কোনো ম্যানিপুলেটিভ টেকনিক। কেবলমাত্র সামনের সিট খালি আছে দেখলে মানুষ হয়ত ভাববে মুভিটির ক্রেজ খুব বেশি, ফলে তৎক্ষণাৎ সামনের সারির টিকিট হয়ত কাটবে না কিন্তু আগে ভাগেই বুক করে রাখবে দু’দিন বাদের টিকিট এবং তার দ্বারা শুক্রবার বা তার পরেও মুভিটি হয়ত কিছু দর্শক পাবে। কিন্তু এই টেকনিক প্রয়োগ করতে শাহরুখ খান সমস্ত হল মালিকদের একত্রে রাজী করালো কি করে? উত্তর হল— ফিল্ম রিলিজের আগেই প্রচুর টিকিট শাহরুখ খান নিজেই কিনেছে আর ভক্তদের মধ্যে বিলিয়েছে অকৃপণভাবে। এর দ্বারা হল মালিকদের ন্যূনতম ব্যবসাটুকু শাহরুখকেই নিশ্চিত করতে হয়েছে কারণ তা না করলে অন্য সমস্ত ফিল্মের শো বন্ধ করে বা শো সংখ্যা কমিয়ে ‘পাঠান’এর একগাদা শো চালাতে হল মালিকদের রাজী করাতে শাহরুখ খান পারত না। ‘প্রজাপতি’র ডিমাণ্ড খুব বেশি, চলছে হু হু করে। অথচ তা সত্ত্বেও বায়োস্কোপে ‘প্রজাপতি’র শো কমিয়ে ‘পাঠান’ চালাতে বললে ‘প্রজাপতি’ চালিয়ে যে ব্যবসাটুকু নিশ্চিত হচ্ছিল সেটুকু অন্ততঃ পুষিয়ে দিতে শাহরুখকে হতই। নাহলে হল মালিকদের রাজী হওয়ার কারণ ছিল না। এ হেন ডিল পাক্কা হওয়ার পরই হয়ত সব হলের মালিকরা একযোগে কেবলমাত্র সামনের সারির সিট অ্যাভেইলেবল করে রাখার কৌশল নিতে রাজী হয়েছেন বলে আন্দাজ করা যায়। অতঃপর গতকাল ‘বায়োস্কোপ’এর টিকিট কাউন্টারে সশরীরে দাঁড়িয়েও দেখলাম একই চিত্র। খালি আছে কেবল সামনের সারি।


তারপর দেখা গেল আর এক দৃশ্য। শো দেখে বেরোচ্ছেন অসংখ্য মুসলিম নারী পুরুষ। গতকাল ‘বায়োস্কোপ’এ মুসলিম মানুষের ভিড় ছিল অস্বাভাবিক রকম বেশি। কোয়েস্ট মল ‘Insignia’ তে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ভিড় দেখলে অস্বাভাবিক লাগার কথা নয়, কিন্তু ‘বায়োস্কোপ’এ তা স্বাভাবিক নয়। অতঃপর পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া আজ রিপোর্ট করেছে যে বাংলাদেশের ফিল্ম অ্যাক্টররাও নাকি ‘পাঠান’ দেখতে কলকাতায় এসেছে কারণ বাংলাদেশে ‘পাঠান’ রিলিজড্ হয় নি। তখন আন্দাজ করা গেল যে ঐ বিপুলসংখ্যক মুসলিম জনগণের ভিড় আদতে হয়ত ছিল বাংলাদেশীদের ভিড়। অর্থাৎ শাহরুখ খান টিকিট পাঠিয়েছে শুধু এ রাজ্যের ফ্যানদের জন্য নয়, তার বাংলাদেশের ফ্যানেদের জন্যও। শাহরুখের কাটা টিকিটেই বোধ করি গতকাল ভরে' ছিল ‘বায়োস্কোপ’। সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ ছিল সরস্বতী পুজোর দিনের পুঁচকে লাভ বার্ডদেরও ভিড়। কিন্তু এ থেকে কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে গতকালের ভিড় ছিল কৃত্রিম এবং মানুষ নিজেরা টিকিট কেটে এ ছবি দেখতে যায় নি? উত্তর হল— মানুষ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ ছবি দেখতে যেত তাহলে গতকালের গিজগিজে ভিড়ের ‘বায়োস্কোপ’ আজকেই এমন শুনশান ফাঁকা হয়ে যেত না।


‘পাঠান’ শুধু ফ্লপ তাই নয়, খুব বড় ফ্লপ কারণ এ ছবি যাতে ফ্লপের তকমা না পায় তার জন্য শাহরুখ খানকে ছবি বানানোর ফিক্সড্ খরচ ছাড়াও ব্যয় করতে হয়েছে সুবিশাল পরিমাণ প্রোমোশনাল (ক্যারিং) কস্ট। প্রথমেই ম্যানেজ করতে হয়েছে ফিল্ম ক্রিটিক তরণ আদর্শকে। পজিটিভ পারসেপশন তৈরি করার প্রথম কাজটি তরণ আদর্শকে দিয়েই করিয়েছে শাহরুখ খান। তরণ আদর্শ পজিটিভ রিভিউ দিয়েছেন এবং গাঁটের কড়ি যে তার জন্য খরচ করতে হয়েছে সে কথা বুঝি বলা বাহুল্য। উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গে এ ফিল্মের প্রচারে অল আউট অ্যাপ্রোচ নিয়েছে শাহরুখ খান। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত মিডিয়া একযোগে প্রচার করেছে ‘পাঠান’এর হয়ে। মিডিয়ার খাঁই মেটানোর খরচটি যে খুব বড় খরচ সে কথা বোধ করি কারুরই অজানা নয়। তাছাড়াও শাহরুখ খানকে নিশ্চিতভাবেই অগ্রিম পেমেন্ট করতে হয়েছে হল মালিকদের ন্যূনতম ব্যবসামূল্যটুকু। উপরন্তু এ রাজ্য ও বাংলাদেশের ভক্তদের জন্য কিনতে হয়েছে বিপুল সংখ্যক টিকিট এবং টলিগঞ্জ ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির অ্যাক্টরদেরকেও নিশ্চিতভাবেই দিতে হয়েছে তাদের সিনেমার শো বাতিল করে ‘পাঠান’ চালানোর জন্য ক্ষতিপূরণের খরচ। এতসব করার পর শাহরুখের ছবির বক্স অফিস কালেকশন যা-ই হোক, net কালেকশন যে এখনও নেগেটিভ সেকথা বোধ হয় বলাই যায়। ‘পাঠান’ অনেক বড় ফ্লপ, কিন্তু শাহরুখ খান বা মিডিয়া কেউই তা মুখ ফুটে বলবে না কারণ টানা ফ্লপের কারণে বলিউড ধ্বসে পড়ার যে পারসেপশন পাবলিকের মনে তৈরি হয়েছে তা ভাঙ্গতে চাইছে সকলেই। বলিউডের মন্দা কাটিয়ে উঠতে চাইছে কঙ্গণা রাণাওয়াত, অনুপম খেরের মত বলিউডের অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীরাও কারণ পেটে লাথি পড়ছে সকলেরই। তাই ‘পাঠান’এর আদত চিত্র দেখতে হলে মানুষকে চোখ খুলে তাকাতে হবে সিনেমা হলগুলির দিকে, নিতে হবে অন দ্য গ্রাউন্ড খোঁজখবর। বাস্তব হল—পাকিস্তানের মত বলিউডের  ধ্বংসও এখন প্রায় নিশ্চিত। বলা যেতে পারে ম্যাথমেটিক্যাল সার্টেইনটি।

Comments

Popular posts from this blog

রথযাত্রা: কুমুদরঞ্জন মল্লিক

SSC চাকরি বাতিল: যোগ্য - অযোগ্য বিভাজন আদৌ সম্ভব?

মমতার সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতির শিকড় দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের স্পৃহার মধ্যে

Radical Forces Spreading Tentacles: Bangladesh to West Bengal to Jharkhand